“লেনিন সেবার শীতকালে/ভালোবেসে ফুল জীবন্ত/আনলেন মরা দিনকালে/তোমারই জন্য বসন্ত” – শুধু রাশিয়ার মরা দিনকালেই নয়, দুনিয়াজোড়া মুষ্টিমেয় মানুষের শাসনের হিমশীতল কাঠামোতেই কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল রুশ বিপ্লব। দেশে দেশে গড়ে উঠেছিল বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, যারা লড়াই শুরু করেছিল মেহনতি মানুষ এবং সমগ্র জাতি ও দেশের মুক্তির জন্য। একদিকে লড়াই এবং অন্যদিকে সেই লড়াইকে আটকানোর নানাবিধ প্রচেষ্টা – পরবর্তী প্রায় সাত দশক ধরে এটাই হয়ে থেকেছে বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক। লড়াই চলেছে কখনো সামরিক অস্ত্রসজ্জায়, কূটনীতিতে, কখনো সাংস্কৃতিক যুদ্ধে, আবার কখনো প্রচারাভিযানের মতো নানা বিচিত্র রাস্তায়। দুনিয়ায় ডান ও বাম রাজনীতির নানা ধরন এবং তাদের বিচিত্র মিশ্রণ আমরা লক্ষ্য করেছি। এমন কী সোভিয়েত ভাঙনের তিরিশ বছর পরেও তা বহমান।
অনেক বিশ্লেষক, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বিভিন্ন সময়ে বলার চেষ্টা করেছেন বুর্জোয়া রাজনীতির মধ্যে যে বিচিত্র দ্বন্দ্বসংঘাত এবং প্রাণস্পন্দন আছে, বাম রাজনীতি বিশেষত কমিউনিস্ট রাজনীতির মধ্যে তার বেশ অভাব। এখানে শ্রেণীসংগ্রামের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়কে কেন্দ্র করেই যাবতীয় ডিসকোর্স আবর্তিত বলেই এমনটা হয়, একথাও বলার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল দুনিয়াজোড়া কমিউনিস্ট ও বাম আন্দোলনের বিচিত্র গতিপথকে এই তত্ত্ব একেবারেই মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করেনি। দেশে দেশে অর্থনীতি, রাজনৈতিক কাঠামো, সংস্কৃতি ইত্যাদির যে ভিন্নতা তাকে স্বীকার করেই কমিউনিস্ট আন্দোলন ও বাম আন্দোলন বহু বিচিত্র ধারায় বিকশিত হয়েছে। এমন কী দুনিয়াজোড়া যে সমাজতান্ত্রিক/নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবগুলি সম্পন্ন হয়েছে, তার গতিপথ ও চরিত্রে রয়েছে অনেক বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা। রুশ বিপ্লব, চীন বিপ্লব, কিউবার বিপ্লব বা ভিয়েতনামের কথা স্মরণ করলেই আমরা এগুলো বুঝতে পারি।
রাশিয়ার বিপ্লব প্রচেষ্টা প্রসঙ্গেই লেনিন মার্কসবাদের সৃজনশীল দিকটির কথা তুলেছিলেন। একটি গুরূত্বপূর্ণ রচনায় লেনিন লিখেছিলেন, “আমরা মার্কসের তত্ত্বকে পরিসমাপ্ত ও স্পর্শাতীত কিছু একটা বলে দেখি না। উল্টে আমরা বরং মনে করি যে তা একটা বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করেছে। জীবন থেকে পিছিয়ে পড়তে না চাইলে তাকে সব দিক থেকে আরো বিকশিত করতে হবে সমাজতন্ত্রীদের।” মার্কসীয় তত্ত্বের প্রতি এই ধরনের সৃজনমূলক মনোভাব রুশ বিপ্লবের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি ছিল। মার্কস-এঙ্গেলস মনে করেছিলেন উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব এবং একগুচ্ছ ধনতান্ত্রিক দেশে বিপ্লব না হলে তাকে রক্ষা করা কঠিন। লেনিনবাদ তার সৃজনীশক্তি দিয়ে রাশিয়ার মতো তুলনামূলকভাবে পশ্চাদপদ একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশ, যেখানে সামন্ততন্ত্রের প্রবল উপস্থিতি থেকে গিয়েছে, সেখানেও যে প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে শ্রমিক ও গরিব কৃষকদের মধ্যে মৈত্রীর ভিত্তিতে বিপ্লব সফল করে তোলা যায় – তা দেখাল। সেইসঙ্গে অন্য কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশের উপস্থিতি ছাড়াই কেবলমাত্র দেশের ভেতরের শ্রমিক, কৃষক, সেনাবাহিনী ও জনগণের ব্যাপকতম অংশের আস্থা জয় করে দেশের মধ্যেকার কুলাক ও প্রতিবিপ্লবী শক্তি এবং বাইরের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে (জাপান, ফ্রান্স, ইংলন্ড, জার্মানি ইত্যাদি) লড়াই করে বিপ্লবকে টিঁকিয়ে রাখতে সক্ষম হল। ইউরোপীর রাশিয়া থেকে শুরু করে এশীয় রাশিয়ার কোণে কোণে তাকে ছড়িয়ে দিতে পারল। এই ব্যবহারিক অর্জনগুলি হয়ে উঠল নতুন তাত্ত্বিক শিক্ষা।
মার্কসবাদের এই সৃজনশীল দিকটির বিকাশের জন্য ব্যাপক অধ্যয়নের ওপর জোর দিয়েছিলেন লেনিন। নিজেই শুধু সমকালীন জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পারঙ্গম হয়ে উঠেছিলেন তাই নয়, বলশেভিক কমরেডরা যেন এই বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠেন, সেজন্য তাঁর আন্তরিক প্রয়াস ছিল। ১৯১১-তে প্যারিসে পার্টি স্কুলের এক বড় আয়োজন ছিল গুরূত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কাজ। পিটার্সবুরগ, মস্কো, সরমোভো, বাকু, তিফলিস সহ রাশিয়ার অনেকগুলি শহরের অগ্রণী বলশেভিকরা এই পার্টি স্কুলে অংশগ্রহণ করেন। এই পার্টি স্কুলে লেনিন অর্থশাস্ত্র নিয়ে ২৯টি, কৃষি প্রশ্নে ১২টি, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে ১২টি বক্তৃতা দেন। লেনিনের বক্তৃতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল বোধগম্যতা ও প্রাঞ্জলতা। অর্থশাস্ত্র ও দর্শনের দুরূহতম প্রশ্নগুলিকেও লেনিন আলোচনা করতেন শ্রমিকদের আয়ত্তাধীন ও বোধগম্য রূপে। পাঠের চরিত্র প্রায়ই হত সজীব আলাপের মতো। উপস্থিত সকলেই তাতে যোগ দিতেন। পড়াশুনো হতো অনেক এবং বেশ খাটাখাটনি করে প্রস্তুতি নিয়ে। স্কুলের কাজে লেনিন খুব খুশিি ছিলেন। এই পার্টি স্কুলটি ছিল ভবিষ্যতের বলশেভিক পার্টি স্কুল কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরী। লেনিনের সারাজীবনের লেখালেখি লক্ষ্য করলেও পার্টি শিক্ষার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজরের দিকটি আমরা অনুধাবন করি।
লেনিনবাদের সৃজনী শক্তিই মার্কসবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে, দেশে দেশে মেহনতি মানুষের জয়ের ক্ষেত্রে বারবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, চীন বিপ্লবের ক্ষেত্রে মাও সে তুং চিন্তাধারার মধ্যে যার এক ভিন্ন প্রকাশ আমরা দেখেছি। মূলত কৃষক সমাজকে ভিত্তি করে চীন বিপ্লবের যে অগ্রগতি তা মার্কসীয় বীক্ষায় নতুন সৃজনমূলক দিক ছিল লেনিনের পর।
লেনিনবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অনাপোষী মনোভাব। মতাদর্শের প্রতি দৃঢ় থেকে স্রোতের বিরুদ্ধে পথ হাঁটার ব্যাপারে লেনিন ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পরেই প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে পিছু হটার একটা পর্ব শুরু হয়। ইউরোপের বিভিন্ন সমাজ গণতান্ত্রিক দলগুলো নিজ নিজ দেশের যুদ্ধস্বার্থ তথা জাতীয় বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি শুরু করে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে যায় কেননা শ্রমিক শ্রেণির বিভিন্ন দল নিজ নিজ দেশের পুঁজির স্বার্থে পরস্পরের শত্রু শিবিরে দাঁড়িয়ে যায়। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং বেলজিয়ামে সোশালিস্টরা সরাসরি সরকারে যোগ দেয়। জার্মানিতে সরকারে যোগ না দিলেও যুদ্ধ চালানোর জন্য ব্যয়বরাদ্দের পক্ষে ভোট দেয়। তারা প্রচার করে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, সমস্ত দেশের শ্রমিকদের শ্রেণী ঐক্য, তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ হল শান্তিকালীন সময়ের ব্যাপার। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে নিজ দেশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা তাদের ভুলতে হবে। সব কিছুকে হতে হবে যুদ্ধের অধীন। রাশিয়ায় প্লেখানভের মতো সম্মানীয় মার্কসবাদীও এই ভুল পথ নেন। বলশেভিক পার্টি ও তার নেতা লেনিনের নেতৃত্ব এই নিরিখে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছিল। লেনিন ও বলশেভিকরা যুদ্ধের প্রথম থেকেই দ্বিধাহীনভাবে এই যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে বর্ণনা করেন ও এটা স্পষ্ট করে দেন যে শ্রমিকদের কাজ নয় জাতিয়তাবাদের নামে নিজ নিজ দেশের বুর্জোয়াদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে মদত দেওয়া। দেশ বিদেশের প্রতিকুল স্রোত এবং অজস্র ধরপাকড় অত্যাচার নির্যাতনের মুখে দাঁড়িয়েও বলশেভিকরা তাদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থানে অটুট থাকে। লেনিনের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কর। তিনি বললেন অপর দেশের যে সমস্ত মজুরি-দাসেরা আমাদের ভাই তাদের বিরুদ্ধে নয়, অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরতে হবে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া সরকারের বিরুদ্ধে। যুদ্ধের সময়েও প্রলেতারিয় বিপ্লবের আহ্বানকে ভুলে যাওয়া চলে না। লেনিন আহ্বান রাখলেন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করার পক্ষে, যা সংগঠিত হবে নিজ নিজ দেশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি জনতার বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে। ‘ইউরোপীয় যুদ্ধে বিপ্লবী সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কর্তব্য’, ‘সমাজতন্ত্র ও যুদ্ধ’ প্রভৃতি বইতে লেনিনের এই সমস্ত চিন্তা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের যে নতুন সময়ে দুনিয়া প্রবেশ করল তাকে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে লেনিন লেখেন ‘ইম্পিরিয়ালইজম : দ্য হায়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটালিজম’ (সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়) নামক ক্লাসিকটি। এই বইতে লেনিন দেখান সাম্রাজ্যবাদের আমলে দেখা দেয় বড় বড় একচেটিয়া কারবার ও পুঁজিপতিদের জোট। এই সাম্রাজ্যবাদকে তাই লেনিন বলেন একচেটিয়া পুঁজিবাদ। বিশ্বের কাঁচামালের উৎস, পণ্যোৎপাদন ও বাজারের একটা বৃহৎ অংশ দখল করে নেয় একচেটিয়া মালিকেরা। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রভুত্ব করতে থাকে তারা, সরকারগুলির ওপর নিজেদের অভিপ্রায়কে চপিয়ে দেয়। মুষ্টিমেয় সাম্রাজ্যবাদী দেশ নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেয় প্রায় সারা বিশ্বকে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের অসমতা বৃদ্ধি পায়। মুনাফার তাড়ণায় সাম্রাজ্যবাদীরা শ্রমিক ও সমস্ত মেহনতিদের শোষণ বাড়িয়ে তোলে, তাদের অবস্থা হয়ে ওঠে অসহ্য। বিপ্লবের আবশ্যিকতা বুঝতে শুরু করে প্রলেতারিয়েত। সেই সঙ্গে মুষ্টিমেয় সাম্রাজ্যবাদী দেশের দ্বারা নিপীড়িত যে উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশে কোটি কোটি লোকের বাস তাদের সঙ্গে বিরোধ প্রখর হয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির। লেনিন দেখান কীভাবে পুঁজিবাদ ক্রমশ হয়ে উঠেছে প্রতিক্রিয়াশীল, সমাজের বিকাশের পথে এক মহা বিঘ্ন। মানবসমাজের সামনে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটা অথবা উপনিবেশ, একচেটিয়াদের বিশেষ সুবিধা, সব ধরনের জাতীয় পীড়নে অভ্যস্ত হয়ে পড়া। সাম্রাজ্যবাদ মানবসমাজকে এক বিশেষ অর্থে সমাজতন্ত্রের কাছাকাছি নিয়ে আসে। এর সঙ্গে সমঝোতার ভুল পথ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বহু দল নিলেও লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বলশেভিকরা কখনো নেননি। তাঁরা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মূল স্রোতের বিরুদ্ধে মতাদর্শে দৃঢ় থেকে চলতে পেরেছিলেন বলেই রাশিয়ায় বিপ্লবের কাজটা এগিয়ে যেতে পেরেছিল। লেনিনবাদের দুটি বিশেষ দিক – সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অনাপোষী সংগ্রাম এবং নিজের দেশকালের নিরিখে মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগ আজকের দিনের কমিউনিস্টদের জন্যও আলোকবর্তিকা।