সকাল থেকেই বৃষ্টি। তাতে কি! তাঁবুর নীচে চারদিক খোলা সিনেমা হল হাউসফুল। স্থান বর্ধমান জেলার ফলেয়া মেড়তলা চণ্ডীপুর গ্রাম। একাদশতম সৃজন উৎসবের সেটা তৃতীয়দিন তথা শেষদিন। উদ্যোক্তা পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ। তিনদিনব্যাপী এই উৎসব চলে ২৪ থেকে ২৬ ডিসেম্বর অবধি। এবারের শ্লোগান ছিলো, “ধর্ম নিয়ে বিভেদ ছাড়ো, এনআরসি বাতিল করো/ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সৃজনশীল প্রতিরোধের সংস্কৃতি গড়ে তোলো”। সৃজন উৎসবের মজায় অভ্যস্ত চণ্ডীপুরের মানুষই অনেকরকম দায়িত্ব নিয়ে এবার আমাদের ডাক পাঠিয়েছিলেন।
২৪ ডিসেম্বর দুপুরের আগেই পৌঁছে যাই। দেখি বাড়ির দেওয়ালগুলোতে কচিকাঁচারা ছবি আঁকছে রঙ দিয়ে। রঙ তুলি এবং উৎসাহ জুগিয়েছে তাদের প্রিয় আকাশদা। ওদিকে রিকশায় স্টোভ চাপিয়ে দোকানিরা হাজির। সন্ধেবেলা নাকি এগরোল চাউমিন ইত্যাদি হবে। আমাদের সভাপতি দেবাশীষ চক্রবর্তী ও বাউল ফকির সংঘের সভাপতি শ্রদ্ধেয় শক্তিনাথ ঝা মহাশয়ও সকাল সকাল উপস্থিত। উপস্থিত কাণ্ডীর, অশোকনগর ও মধ্যমগ্রাম শাখাও। প্যান্ডেলে শোভা পাচ্ছে এনআরসি নিয়ে ছবির প্রদর্শন। অন্যদিকে বাচ্চারা তাদের চটজলদি আঁকা ছবি ঝুলিয়ে দিয়েছে। মাইকে বাজছে মনাদা(প্রবীর বল)-র গান, “আমি মানুষ, আমার নেই কোনো জাত।”
সকালে মুড়ি ঘুগনি আর দুপুরে ডাল সব্জি মাছের ঝোলে ভরপেট হয়ে মিছিল শুরু হল। অসাধারণ গায়কিতে গান ধরল বাবুনি। দেবাশীষদা, শ্রী শক্তিনাথ ঝা, বাউল লালু ফকির মিছিলে সামিল হলেন। গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে বাঁশগাছের নিচে দিয়ে ছোটো পুকুরের পাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে মিছিল এগোলো। গ্রামে সিপিআই(এমএল) নেতা কমরেড সুবোধ মজুমদারের শহীদ বেদীতে আমদের সাথে গ্রামের মহিলা পুরুষ শিশু সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন।
এর পরই মূল মঞ্চে উৎসবের উদ্বোধনী ভাষণ রাখলেন সংগঠনের সভাপতি শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্তী। সংক্ষিপ্ত ভাষণ রাখলেন মাননীয় শক্তিনাথ ঝা ও এলাকার সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতা বিনয় মণ্ডল। এরপর হালিশহর সাংস্কৃতিক সংস্থার নিবেদন নতুন কবিতা ও গানের কোলাজ। সুবিখ্যাত নাট্যকার পরিচালক ও অভিনেতা শ্রী তীর্থংকর চন্দ’র নাট্যদল আবহমানের “অন্ধ খোঁড়ার গল্প” ও কাণ্ডীর-এর কচিকাঁচাদের নাটক “লক্ষ্মণের শক্তিশেল” পরিবেশিত হল। পাশের সিমলা গ্রামের মহরম কমিটির শিল্পীদের ‘লাঠিখেলা’র পর মুর্শিদাবাদের বাউল লালু ফকির ও বোলপুরের বাউল বিক্রম ইয়াসিন শেখ বাউলগানে মঞ্চ মাতিয়ে দিলেন।
২৫ ডিসেম্বর। সকাল ১০টায় প্রথম অধিবেশনে ঘরোয়া আলোচনা। বিষয়, “প্রতিরোধের সংস্কৃতি”। অংশগ্রহণ করলেন সিতাংশু চক্রবর্তী, সুনীতা, কার্তিক পাল, নীলাশিস বোস, বর্ণালী রায়, সুব্রত সেনগুপ্ত, প্রিয়গোপাল বিশ্বাস। আলোচনা শেষে নাট্য আন্দোলনের সৈনিক অঙ্কুর, একক নাটক পরিবেশন করেন, নাম ‘মধুসূদন দাদা’। এই দ্বিতীয়দিনে সরকারি পরিভাষায় বললে ‘রেকর্ড ভীড়’ হয়ে যায়। দুপুরে সেদিন আবার মাংস ভাত। ভীড়ের মধ্যে বালির সংযোগের মাধবদাকে আবিষ্কার করি। সন্ধ্যের অনুষ্ঠানেও ঠাসা সূচি। শুরুতেই নাদনঘাটের ‘মারাংবুড়ু’ দলের আদিবাসী নৃত্য মাৎ করে দেয়। এদিন চারটি নাটক পরিবেশিত হয়। ‘অনুরঞ্জন’-এর নাটক, সংযোগের ‘গফুর জোলার গল্প’, কাণ্ডীরের ‘গুপ্তধন’, অন্যমনের ‘আল্লা ও ঈশ্বরের ঝগড়া’। কিছু নতুন সৃজনসহ সঙ্গীত পরিবেশন করেন নৈহাটির অগ্নিবীণা, চম্পা চক্রবর্তী, সুব্রত ভট্টাচার্য , বাবুনি মজুমদার, বিশ্বরূপ, বজবজের চলার পথে, বাবলু হালদার এবং যৌথ কন্ঠে বাবুনি বিশ্বরূপ ও নীতীশ রায়। কবিতা পাঠ করেন সুনীতা ও বর্ণালী রায়।
২৬ ডিসেম্বর। সকাল থেকেই বৃষ্টি। দুপুর ৩টে থেকে আলোচনা সভা। বিষয়, সাম্প্রতিক জাতীয় নাগরিকত্ব বিতর্কটির বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা, যা আসলে এই গ্রামের মানুষরাই জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, লোক হবে তো! গ্রামবাসীরা বললেন, “মাইকে একবার ফু দিয়ে দেখেন না কি হয়!।” মাইক হাতে গেয়ে উঠলেন শান্তনু ভট্টাচার্য “আমার প্রতিবাদের ভাষা ...।” বাচ্চারা ছুটে এল। গান ধরলেন নীতীশ রায়, “হোক আলোড়ন ...” বাচ্চা কোলে মহিলারা এলেন । তাঁবুর নিচে চেয়ার ভরে উঠতে লাগল। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মলয় কান্তি দে নাগরিকত্বের নয়া ফরমানের ঐতিহাসিক দিকটি নিয়ে বললেন। সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায় এনপিআর-এর প্রোফর্মা ধরে গ্রামবাসীদের সতর্ক করলেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কার্তিক পাল তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে কি করতে হবে তা জানালেন।
এরপরই ‘প্রতিরোধের সিনেমা’ প্রদর্শন। আয়োজনে মিতালি বিশ্বাস। সন্ধ্যেবেলায় বৃষ্টি মাথায় করে উপচে পড়ল ভীড়। গৌতম ঘোষের ‘দখল’ ও আরও দুটি সিনেমা চলল। তার সাথে মিশে গেলো গরম গরম ঘুগনি, জিলিপি, এগরোল, চপের গন্ধ। বিষন্নতাও কখন যেন বিস্তৃত হয়েছে। এবার যে তাঁবু খোলার পালা! এ কদিন একসাথে কেমন বেঁধে বেঁধে ছিলাম। কত দল কত মানুষ তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে পরষ্পরের বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। উৎসব বুঝি একেই বলে!
এবারের সৃজন উৎসব ছিলো সৃজনে ভরপুর। সেমিনার ধর্মি আলোচনায় রাজনৈতিক মতামতও সৃষ্টি হয়েছে। আবার নতুন সংযোজনা প্রতিরোধের সিনেমাও নতুন উত্তেজনা ছড়িয়েছে। গ্রামের মানুষ তিনদিনেরই খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন বললে কম বলা হবে। দিনে চারবার চার রকম খাবার প্রস্তুত করা ও হাসিমুখে পরিবেশন করাটা কি কম বড় কথা! সংগঠনের দীর্ঘদিনের বন্ধু প্যান্ডেল-লাইট-মাইক-লেপ-তোষোক প্রায় বিনা ভাড়াতেই সরবরাহ করেছেন। এছাড়াও সমস্ত আয়োজনের তত্ত্বাবধান করেছেন সজলদা (পাল), বিশ্বাসদা ও অশোকদা (চৌধুরী)। সমীর বসাক, তিনকড়ি, সন্দীপ, শিবু ইত্যাদিরাও নানানভাবে সহযোগিতা করেছেন। পরিষদের তরফে সাগর চ্যাটার্জি, অরিন্দম সেনগুপ্ত ও আকাশ চ্যাটার্জিও ছিলেন তাদের একশ ভাগ নিয়ে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত পরিশীলিতভাবে সঞ্চালনা করেছেন পরিষদের সম্পাদক নীতীশ রায়। এবারের এই সুবৃহৎ অনুষ্ঠানটি ছিলো অত্যন্ত পরিপাটি। সবমিলিয়ে ‘সাকসেসফুল প্রোগ্রাম’।
- অশনি সাংকৃত্যায়ন