সুপ্রীম কোর্টের এক বিচারপতি দেশের হালচাল প্রসঙ্গে বললেন, “বিরোধিতাই গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ।” শুধু এটুকু বলেননি। আরও কিছু মূল্যবান কথা স্মরণ করিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুর কন্ঠরোধ করা যায় না। বরং সব পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত করা উচিত। ... ভারতীয় সংবিধানের উদার প্রতিশ্রুতির মধ্যেই বহুত্ববাদকে সম্মান করার কথা বলা আছে। ... বাক স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেওয়াই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাজ হওয়া উচিত। ... আমাদের সংবিধান প্রণেতারা হিন্দু বা মুসলিম ভারতের ভাবনাকে স্বীকার করেননি। স্বীকৃতি দিয়েছিলেন কেবল প্রজাতান্ত্রিক ভারতের ভাবনাকে। ... আমাদের সংবিধানে বলা আছে আইনের শাসনের কথা, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের কথা নয়।” এইসব মন্তব্য করেছেন বিচারপতি ওয়াই এস চন্দ্রচূড়। খোদ গুজরাটে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তাঁর ভাষণে উঠে এসেছে কথাগুলো।
তার দুদিন আগে বম্বে হাইকোর্টও রায় দেয়, কোনো আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেই ‘দেশবিরোধী’ তকমা দেওয়া যায় না। ঘটনা হল, বিজেপি সরকার যখন তখন যেখানে সেখানে তকমা লাগিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে গ্রেপ্তারি চালাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকারের জনবিরোধী আচরণের বিরুদ্ধে ফেটে পড়া আন্দোলনে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হওয়ার বাহানা তুলে ধৃতদের থেকে জরিমানা আদায়ের পন্থা নেওয়া হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের ভীতসন্ত্রস্ত করতে এভাবে সরকারি সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রশ্নে সবচেয়ে খতরনাক উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার। সরকার জবরদস্তি যোগী ‘ক্ষতিপূরণ’ আদায়ের যে নোটিশ পাঠাতে শুরু করে, তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা গড়ায় সুপ্রীম কোর্টে। সর্বোচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ পাল্টা কৈফিয়ত চেয়ে নোটিশ পাঠিয়েছে। বল এখন যোগী সরকারের কোর্টে।
বম্বে হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্টের তৎপর ভূমিকা অবশ্যই ইতিবাচক। এহেন অবস্থান সাহসী নীতি-নৈতিকতার পরিচয় দেয়, অন্যায়-অবিচার চাপিয়ে দেওয়া তথা পরোক্ষে বিচারব্যবস্থাকেও গ্রাস করতে বেপরোয়া হওয়ার বিরুদ্ধে এক বার্তা দেয়।
সরব হয়েছেন দিল্লী হাইকোর্টের এক প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এ পি শাহ। একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি নির্ভীক মুখ খুললেন। প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন শীর্ষ আদালতের সাম্প্রতিক দেওয়া কয়েকটি রায়ের। উন্মোচন করলেন সেসবের প্রকৃত স্বরূপ। তিনি উল্লেখ করেছেন কাশ্মীর, অযোধ্যা, এনআরসি, সিএএ সংক্রান্ত মামলায় যে রায় দেওয়া হয়েছে সবই চূড়ান্ত পক্ষপাতদুষ্ট। একটা নির্দিষ্ট আগ্রাসী প্রবণতাকে তুষ্ট করে চলতে। আর সেটা হল সাম্প্রদায়িক গরিষ্ঠতাবাদী প্রবণতা। তাছাড়া সমকামিতার অধিকারকে যে মান্যতার রায় দেওয়া হয় তার বয়ানে প্রকাশ পেয়েছে প্রবল অস্বস্তি, যেন অধিকার দিতে না চাইলেও দিতে বাধ্য হতে হয়েছে। আর, রাফায়েল মামলায় আাদালতের রায় তো অবাক কাণ্ড, মোদী সরকারের কোনো দোষ খুঁজে পায়নি! বিচারপতি শাহ মনে করেন, গেরুয়া শাসকদের অনুসৃত সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা মারাত্মক। গোটা দেশকে এনে ফেলেছে এক ধ্বংসাত্মক মেরুকরণের আবহে। ঘৃণায় ও বিদ্বেষে বিভাজিত করাকে স্বাভাবিক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলছে। তার জন্য বিছানো হচ্ছে নানা যুক্তিজাল। চলছে ধর্মকেন্দ্রীক রাজনীতি ও সংস্কৃতিসর্বস্ব জাতিয়তাবাদের নামে উন্মত্ততা। এর বিরোধিতা করলে দমিয়ে দিতে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘দেশবিরোধী’! পাশাপাশি চলে বিচারে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে জঘন্য রকমের বৈষম্য। যে মামলায় মোদী সরকার অনুকূল রায়ের জন্য মুখিয়ে, যেমন এনআরসি, সেখানে রায় প্রকাশ করেছে দ্রুত। আর যে মামলাগুলো মোদী সরকার বা বিজেপির পক্ষে অস্বস্তিকর সেগুলো পড়ে থাকে স্তুপীকৃত হয়ে। যেমন, নারী ধর্ষণের অগুন্তি মামলা, রাষ্ট্রীয় রোষের শিকার হওয়া মানবাধিকারের বিচার, বিশেষত কাশ্মীর-বস্তারের পরিস্থিতিতে ক্ষতবিক্ষত মানবাধিকারের বিচার—এহেন হাজারো ন্যায়বিচারের বিষয়গুলো অগ্রাধিকারের মুখ দেখে না। ‘জাস্টিস ডিলেইড হয় ডিনায়েড’ হয়। বিচারপতিদের কনফারেন্সেও এইসব আলোচনা-পর্যালোচনা ওঠে না। চলে দ্বিচারিতা। তার নমুনা দেখিয়েছেন সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। তিনি মোদী আমলের প্রথম পর্বে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কয়েকজন বিচারপতির সম্মিলিত ‘বিদ্রোহে’। তখন প্রধান বিচারপতির আসনে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অনুগত দীপক মিশ্র। প্রতিবাদের ইস্যু ছিল, কেবলমাত্র একজন নির্দিষ্ট বিচারপতির কাছে বেছে বেছে কিছু বিশেষ বিশেষ মামলা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে কেন। তার জবাব চাইতে প্রতিবাদী বিচারকরা সাংবাদিক সম্মেলন পর্যন্ত করেছিলেন। অনতিবিলম্বে সমঝোতায় তখনকার মতো বিবাদ চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। সেই গগৈ সাহেব অবসরগ্রহণের আগে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীদের পুষিয়ে দিয়ে গেলেন এনআরসি-র আদেশনামা জারী করে। তাঁর পূর্বসূরী দীপক মিশ্র ছিলেন অযোধ্যা রায় দেওয়ার ডিভিশন বেঞ্চের শীর্ষস্থানীয়। এ সবই হল মোদী জমানায় সর্বোচ্চ স্তরে বিচারবিভাগীয় প্রহসনের কিছু কিছু নির্দিষ্ট প্রকাশ। সুপ্রীম কোর্টে প্রধানত এটাই এখন চলতি হাওয়া। এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তবু সরব হচ্ছেন ভেতর ও বাইরে থেকে ব্যতিক্রমী কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা। এদের ভূমিকা অবশ্যই প্রতিস্পর্ধী।
অন্যদিকে মিলছে চাটুকার সংস্কৃতির মুখ। যেমন সুপ্রীম কোর্টে ওপর থেকে তিন নম্বরে থাকা বিচারপতি অরুণ মিশ্র। ইনি একসময় ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। তারপরে পদন্নোতি হয় সুপ্রীম কোর্টে। দীপক মিশ্র প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন যে বিচারপতির ঘরে বিশেষ বিশেষ কেস ঢুকত তিনিই অরুণ মিশ্র। সেই তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভারত সফরের প্রাক মুহূর্তে নতুন করে মোদী কীর্তনে গদগদ হলেন। এই মনোভাবের তীব্র নিন্দা করেছে বার এ্যাসোসিয়েশন অব ইণ্ডিয়া ও সুপ্রীম কোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশন। মোদী জমানার ফ্যাসিবাদী বীভৎসতা তার প্রথম পর্বে যে পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছিল, সেখান থেকেই আরও বাড়তে থাকে তার পরবর্তী বিধ্বংসী দাপাদাপি। সংসদ, প্রশাসন, আইনকানুন ও বিচারসভা—সব ক্ষেত্রেই আধিপত্য কায়েমের দখল অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা। প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ-প্রশাসন-শাসকদল বিজেপি ও সংঘ শাখাগুলোর যোগসাজশে চালানো সন্ত্রাস, প্রকাশ্যে দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে মারা, আগুন লাগানো, ধর্ষণ-গণধর্ষণ করেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর বিরুদ্ধে। কি করে এসব চলতে পারে? সংসদে একাধিক ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্ত সদস্যের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বিজেপির, ১১৬ জন। এদের বিচার ও শাস্তি হয় না। বিচারবিভাগকে ঠিক এতটাই কুক্ষিগত করে ফেলা হয়েছে। বিচারবিভাগ যেখানে সাংবিধানিক আধারের অঙ্গ, সেখানে নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত, এমনকি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারের নিরপেক্ষতা-স্বাধীনতা নিয়ে বারেবারে উঠেছে প্রশ্ন। চাপানো হচ্ছে একটার পর একটা কালাকানুন—ইউএপিএ, এনএসএ, পিএসএ!!! রাজত্ব চালানো হচ্ছে কালা কানুন আর বিনাবিচারে কারান্তরিত করে রাখার। তার জন্য সংসদে পর্যন্ত কানে তোলা হয়না জবাবদিহি করার দাবি। তুলে দেওয়া হচ্ছে শ্রম আইনগত মৌলিক অধিকারগুলোকে। উল্টে দেওয়ার পাল্টে দেওয়ার চক্রান্ত শুরু হয়েছে সংবিধানের গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্রকে। ‘আজাদী’ বা ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শুনলেই দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘দেশদ্রোহী’! বিপরীতে অবাধ ‘লাইসেন্স’ পাচ্ছে ‘জয় শ্রীরাম’ হুঙ্কার ছাড়া খুনে বাহিনী। আন্দোলনকারীদের ফাটকে পুরে জরিমানা করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকার। বিপরীতে গেরুয়াপন্থীরা নৃশংস অপরাধ করেও পেয়ে যাচ্ছে বেকসুর খালাস। শাসকদের উন্মত্ত বাহিনীর হিংসার তাণ্ডব সংঘটিত হতে দেখেও পুলিশ-প্রশাসন নিস্পৃহ থাকে কি করে—এই প্রশ্ন তোলার ‘পুরস্কার’ হিসাবে রাত না পোহাতেই কলেজিয়ামকে দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হল বদলির নোটিশ। মোদী জমানায় এমনকি আজ সবচেয়ে বড় আক্রমণটা নামানো হয়েছে নাগরিকত্বের অধিকারের ওপর, যার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে, অথচ শুনানীর ক্রমশ যাচ্ছে পিছিয়ে!
এত সর্বনাশা পরিস্থিতি তৈরি হওয়া সত্বেও যে আইন বিশারদ ও বিচারকরা কেবল নাগরিক সমাজকে শিক্ষা নেওয়ার পন্ডিতী দেখান আর মোদী মাহাত্ম বন্দনায় বিগলিত হন, তারা আসলে কেনা গোলাম বনে গেছেন, ‘উন্নতি’র সিঁড়ি বানাচ্ছেন তাঁবেদারি করাকে। রাষ্ট্রশক্তির অন্য সব অঙ্গের মতো বিচারব্যবস্থার দখল নিতে ফ্যাসিবাদীরা মরীয়া হয়, যাবতীয় অন্যায় অবিচারের ওপর ‘বৈধ’ শীলমোহর লাগাতে। মোদী জমানায় প্রায়শই এই বহিঃপ্রকাশগুলো ঘটছে। তবে পরিত্রাণ পাচ্ছে না একেবারে বিনা প্রতিবাদে। বিচার ব্যবস্থায় প্রতিফলন ঘটছে অনুরণ উঠছে সংঘাতের।