কার্ল মার্ক্সের দ্বিশতবার্ষিকী পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছেছি লেনিনের একশ পঞ্চাশতম জন্মশতবার্ষিকীর দোরগোড়ায়। লেনিনের মৃত্যুর পরেও প্রায় কেটে গেছে একশ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে ভোলগা আর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। লেনিন আজ অনেকটাই ঐতিহাসিক বিস্মৃতির কবলে। যে সময়ে ভগৎ সিং লেনিন পড়ে ফাঁসির মঞ্চে চড়তেন, যে সময়ে সুকান্ত লিখতেন “বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আমিই লেনিন”, যে সময়ে শেখ আবদুল্লা তাঁর দলের জন্য বেছে নিতেন লাল পতাকা আর শ্রীনগরে গড়ে উঠত লাল চক বা রেড স্কোয়ার, সেই সময় থেকে আজকের সময়টা বেশ ভিন্ন। পৃথিবীর বড় অংশ জুড়ে বিশেষ করে আমাদের দেশে সময়টা আজ যথেষ্ট গোলমেলে। এই গোলমেলে সময়ে উচ্ছ্বাস নাহয় নাই বা থাকল, লেনিনের প্রাসঙ্গিকতা বোধকরি অতীতের তুলনায় আরও বেশিই। সময়টা গোলমেলে আর লড়াইটা কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদী বলেই লেনিনকে চাই।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে বামপন্থী মহলেও রুশ বিপ্লবের ইতিহাস চর্চা বেশ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আর তার সাথে সাথে লেনিনের মহান মতাদর্শগত অবদানও আজ অনেকটাই বিস্মৃত, উপেক্ষিত। এই দৃষ্টিভঙ্গী ভীষণ অনৈতিহাসিক। সমাজতন্ত্র নির্মাণের সমস্ত ফলিত প্রয়োগ ও প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করে শুধু মার্ক্সে ফিরে যাওয়ার অর্থ মার্ক্সকেও খণ্ডিত ও নিষ্প্রাণ বানিয়ে দেওয়া। সত্তর বছরে রুশ বিপ্লবের প্রাণশক্তি কেন নিঃশেষ হয়ে গেল সে ব্যাপারে অবশ্যই অধ্যয়ন ও গবেষণা চলতে থাকবে, কিন্তু সে দায়ভার লেনিনের উপর চাপিয়ে বিপ্লবের প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তা আজকের গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়ের লড়াইকেই ভীষণ ভাবে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
লেনিন ও তাঁর সহযোদ্ধা কমরেডরা যখন রাশিয়ার মাটিতে জারতন্ত্রের জোয়াল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড শুরু করেন তখন তাঁদের কাছে অনুশীলনগত বা ব্যবহারিক উদাহরণ ছিল যথেষ্ট সীমিত। কমিউনিস্ট ঘোষণাপত্র ও পুঁজি থেকে শুরু করে মার্কস-এঙ্গেলসের অনেক রচনাই ততদিনে প্রকাশিত হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু অনুশীলনের ভাণ্ডারে জমা পুঁজি ছিল প্যারিস কমিউন, জার্মানীর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং প্রথম ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সীমিত অভিজ্ঞতা। এখান থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনার এক ধারাবাহিক অভিযান চালিয়েছেন লেনিন, যে অভিযানে তত্ত্ব ও অনুশীলন হাতে হাত রেখে এগিয়ে গেছে। এই অভিযানের যাত্রাপথে আমরা পেয়েছি ১৯০৫ সালের অসফল বিপ্লবী মহড়া, বারো বছর পরে ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারী ও অক্টোবর (পরবর্তী হিসেবে নভেম্বর) মাসে পরপর দুটি সফল বিপ্লবী পটপরিবর্তন, সমাজতন্ত্র নির্মাণের অমূল্য প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতা এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পতাকাতলে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে দিন বদলের লড়াইয়ের উত্তাল ঢেউ।
প্রাক-লেনিন পর্যায়ে কমিউনিজম, বা তার নিকটতর ও প্রাথমিক পর্যায় সমজতন্ত্র, ছিল একটি ঘোষণাপত্র বা ইস্তেহার। এক স্বপ্নের হাতছানি। এক নতুন সমাজের অস্পষ্ট রূপরেখা। লেনিনের জীবদ্দশায় তাঁর তিন দশকের অনুশীলনে এই অস্পষ্ট রূপরেখা স্পষ্ট আকার গ্রহণ করতে শুরু করে। মার্কসের চিন্তাভাবনার সূত্র ধরে এক বিরাট গণউদ্যোগ, গণআলোড়ন দেশে দেশে ইতিহাসের ধারাকে ঘুরিয়ে দিতে থাকে ব্যাপক জনগণ ও তাদের গণতন্ত্রের পক্ষে। তত্ত্ব ও অনুশীলনের এই যুগান্তকারী মেলবন্ধন পরিচিতি অর্জন করে লেনিনবাদ নামে। বস্তুত লেনিনোত্তর পর্বে অনুশীলনমুখী মার্কসবাদের নতুন নাম দাঁড়ায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। কিন্তু লেনিনকে তাঁর জীবনে যেভাবে মার্কসবাদের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা ও অনুশীলনের বিরোধিতা করে তার জীবন্ত ও সৃজনশীল বিকাশের পক্ষে লড়তে হয়েছে, আজ বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরবর্তী পর্যায়ে একইভাবে আমাদেরও লেনিনের তত্ত্ব ও অনুশীলনের জীবন্ত, গতিশীল উপাদান ও বৈশিষ্ট্যের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে।
কমিউনিস্ট ঘোষণাপত্র থেকে সংগঠিত কমিউনিস্ট পার্টিতে উত্তরণের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে লেনিনের ভূমিকা দিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। এই উত্তরণের প্রথম সোপান হল চলমান রাজনীতিতে জনগণের সচেতন ও সংগঠিত হস্তক্ষেপ। লেনিনের প্রথমদিকের রচনা ‘What Is To Be Done?’ বা ‘কী করিতে হইবে’ আজও এই গণরাজনৈতিক উন্মেষের অমূল্য আকর গ্রন্থ। এই রাজনৈতিক চেতনার মূল কথা হল গভীর মানবিক/সামাজিক/গণতান্ত্রিক সম্বেদনা। জারশাসিত রাশিয়ার নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে এই সম্বেদনার মূলে ছিল জারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্খা। কমিউনিস্ট রাজনীতি বা শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতিকে, শ্রমিক আন্দোলন বা আরও নির্দিষ্টভাবে শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ফ্রেমের মধ্যে বোঝা বা আয়ত্ত করার চেষ্টার বিপরীতে লেনিন মূলত এক স্বাধীনতা বা মুক্তি আন্দোলনের ভিত্তিতে, তারই অভিন্ন অঙ্গ হিসেবে পরিভাষিত করেছেন। এই রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো বা ছক নেই। এখানে একজন ছাত্র একজন শ্রমিকের প্রতি সহমর্মিতা থেকে রাজনৈতিকভাবে জেগে উঠতে পারে, একজন পুরুষ শ্রমিক কোনো কৃষক রমণীর মুক্তির ডাকে সাড়া দিতে পারে, একজন বুদ্ধিজীবী বা সংস্কৃতিকর্মী একজন সাধারণ নাগরিকের অধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, পুলিশ বা সৈনিকের সাথে কৃষক ও শ্রমিকের দাবিদাওয়ার আন্দোলন কোনো এক বিন্দুতে এসে সহজেই মিলিত হতে পারে। ‘কী করিতে হইবে’ বইতে লেনিন গণরাজনীতির এমন এক জীবন্ত প্রক্রিয়ার চরিত্রচিত্রণ করেছেন যেখানে কোনো আগে-পরের ‘স্টেজ থিওরি’ বা পর্যায়ক্রমিক তত্ত্ব নেই, চেতনা ও অনুশীলনের বিভিন্ন দিকের মধ্যে নেই কোনো চীনের প্রাচীর। রাজনীতি শেষবিচারে অর্থনীতিরই ঘনীভূত রূপ এই মার্কসবাদী প্রজ্ঞাকে মেনে নিয়েও লেনিনের চোখে রাজনীতি অর্থনীতি থেকে শুরু আর অর্থনীতিতেই শেষ নয়, অর্থনীতির চৌহদ্দির বাইরেও সমাজজীবন ও মানব চেতনার বিস্তীর্ণ পরিসর জুড়ে রাজনীতির ব্যাপ্তি। অর্থবাদের পরিবর্তে লেনিনের অনুশীলনে এই জীবন্ত রাজনীতির অগ্রাধিকার, ঘটনার লেজুড়বৃত্তি ও স্বতঃস্ফূর্ততার উপাসনার বদলে সংগঠিত, সচেতন, পরিকল্পিত হস্তক্ষেপের উপর তার বিশেষ নিরন্তর জোর।
আজ অর্থবাদ ছাড়াও একক ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন বা কোনো নির্দিষ্ট পরিচিতি বা বৈশিষ্ট্য-ভিত্তিক রাজনীতি সামগ্রিক সমাজপরিবর্তনের রাজনীতির পাশাপাশি এক বিকল্প ধারা হিসেবে যথেষ্ট জায়গা করে নিয়েছে। লেনিনের ‘কী করিতে হইবে’ রচনার সূত্র ধরে আমরা যদি এই রাজনৈতিক বিন্যাসকে বোঝার চেষ্টা করি তাহলে আমরা সামগ্রিক বনাম আংশিক বা সাধারণ বনাম নির্দিষ্টের বিতর্কে আটকে যাব না, বরং গণতন্ত্রের ব্যাপ্তি ও গভীরতা এবং সমাজপরিবর্তনের আবেগ ও গতিধারার মাঝে দুয়ের এক জীবন্ত যোগসূত্র খুঁজে পাব। সব রকমের নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ও সাম্যের তাগিদকে যদি উপলব্ধি করা যায় তাহলে শ্রেণীসংগ্রাম একটা গভীর ও ব্যাপক মাত্রা অর্জন করে। লেনিনের কাছে শ্রেণীসংগ্রাম সবসময়ই ব্যাপক ও গভীর, সেই শ্রেণীসংগ্রামের ফলশ্রুতি হিসেবে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের মানেই হচ্ছে প্রকৃত অর্থে সংখ্যাগুরু মানুষের জন্য সার্বিক গণতন্ত্র, মেহনতি জনগণের গণতন্ত্র, বঞ্চিত সমাজের গণতন্ত্র। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক মানুষের জন্য প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকারের এক সমৃদ্ধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। বিংশ শতাব্দীর সেই প্রাথমিক পর্যায়ে গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নেও উন্নত পুঁজিবাদী দেশকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, বৃদ্ধদের অধিকার, সমলৈঙ্গিক ব্যক্তিদের অধিকার – সবদিক থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন ছিল পথপ্রদর্শক। যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ গঠনের প্রশ্নেও এই গণতন্ত্রই ছিল মূল ভিত্তি, জাতিসত্তার অধিকার তাই সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বোচ্চ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, এমনকি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আধিকার হিসেবেও স্বীকৃত হয়েছিল।
ইতিহাসের নির্মম প্রহসনে সত্তর বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় ছবিটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। গণতন্ত্রের অপ্রতুলতা বা গণতন্ত্রহীনতা সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রকে নিষ্প্রাণ, নিরর্থক করে তোলে এবং শেষপর্যন্ত দেশটাই ভেঙ্গে যায়, হারিয়ে যায়। আজ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের তিন দশক পরেও চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে ঠিকই, কিন্তু গণতন্ত্র ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্নে আজকের চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অচলায়তনের চেয়েও এক গুরুতর অবক্ষয়ের প্রতিমূর্তি। সোভিয়েত ইউনিয়নের অতিকায় মহাশক্তিসুলভ সামরিক প্রভুত্ব এবং আধিপত্যবাদী বিদেশনীতিকে এড়িয়ে চলতে চীন হয়তো অনেকটাই সতর্ক, অর্থব্যবস্থার প্রশ্নে বাজার অর্থনীতি ও প্রযুক্তি বিপ্লবকে কাজে লাগানোর প্রশ্নে চীন অনেক বেশি গতিশীল ও যত্নবান, কিন্তু অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রশ্নে চীন গোটা পৃথিবীর কাছে এক চূডান্ত নেতিবাচক দৃষ্টান্ত। একুশ শতকে নতুন করে লেনিনকে পড়ার অর্থ সবার আগে মার্কসবাদের তথা কমিউনিস্ট আন্দোলনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও মর্মবস্তুকে পুনরুদ্ধার করা। বিশেষ করে বিশ্ব পুঁজিবাদ যখন তার দক্ষিণপন্থাকে অনুসরণ করে দেশে দেশে গণতন্ত্র-বিরোধী ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস ও সংকীর্ণতার পথে হাঁটতে শুরু করেছে তখন কল্যাণমূলক অর্থনীতির পাশাপাশি ব্যাপক জনগণের গণতন্ত্র ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্নেও কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে আজ পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে বিকল্প মডেল পেশ করতে হবে, গণনিয়ন্ত্রণ ও অংশগ্রণের গড়তে হবে নতুন নজির। কমিউনিস্ট আন্দোলনের কাছে মার্কস এবং লেনিন এই প্রশ্নেও আলোকবর্তিকা এবং পথপ্রদর্শক।
সংগঠিত বাম রাজনীতি যাঁরা অনুশীলন বা অনুসরণ করেন তাঁদের কাছে লেনিনের বড় পরিচয় কমিউনিস্ট পার্টির এক মহান স্থপতি হিসেবে। কমিউনিস্ট নীতি ও আদর্শকে প্রয়োগ করে কোনো দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণের ভিত্তিতে একটি গতিশীল কর্মসূচী প্রণয়ন করা এবং সেই কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করতে এক সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল পার্টি গড়ে তোলা – বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে এই অভিজ্ঞতার প্রথম উজ্জ্বলতম উদাহরণ আমরা পাই লেনিনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে। পার্টি সংগঠন নির্মাণ ও পরিচালনার প্রামাণ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ছড়িয়ে আছে লেনিনের অধিকাংশ ছোট-বড় লেখায়, বিশেষ করে ‘ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড, টু স্টেপস ব্যাক’ বা ‘এক পা এগিয়ে, দুই পা পিছিয়ে’র মতো কমিউনিস্ট সম্মেলনের ধ্রুপদী ধারাভাষ্যে। কৌশল নির্ধারণের নীতিগত বিতর্কের চমৎকার জীবন্ত দলিল লেনিনের বিখ্যাত রচনা ‘Two Tactics of Social Democracy in Democratic Revolution’ বা ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সমাজগণতন্ত্রের দুই কৌশল’। জার শাসনে রাশিয়ার বাইরে যখন লেনিনকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে তখনও তাঁর তীক্ষ্ণ নজর থাকত রাশিয়ার মাটিতে আন্দোলনের ও রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের উপর। বাদ যেত না বিশ্ব রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক দেশগুলির মুক্তিসংগ্রামের ওঠানামা। সভা-সমাবেশের প্রচারপত্র, সম্মেলনের প্রস্তাব, ঘনিষ্ঠ কমরেডদের উদ্দেশে চিঠি, পুস্তক সমীক্ষা এবং মতাদর্শগত বিতর্ক – লেনিনের বিরাট রচনা ভাণ্ডার তাঁর রাজনৈতিক অনুশীলনের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। লেনিন নিজেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক পাবলিসিস্ট বা প্রচারক হিসেবে বর্ণনা করতেন, (প্রচারক শব্দটি ভারতে সংঘবাহিনীর বর্তমান ফ্যাসিবাদী শাসনের পর্যায়ে যথেষ্ট কালিমালিপ্ত হয়ে উঠলেও আদর্শভিত্তিক গণআন্দোলনের নির্মাণ, সম্প্রসারণ ও পরিচালনায় প্রচারকের ভূমিকার অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করা কঠিন নয়)।
আদর্শ সম্পর্কে নিরন্তর তাত্ত্বিক চর্চা এবং গণঅনুশীলনের কষ্টিপাথরে তাকে পরখ করা ও সমৃদ্ধ করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে বাদ দিয়ে কিন্তু লেনিনের এই সংগঠক ও প্রচারকের ভূমিকাকে বোঝা যাবে না। সংগঠক বা প্রচারকের কাজ কোনো রেডিমেড ছককে ছড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং পুরনো ছক ভেঙ্গে নতুন ছক গড়ার ছন্দসাধনায় সিদ্ধিলাভ করা। পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই লেনিনের অনুশীলন ও অগ্রাধিকারেও আমরা অনেক বাঁক পরিবর্তন দেখতা পাই। লেনিনের অনেক প্রশংসক বা সমালোচকই কিন্তু এই গতি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ও পরিচালনা সম্পর্কে এক তথাকথিত লেনিনীয় মডেল নিয়ে চর্চা করে থাকেন।
লেনিনের সমালোচকদের অনেকের চোখেই লেনিনের তত্ত্ব ও অনুশীলন জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবীর এক অবাস্তব প্রকল্প। অর্থনীতিবাদ বা অভিজ্ঞতাবাদের গণ্ডীর বাইরে কমিউনিস্ট চেতনার উন্মেষের লেনিনীয় সূত্রের এ এক চূড়ান্ত অপব্যাখ্যা। শ্রমিকশ্রেণীর উপর বুদ্ধিজীবী বর্গের নেতৃত্ব নয়, শ্রমজীবী মানুষের বিপ্লবী শ্রেণীচেতনার নির্মাণ ও বিকাশের প্রক্রিয়াতে বিভিন্ন পৃষ্ঠভূমি থেকে আসা ব্যক্তির মতাদর্শগত মিলনের সম্ভাবনা ও প্রয়োজনের উপর ছিল লেনিনের জোর। সর্বহারা শ্রেণীর অগ্রবাহিনীর পার্টি গঠনের অর্থ ব্যাপক জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে উপর থেকে বা বাইরে থেকে কোনো নেতৃত্বকারী চক্র গড়ে তোলা নয়, শৌখিন বিপ্লবীয়ানার বিপরীতে কঠিন কষ্টসাধ্য নিয়মিত অনুশীলনের উপর জোর দিয়েই লেনিন রাজনৈতিক পেশাদারিত্বের ধারণা তুলে ধরেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ছোট ছোট পাঠচক্র, বিভিন্ন কারখানার বা মহল্লার শ্রমজীবী জনগণের স্থানীয় বিক্ষোভ ও সংগ্রামের মধ্যে গভীর যোগসূত্র ও ব্যাপক সমন্বয়ের সম্ভাবনা ও তাগিদ ছিল লেনিনের অনুশীলনের মূল কথা আর এভাবেই বলশেভিক পার্টি দ্রুত এক বিশাল গণচরিত্র অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।
পার্টি ঐক্য এবং শৃঙ্খলার প্রশ্নেও লেনিনের অনুশীলনে এক দীর্ঘ যাত্রা আমরা দেখতে পাই। পার্টি গঠনের শুরুর পর্যায়ে আরএসডিএলপি বা রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি (কমিউনিস্ট পার্টির প্রাকবিপ্লবী পর্যায়) ছিল বিভিন্ন গোষ্ঠীর এক খোলা সমন্বয় যেখানে বিভিন্ন প্রশ্নে প্রকাশ্য তীব্র বিতর্কের মধ্য দিয়েই পার্টির নীতি ও অবস্থান নির্ধারিত হত। বিতর্কসভার এই পরিবেশের মধ্য দিয়েই পরবর্তীতে গড়ে উঠেছিল লৌহদৃঢ় ঐক্য ও শৃঙ্খলা, যে ঐক্য ও শৃঙ্খলা ছাড়া যুদ্ধে টিকে থাকা ও জয়লাভ করা কখনোই সম্ভব নয়। বিতর্কের মধ্য দিয়ে ঐক্যের এই জটিল প্রেক্ষাপট ও জীবন্ত প্রক্রিয়াকে বাদ দিয়ে লেনিনীয় অবধারণা ও অনুশীলনকে মনে হবে হয় বুদ্ধিজীবীসুলভ বিতর্ক ও তাত্ত্বিক কচকচি অথবা শৃঙ্খলার নাগপাশে বিতর্কের কণ্ঠরোধ।
শোষণবিহীন সমাজের মুক্তিকামী স্বপ্ন ও সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে নিরলস গতিময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কমিউনিস্ট অনুশীলন – লেনিনকে ফিরে দেখার অর্থ এই দুটি বিষয়ের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়া। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শাসকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষার যুদ্ধকে জনগণের ক্ষমতা দখলের বিপ্লবীযুদ্ধে রূপান্তরিত করার যে নির্দিষ্ট ও সফল উদাহরণ গত শতাব্দীর গোড়ার পর্বে রাশিয়াতে আমরা দেখেছি তার হয়তো একইভাবে আর কোথাও পুনরাবৃত্তি হবে না। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির যে অধ্যয়ন লেনিন করেছিলেন আজ দানবীয় বিত্তীয় পুঁজি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে তার অবশ্যই নতুন সংস্করণের প্রয়োজন। কিন্তু রুশ বিপ্লবকে যাঁরা গণতন্ত্রহীনতার পর্যায়ে এক প্রাক-আধুনিক সমাজ থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের উদাহরণ হিসেবেই শুধু দেখতে অভ্যস্ত এবং যাঁদের মনে হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পরিপক্কতা ও বিচক্ষণতা সেই পরিপ্রেক্ষিতটাই বদলে দিয়েছে আজ তাঁদেরও নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে।
লেনিন সাম্রাজ্যবাদকে মরণাসন্ন পুঁজিবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। গত একশ বছরে পুঁজিবাদ সেই সংকটকে বারবার অবশ্যই কাটিয়ে উঠেছে। তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতন এবং প্রাক-পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিক বিশ্বে উপনিবেশবাদের পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব পুঁজিবাদের ভৌগোলিক ব্যপ্তিও আজ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি প্রকট। কিন্তু পুঁজিবাদের প্রশ্নাতীত ব্যাপকতা ও গভীরতাই তার সংকটকেও আরও ব্যাপক ও গভীর করে তুলেছে। বিশ্বায়ন ও বাজারিকরণের আগ্রাসী নীতি দেশে দেশে জন্ম দিয়েছে এক নতুন অস্থিরতার। আর ভারসাম্যহীনতা ও অস্থিরতার এই নতুন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের আপাত পরিপক্ক ও বিচক্ষণ ব্যবস্থা আজ প্রায় দুনিয়াজোড়া সংকটের মুখে। উগ্র দক্ষিণপন্থা ও ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন আজ বিশ্বব্যাপী। প্রযুক্তি বিপ্লব একদিকে মানুষের জ্ঞান ও চেতনাকে প্রসারিত করেছে, প্রশস্ত হয়েছে মানবাধিকারের ও গণতন্ত্রের ধারণা, রাষ্ট্রের সীমানা ও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের নিশ্ছিদ্র কাঠামোর বাইরে ব্যাপক মানুষের সহঅস্তিত্ব ও সহযোগিতার সম্ভাবনা ক্রমেই বেশি বেশি করে নজরে আসছে, অন্যদিকে একই প্রযুক্তি রাষ্ট্রের হাতেও তুলে দিয়েছে দানবীয় ক্ষমতা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যে ঘোষিত নীতির ভিত্তিতে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সৌধ-রচনা হয়েছিল সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আজ পাহারাদার রাষ্ট্রের দাপটের কাছে অসহায় শিশু। এর সাথে পরিবেশের বিপন্নতা ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত অনিশ্চয়তাকে জুড়ে দিলে আমরা পাব বিশ্বপুঁজিবাদের এক অভূতপূর্ব সংকটের চালচিত্র। এমনই এক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে লেনিন রুশ বিপ্লব ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের মাধ্যমে এক বিকল্প তুলে ধরেছিলেন। রোজা বলেছিলেন সমাজতন্ত্র অথবা বর্বরতা দুয়ের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে। এই পরিস্থিতি আজ পোড়খাওয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেও নতুন করে সমাজতন্ত্রের প্রশ্ন তুলে ধরছে। বার্ণি স্যান্ডার্স বা জেরেমি করবিনের নির্বাচনী প্রচারের কথা আজ থেকে ত্রিশ, বিশ বা দশ বছর আগেও ভাবা যেত না, কিন্তু আজ পরিস্থিতি তাকে সম্ভব করে তুলেছে। পুঁজিবাদের গভীর সংকট ও বিকল্পের হাতছানির এই বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ছক ভাঙার সিদ্ধহস্ত কারগর। ‘কী করিতে হইবে’ বই হাতে যিনি আজও পাঠকদের ভাবান, পথে নামান।
(স্বরান্তর, জানুয়ারি ২০২০ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত)