ভোগবাদ ভাইরাস
bho

ভোগবাদ মিতব্যয়িতাকে একটি অসুস্থতা বলে মনে করে। পুঁজিপতিদের মুনাফাচক্র চালু রাখার জন্য ভোগবাদী মানসিকতা গড়ে তোলা হয়। সব কিছুই পণ্য হয়ে রায়। নতুন নতুন পণ্য ভোগ করাই জীবনের লক্ষ্য ও সার্থকতা বলে মনে হতে থাকে। টিভি খুলে হয়তো প্রথম যে বিজ্ঞাপনটা আপনার চোখে পড়লো সেটা কর্পোরেট সংস্থার তৈরি করা সুস্বাদু খাদ্যের, আর তার পরের বিজ্ঞাপনটিতেই হয়তো দেখছেন মেদাধিক্য কমানোর উপায় হিসেবে তুলে ধরা পণ্য। প্রতিদিন কোনো না কোনো ভাবে গড়ে এইরকম অন্তত ১৬০০ বাণিজ্যিক বার্তা আমাদের সামনে এসে হাজির হচ্ছে, আমাদের বলছে : কেনো, হয় এটা নয় ওটা অথবা অন্য আরেকটি, কেনো। বিশ্বের অভুক্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে যে পরিমান অর্থের প্রয়োজন, মার্কিন জনগোষ্ঠী তার থেকে বেশি অর্থ ব্যয় করে নিজেদের মেদাধিক্য কমাতে এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে। ভোগবাদ অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্যকেও অপরিহার্য পণ্যে পরিবর্তিত করেছে।

সমগ্র খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাটাই সাধারণ কৃষকদের পেশা থেকে বহুজাতিক সংস্থার মুনাফা উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। আর খাদ্য উৎপাদনে পরিবেশ রক্ষার দায়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার বিস্তৃত ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের সাথে সংহতিপূর্ণ কৃষিপদ্ধতির বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী কৃষি পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে রাসায়নিক সমরাস্ত্র শিল্পকেই সবুজ বিপ্লবের নামে কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিল। ধীরে ধীরে এই ধ্বংসাত্মক পদ্ধতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে একদিকে ক্রমাগত অস্থির হয়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, আর অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির থাবা ক্রমশ গ্রাস করেছে ভারত বা ল্যাটিন আমেরিকার মতো বৃহৎ কৃষিক্ষেত্রগুলিকে।

গত বছরের নভেম্বরে, ১৮৪টি দেশের ১৫,০০০-এরও বেশি বিজ্ঞানী মানব সভ্যতা নিয়ে এক ভয়ঙ্কর সাবধানবাণী জারি করেছিলেন। আমাদের বিশ্বের সম্পদ উৎসের অত্যধিক ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে তারা ঘোষণা করেছিলেন যে, প্রতিদিন আমরা নিজেরাই ঘোর দুর্বিপাক ডেকে আনছি এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে এক চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে চলেছি। তারা সতর্ক করে বলেছিলেন যে, “হাতে আর সময় নেই, প্রতিনয়ত আমরা যে পথে চলে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছি, অবিলম্বে সেই পথ ত্যাগ করতে হবে।” পরিবেশ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট বলছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দশ লক্ষ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, যে প্রজাতিগুলি কোনো না কোনো ভাবে ভোগবাদ দ্বারা প্রভাবিত। আর যারা এই ভোগবাদের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকবে, তারা “যোগ্যতমের উদ্বর্তন”-এর নিয়মে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নিজেদের অভিযোজিত করবে, তার নিজস্ব গঠনের পরিবর্তন হবে, খুঁজে নেবে অন্য বাসা। যে অণুজীব গভীর জঙ্গলে বসবাস করতো, জঙ্গল উজাড় করে তৈরি করা পশু খামারগুলির শুকরের দেহে সে প্রবেশ করে শুকরের মড়ক ঘটাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পুরো একটি প্রজাতির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। যে অণুজীব মুরগীর দেহে বসবাস করতো, অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ও রাসায়নিকের ব্যবহার এবং অতিরিক্ত ডিম পাওয়ার উদ্দেশ্যে মুরগীকে না খাইয়ে রাখার কারণে সেই অণুজীবটির অস্তিত্ব বিপর্যস্ত হওয়ায় সে এবার খুঁজে নিচ্ছে খামারি শ্রমিকের দেহ। শস্য চাষের সময় জমিতে কীটনাশক বিষের ব্যাপক ব্যবহার হাজার হাজার বছর ধরে জমিতে বসবাসকারী জীবাণুকে তার দীর্ঘদিনের বাসস্থান ছাড়তে বাধ্য করেছে, নিজের গঠন পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে, সে হয়তো খুঁজে নিয়েছে অন্য কোনো প্রাণীর দেহ। অর্থাৎ শস্য ও প্রাণীর পুঁজিবাদী শিল্পোৎপাদন পদ্ধতি একের পর এক মহামারীর সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে। বিজ্ঞানীরা সাবধানবাণী উচ্চারণের সাথে সাথে অন্তত এক ডজন পথও বাতলে দিয়েছিলেন, যে পথে চললে মানব সভ্যতা বেঁচে যাবে। যেমন বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত প্রাকৃতিক আবাসগুলিকে খামারে পরিণত করার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে, প্রকৃতি তথা বাস্তুতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে হবে, উদ্ভিজ্জ খাবার বেশি গ্রহণ করতে হবে ইত্যাদি।

এর আগে ৯৬ সালেও বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি এই সাবধানবাণীকে এড়িয়ে গেছে। মিডিয়া গুলি এই সংক্রান্ত খবর প্রায় প্রচারই করেনি। ২০০৯ সাল থেকে একের পর এক প্রাণঘাতী ভাইরাসের উত্থান প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষকে মেরেছে, বহুজাতিক পুঁজিপতিরা সেই দাস ব্যবসায়ীদের মতোই নিষ্ঠুর নির্লিপ্ততায় আরো আরো মারাত্মক উৎপাদন পদ্ধতিতে তাদের মুনাফা বাড়িয়ে চলেছেন। আরো স্পষ্ট করে বললে ভোগবাদ এই নতুন নতুন প্রাণঘাতী ভাইরাসগুলি উঠে আসার একমাত্র কারণ। সুতরাং করোনা ভাইরাস সহ সাম্প্রতিক কালের প্রাণী বা উদ্ভিদ যে কোনো জগতের মহামারী কোনো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, বরং তা মনুষ্য সৃষ্ট।

খণ্ড-27