বিদায় কমরেড যূথিকা সাহা রায়

রক্ত পলাশ তাঁর প্রাণের ফুল। গান ও কবিতা তাঁর প্রথম প্রেম। চলতে চলতে হাতে তুলে নেওয়া লাল পতাকা। তারপর থেকে মুক্তিকামী মানুষের প্রতিটি সংগ্রামে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ, একাত্মতা। বাংলাদেশে থাকাকালীন ভাষা আন্দোলনের শরিক হওয়া ও মুক্তি যুদ্ধের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তাঁকে লড়তে শক্তি দিয়েছে। ভালোবাসা ছিল তাঁর ধর্ম। গভীর প্রেমে পড়ে দরিদ্র পরিবারের ছেলে নীতীশের সাথে ভেসে পড়েন মানুষকে মুক্তির গান শোনাতে। তাঁদের হাত ধরেই নবদ্বীপ অঞ্চলে সাংস্কৃতিক দল তৈরি হয়। তারপরটা ইতিহাস। মহিলা সংগঠন, প্রতিবিধান পত্রিকা, সাংস্কৃতিক সংগঠন, কৃষক সংগঠন, পার্টির কাজ, বা তার বাইরেও ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। সন্তান হারানোর বিষাদসহ হাঁটুতে আর্থ্রাইটিস, উচ্চ রক্তচাপ, সবশেষে কর্কট রোগ এবং বারংবার অপরেশন ও জটিলতা -- এতসব সত্ত্বেও সংগঠন থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হননি। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বত্র। লড়াই কি করে করতে হয় তা জানতেন যূূূথিকা। অসুখের জন্য শেষের দিকে সরাসরি কাজ না করলেও সর্বত্র মিছিলে অনুুুষ্ঠানে তার নীরব উপস্থিতি ছিল। মুখে হাসিরও কোনো অভাব ছিল না। নিজের কথা নয়, অন্যদের খবর তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্যদের ছেলেমেয়েদের সহজাত মায়ায় জড়িয়ে নিতেন। এই প্রজন্মের তরুণরা তাঁর কাছে ছিল “বাবুসোনা”। তাদের জন্মদিনও পালন করতেন সামান্য আয়োজনে।

এরকমই সব কথা একের পর এক উঠে আসছিল সবার কথায়। সেদিন, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২০, তাঁর স্মরণসভায়। আয়োজক ছিল পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ। উল্লেখ্য, গত ১২ ফেব্রুয়ারী, বিকেল ৪টে ৪০ মিনিটে কলকাতার বাসভবনে তিনি প্রয়াত হন। কমরেড যূথিকা সাহা রায়ের ছবিতে মালা ও লাল গোলাপ দিয়ে সম্মান জানিয়ে সভা শুরু হয়। এরপর বজবজের ‘চলার পথে’র শিল্পী অভিজিৎ মন্ডল গান পরিবেশন করেন। প্রয়াত কমরেডের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। তাঁর নামে একটি স্মরণিকা রচিত হয়েছে, ‘আছো তুমি হৃদয় জুড়ে’। এটির উন্মোচন করেন, বিশিষ্ট গণসংগীত শিল্পী শ্রী বিপুল চক্রবর্তী। সভায় তাঁর বন্ধুবান্ধব আত্মীয়পরিজন, পরিষদের সমস্ত সংগঠন ও তার রাজনৈতিক পার্টি সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বহু কমরেড উপস্থিত ছিলেন।

সভায় তাঁকে স্মরণ করেন, পরিষদের সভাপতি ও বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্তী, গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের সম্পাদক শ্রী রজত বন্দোপাধ্যায়, নবদ্বীপেের ‘অন্যকোন’ পত্রিকার কর্ণধার শ্রী তপন ভট্টাচার্য, শ্রী বিপুল চক্রবর্তী, মহিলা সমিতির কল্যাণী গোস্বামী, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, পারিবারিক বন্ধু গায়ক লেখক বনানি দাস, আত্মীয় শ্রী অরূপ চট্টোপাধ্যায়, ক্যান্সার আক্রান্তদের সাহায্য করা সংগঠন ‘অঙ্কলীন’-এর শ্রী অরূপ মুখার্জি, কাণ্ডীর-এর মৌসুমি মান্না, ‘পথসেনা’-র শ্রী জয়গোপাল দে, পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, পার্টির রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ, বরিষ্ঠ নেত্রী মীনা পাল, অমিত দাশগুপ্ত, নব্যেন্দু দাশগুপ্ত, বিমল দেব, তুষার চক্রবর্তী, অসীম গিরি ও অন্যান্যরা। কল্যাণী গোস্বামী, সরিৎ চক্রবর্তী, বিশ্বরূপ সাহা, বাবুনি মজুমদারের গান, শোভনা নাথের কবিতা পাঠ ও গোবিন্দ দে এবং অনুপ হালদারের যন্ত্রসঙ্গীতের মূর্ছনা সভাকে বিষন্ন ও দায়িত্বশীল করে তোলে। সবশেষে পরিষদের রাজ্য সম্পাদক ও গণসঙ্গীত শিল্পী নীতীশ রায় তার কমরেড স্ত্রী যূথিকার স্মৃতিচারণা করেন। সামগ্রিক বিপদের দীর্ঘ লড়াইয়ের পথে যারা বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের কৃতজ্ঞতা জানান। অসীম দুঃখের মধ্যেও তিনি যখন গেয়ে ওঠেন “অন্তরের অন্তরায়, আমার কলিজায়, অন্তরের অন্তরা তুমি”, সভার অনেকেই তখন বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে ওঠেন। একজন প্রকৃত মানুষকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলার দুঃখ ও তার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব উপলব্ধি করার মধ্যে দিয়ে সভা সমাপ্ত হয়। সমগ্র সভাটি সঞ্চালনা করেন পরিষদের দুই সহ সভাপতি বর্ণালী রায় ও সাগর চট্টোপাধ্যায়।

খণ্ড-27
সংখ্যা-5