করোনা থেকে মুক্তির লড়াইয়ে লকডাউন ব্যবস্থা এখনও যা স্থির আছে আরও দিন দশেক চলবে। তারপরে কী দাঁড়াবে তার কোনো আভাস এখনও নেই। প্রধানমন্ত্রী আবার কবে জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর পরবর্তী ভাষণ দেবেন, কী বলবেন তারও কোনো ইঙ্গিত নেই। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্মসচিব তথ্য শুনিয়েছিলেন, লকডাউন না করলে সংক্রমণ ১৫ এপ্রিলের মধ্যে পৌঁছে যেত ৮.২ লক্ষে। ঐ বিবৃতির মধ্যে দিয়ে লক ডাউনের প্রশ্নাতীত কার্যকারিতাই কেবল জাহির করতে চাওয়া হয়েছিল। কোনো সমালোচনা কানে তোলা হয়নি। বিপরীতে, সমালোচনায় যারা সোচ্চার তারা এর উপযোগিতার বিরোধী নন, তাদের প্রবল সমালোচনা রয়েছে অপরিকল্পিত বে-দরদী লকডাউন চাপানোর বিরুদ্ধে। ঘটনাপ্রবাহে অজস্র তথ্যপ্রমাণ মিলেছে, এখনও মিলছে, লকডাউন সমাজের ওপরতলার অংশের কাছে না হলেও ব্যাপকতম জনতা, বিশেষত শ্রমজীবী জনতার কাছে চরম নিষ্ঠুরতার কারণ প্রতিপন্ন হয়েছে! কেন্দ্র সংক্রমণের বিপদ এড়ানোয় যাই-ই প্রাথমিক সাফল্য দাবি করে থাকুক, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে পৌঁছে সংক্রমণ বৃদ্ধির অবস্থা যথেষ্ট দুশ্চিন্তাজনক। ‘দি টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক সমীক্ষা রিপোর্ট বলেছে, দেশব্যাপী সংক্রমণের বৃদ্ধির হার কমলেও, সংক্রমণ বৃদ্ধিই প্রধান প্রবণতা, আর মৃত্যুহারও বাড়ছে। এখনও টেস্টকে প্রত্যাশিত গুণমানে ও ব্যাপকতায় নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে থাকছে ঘাটতি। টেস্ট সেন্টারের সংখ্যা এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত যা ছিল তারপর তার সংখ্যাবৃদ্ধির ব্যাপারে দেশ কোথায় রয়েছে সেই তথ্য পরিসংখ্যান পরিস্কারভাবে জানানো হচ্ছে না। আক্রান্ত হওয়ার তালিকায় সাধারণ মানুষের সাথে সাথে বেড়ে চলেছে এমনকি চিকিৎসারত ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, সাফাই কর্মীদের সংখ্যা। অপ্রতুল ও নিম্নমানের প্রতিরোধক সাজ সরঞ্জামই করোনা মোকাবিলায় ফ্রন্টলাইনে থাকা বাহিনীর সংক্রামিত হয়ে যাওয়ার মূল কারণ।
কেন্দ্রের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক বলেছে, দেশের দশটি বড় বড় শহরে লক ডাউননের প্রথম পর্বে গৃহহীন, ভিক্ষুক ও অন্যান্য ফুটপাতবাসী প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষকে খাইয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু একবারও এই পরিসংখ্যান পেশ করতে দেখা গেল না যে দেশব্যাপী ভুখা, নিরাশ্রয়ী, হয়রান হয়ে চলা হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিকদের খাওয়া-পরা-আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে, তাদের ঘরে ফেরানো ও পরিবারকে পরিষেবা দেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার কী করেছে! ২৭ মার্চ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সমীক্ষার রিপোর্ট ছিল খুবই করুণ। সমীক্ষা করেছিলেন একটি স্বনিয়ন্ত্রিত সংস্থার একদল গবেষক কর্মী। রিপোর্টে প্রকাশ, লক ডাউনে আটকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রায় ৯৬ শতাংশের কোনো রেশন মেলেনি, আর ৭০ শতাংশ কোনোরকম স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিবেশিত রান্না করা খাবারের সন্ধান পায়নি। এফসিআই-এর গুদামে ৭৭ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। তাহলে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজ্যে রাজ্যে ঘরে ঘরে বা যেখানে যেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের আটকে রাখা হয়েছে সেখানে সরকারি ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের সুষ্ঠু বন্দোবস্ত করা হবে না কেন। এ প্রসঙ্গে কোনো কথাই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ছিল না, আজও কেন্দ্রের মুখে টু-শব্দটি শোনা যাচ্ছে না। কেন্দ্র বরং লক ডাউনের ধূয়ো তুলে যারা নিজ ঘরে আছেন তাদের ভুখা-আধা ভুখা গৃহবন্দী করে রাখছে, অন্যদিকে পরিযায়ীদের ঘরে ফেরানোর প্রশ্নে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, আর রিলিফের প্রশ্নে কোনোরকম যুদ্ধকালীন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ছাড়াই সমস্ত দায়িত্ব চালান করে দিয়েছে রাজ্য সরকার এবং এনজিও-গুলোর ওপর। লকডাউনে আটকে গিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের কী দূর্ভোগ-উৎপীড়ন-বর্বরতার শিকার হতে হয়েছে দিল্লী বা বান্দ্রার রেল স্টেশনের চিত্রাবলী তার দৃশ্যমান খন্ডচিত্র মাত্র। ঘরবন্দীর অনুশাসনের নামে কোথাও যেমন উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকারের পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে খিদের জ্বালায় বিস্কুট কিনতে বের হওয়া মুসলিম তরুণকে, তেমনি কাশ্মীরে কুখ্যাত ইউএপিএ-তে যুবতী মহিলা আলোকচিত্রী সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হল প্রধানমন্ত্রীর প্রদীপ জ্বালানোর কর্মসূচীর সমালোচনা ফেসবুকে পোস্ট করার ‘অপরাধে’! এছাড়া রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন পুরানো মামলা খুঁচিয়ে তুলে সংগ্রামী মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার বা ছাত্রকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশী তদন্ত অনুমোদন পাচ্ছে, লকডাউন অমান্যের অজুহাত দেখিয়ে শয়ে শয়ে গ্রেপ্তারি অভিযান চলছে। এব্যাপারে রাজ্য সরকারগুলো কিছু কম যাচ্ছে না। রেশনে ‘গরিব কল্যাণ যোজনা’য় খাদ্যশস্য দেওয়ার কেন্দ্রীয় প্যাকেজ ঘোষণা হয় বহু চাপ ওঠার পরে। প্রধানমন্ত্রী ভাষণে রেশন দেওয়ার কথা শোনালেও সপ্তাহ গড়িয়ে যায়, রাজ্যে রাজ্যে বাস্তবে তার যোগান মেলেনি। তবে ‘নীতি আয়োগে’র সিইও রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলোতে কর্তৃস্থানীয়দের চিঠি পাঠান। যাতে সমস্ত দাতব্য ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো এফসিআই গুদাম থেকে ২২ টাকা কিলো চাল ও ২১ টাকা কিলো গম সংগ্রহ করতে পারে। শুধু তাই নয়, জানিয়ে দেয় ত্রাণের জন্য চাল-গম কেনায় কোনও ঊর্দ্ধসীমা থাকছে না। এনজিও সংস্থাগুলোর প্রতি এত দরাজহস্ত হওয়ার পিছনে প্রকৃত কারণ রহস্যপূর্ণ। ঐ সংস্থাগুলোর অধিকাংশের নেপথ্য-পরিচালন ক্ষমতায় রয়েছ বকলমে বিজেপি-আরএসএস নেটওয়ার্ক। বাজেটে টাকা ধরা থাকে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা খাতে, হাজার হাজার কোটি টাকা জমে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে, টাকা জমা পড়ছে উপরন্তু ‘পিএম কেয়ারস ফান্ডে’। তবে অসহায় অবস্থায় থাকা ৬০-৭০ শতাংশ জনতার একাউন্ট পিছু নগদ ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকা পাঠানো যাচ্ছে না কেন? দায় এড়াতে সরকার নিয়েছে নীরবতার কৌশল। লকডাউনে আটকে যাওয়া বিদেশীদের এক বড় দলকে বিশেষ বিমানে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাঠানো হল, এমনকি সড়ক পথে পাকিস্তান সীমান্তে প্রত্যর্পণ করে আসার ব্যবস্থা হল, কিন্তু দেশের মধ্যে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক ও অন্যান্যদের ফেরানোর বন্দোবস্ত হয় না!
খাদ্যের অধিকার, গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক জরুরি অবস্থা।
করোনা পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতি বেশ অস্থিরতা ও গোলমেলে পাকচক্রের আবর্তে পর্যবসিত হচ্ছে। সময়মতো কথা নেই, বার্তা নেই, কেন্দ্রের প্রতিনিধি দল টেস্ট, লক ডাউন, রেশন ব্যবস্থা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণের নামে যেভাবে ঝটিতি সফরে এলেন, সীমান্তরক্ষী বাহিনী পরিবৃত হয়ে, রাজ্য সরকারকে অগোচরে রেখে, পছন্দমতো পরিদর্শন পরিক্রমায় নেমে পড়লেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার রীতিনীতি লঙ্ঘন করারই সমার্থক। কেন্দ্র সাফাই দিচ্ছে ‘জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলার আইনি ধারা’ মেনেই অভিযানে এসেছে। বাস্তবে ওপর থেকে কর্তৃত্ব ফলানোর অপপ্রয়াস শুরু করেছে, একটা সমান্তরাল গোয়েন্দা অভিযান চালাতে চাইছে। কেন্দ্রের এই ভূমিকা দেখতে চায় একমাত্র রাজ্যপাল এবং বলাবাহুল্য বিজেপি। রাজ্যপালের সাথে ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে বিজেপির রাজ্য প্রতিনিধি দলের, আর রাজ্যপাল বিজেপির দাবি মতোই এরাজ্যে করোনার মোকাবিলার দায়িত্ব আধা-সেনার হাতে তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন কেন্দ্রের কাছে। এইসব পুঁজি করে কেন্দ্র তার হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য হাসিল করতেই পাঠিয়েছে প্রতিনিধিদল। কীভাবে কেন্দ্রকে পশ্চিমবঙ্গবাসীর দরদী চিত্রিত করার এবং বিজেপির রাজনীতির বাজার জমানোর সুযোগ করা যায়, এটাই মোদী-অমিত শাহ’দের টার্গেট।
রাজ্যের তৃণমূল সরকারের করোনা পরিস্থিতির সার্বিক মোকাবিলার নমুনা জনগণের মধ্য অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলছে। করোনা টেস্ট, চিকিৎসা ব্যবস্থা, আক্রান্ত তালিকা, মৃত্যু সংখ্যা, মৃতদেহ দাহ করা, রেশন দুর্নীতি, ত্রাণ কাজে দলতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে তথ্য গোপন করার অভিযোগ উঠেই চলেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে, পুঞ্জিভূত হচ্ছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। পরিস্থিতিতে এতো ব্যর্থতা-অপদার্থতা-দূর্গন্ধ-অভাব-অভিযোগ ছড়ানো পরেও মুখ্যমন্ত্রী ড্যামেজ কন্ট্রোলে চালাকির আশ্রয় নিচ্ছেন। রেশন ব্যবস্থায় ৯০ শতাংশ ঠিকঠাক চলছে, গোলমাল মাত্র ১০ শতাংশ সাফাই গেয়ে আর দায়িত্ব থেকে একজন অফিসারকে অপসারণ বা খাদ্যমন্ত্রীকে কিঞ্চিৎ ভর্ৎসনা করে, এভাবে কিছু কিছু ওপর ওপর প্রসাধনী মেকআপ দিয়ে চেষ্টায় আছেন জনক্ষোভ থেকে পার পাওয়ার। এভাবে হাত ধূয়ে ফেলার অপচেষ্টা কিন্তু লোকের চোখে নির্লজ্জ্বই ঠেকছে। এইসব অপকীর্তি উল্টে কেন্দ্রের ও বিজেপির মাতব্বরি ডেকে আনার উপকরণ যোগাচ্ছে।