(৩০ ডিসেম্বর ছিল মৃণাল সেনের প্রয়াণ দিবস। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই লেখাটি আমরা প্রকাশ করছি।)
মৃণাল সেনের জন্ম ১৯২৩ সালের ১৪ মে, ওপার বাংলায়। কৈশোর কাটিয়ে চলে আসেন কোলকাতায়। স্কটিশ চার্চ কলেজ ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশুনো করেন পদার্থবিদ্যা নিয়ে। বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে থেকেছেন সেই সময় থেকেই, অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না।
চলচ্চিত্র নির্মাণ পর্বের আগে চলচ্চিত্র নিয়ে তাত্ত্বিক পড়াশুনো ও লেখালেখি শুরু করেছিলেন মৃণাল সেন। রুডলফ আর্নহেইমের ফিল্ম এসথেটিকস, নীলসনের সিনেমা অ্যাজ এ গ্রাফিক আর্ট এর মতো বই তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। নিয়মিত সিনেমা দেখতেন ফিম সোসাইটিতে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ধারাকে এর মধ্যে দিয়ে তিনি আত্মীকরণ করেন। তবে তাঁর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব সম্ভবত ছিল ষাটের দশকে ফরাসী সিনেমার নিউ ওয়েভ ধারার। মনে রাখতে হবে সত্যজিতের সিনেমার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল চল্লিশের দশকের নিও রিয়ালিজমের। নিউ ওয়েভ তার দুদশক পরের সিনেমা আন্দোলন।
মৃণাল সেনের প্রথম দিককার সিনেমায় আখ্যানের সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, পরে সেখান থেকে তিনি সচেতনভাবেই খানিকটা সরে আসেন। জঁ লুক গোদারের সিনেমার মতই মৃণাল সেনের সত্তর দশকে নির্মিত বিখ্যাত সিনেমাগুলিতে ন্যারেটিভের ভাঙচুর আমরা দেখতে পাই। সত্তরের উতরোল দিনগুলির সঙ্গে এই চলচ্চিত্র টেকনিক চমৎকার খাপ খেয়েছিল। বস্তুতপক্ষে মৃণাল সেনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল সরাসরি পলিটিক্যাল সিনেমা বানানোর ঋজু সাহস এবং সিনেমার প্রকরণ নিয়ে অজস্র পরীক্ষা নিরীক্ষা।
১৯৫৫ সালে যখন সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী মুক্তি পাচ্ছে, সে সময়েই তাঁর প্রথম ছবি নির্মিত হয়, রাতভোর। পথের পাঁচালীর চূড়ান্ত সাফল্যের উল্টোদিকে এটিকে বেশ অসফল প্রয়াসই বলতে হয়। মৃণাল সেন নিজেই ছবিটিকে আখ্যাত করেন অত্যন্ত জঘন্য বলে। উল্লেখ করার মতো তথ্য হল এই সিনেমায় উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন, যদিও তিনি চলচ্চিত্র মহলে তখন উল্লেখযোগ্য কোনও ব্যক্তি হয়ে ওঠেননি।
১৯৫৯ সালে তৈরি হয় মৃণাল সেনের দ্বিতীয় সিনেমা নীল আকাশের নীচে। এক আন্তর্জাতিক আত্মীয়তাবোধ এই ছবিটির মূল প্রেরণা। ছবিটিতে আমরা দেখি এক চিনা ফেরিওয়ালাকে যে তার রুজি রুটির তাগিদে এদেশের সাথে নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে যায় এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শরিক হয়ে পড়ে।
ফেরিওয়ালা চরিত্রকে তার পরের ছবি বাইশে শ্রাবণ (১৯৬০) এও নিয়ে আসেন মৃণাল সেন। চিনা ফেরিওয়ালা এসেছিল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। আর এই সিনেমার বাঙালি ফেরিওয়ালা চরিত্রটি আসে দুর্ভিক্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। মৃণাল সেনের অত্যন্ত সাড়াজাগানো এই ছবিটি মূলত একটি পরিবারের গল্প। ফেরিওয়ালা, তার স্ত্রী ও তাদের জীবন সংকটের গল্প। একটি পরিবারের গল্পের মধ্যে দিয়ে দুর্ভিক্ষকালীন সমাজের সংকটিকে ভাষা দেন মৃণাল সেন।
১৯৬১-তে মৃণাল সেন তৈরি করেন পুনশ্চ ছবিটি। পটভূমি সরে আসে গ্রাম থেকে শহরে। মধ্যবিত্ত এক পুরুষ নারীর, প্রেমিক প্রেমিকার এই গল্পে মৃণাল সেন দেখান পুরুষ প্রাধান্যের সমাজে নারীর অর্থিনৈতিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা কীভাবে খর্বিত হচ্ছে।
১৯৬২-তে পরের ছবি অবশেষে নির্মিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, প্রেম, বিচ্ছেদের এই কমেডি ছবিটি তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি আগের ছবি পুনশ্চের মতোই।
১৯৬৪-তে পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদের অবস্থা নিয়ে প্রতিনিধি নামে আরেকটি ছবি তৈরি করেন মৃণাল সেন। মেয়েদের সামাজিক ভয় ভীতি ভেঙে বেরিয়ে আসার ডাক রয়েছে এখানে।
১৯৬৫-তে মৃণাল সেন বানান আকাশ কুসুম। ছবির স্বপ্নবিলাসী নায়ক অজয় মধ্যবিত্তের বেড়া টপকে উচ্চবিত্ত হয়ে উঠতে চায় খুব দ্রুত। এজন্য বড়লোকের মেয়ের সাথে কৌশলী প্রেম সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে। অজয় চরিত্রটি নিয়ে পরিচালক কৌতুকই করেন ছবিতে। কৌশলী প্রেম স্বাভাবিকভাবেই সার্থকতা পায় না। ছবিটি শৈলীগত পরীক্ষা নিরীক্ষার কারণে আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৬ সালে কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর কাহিনী অবলল্বনে ওড়িয়া ভাষায় মৃণাল সেন তৈরি করেন মাটির মানুষ ছবিটি। এর পটভূমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে স্থাপিত। ওড়িষ্যার এক কৃষক পরিবারে সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা কীভাবে যৌথ সংসারে ভাঙন নিয়ে আসছে, জমির দ্বন্দ্ব কীভাবে পারিবারিক সম্পর্কে ছায়া ফেলছে সেটা এখানে অভিব্যক্ত হয়েছে। বড় ভাই নিজে জমির অধিকার ত্যাগ করে, কিন্তু তবু মানসিকতায় সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব আঁকড়ে থাকে। ছোটভাই না চাইলেও সম্পত্তির অধিকারী হয়। সেটা তার সামন্ততন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ের মানসিকতাকে দুর্বল করে না। কৃষক ও কৃষি প্রশ্নকে কেন্দ্রে রেখে নির্মিত এই সিনেমাটি ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী নির্মাণ।
১৯৬৯ সালে বনফুলের কাহিনী অবলল্বনে হিন্দি ভাষায় মৃণাল সেন তৈরি করেন তাঁর বিখ্যাত ছবি ভুবন সোম। এই ছবির মুখ্য ভূমিকায় উৎপল দত্তের অসামান্য অভিনয় এবং এর শৈলীগত নিরীক্ষা একে একটি ক্লাসিকে পরিণত করেছে। অনেকে মনে করেন এই ছবিটির মধ্যে দিয়েই হিন্দি প্যারালাল ছবির ধারাটি জন্ম নেয়। ছবিতে রেলের জাঁদরেল অফিসার ভুবন সোম সৎ ও কর্মনিষ্ঠ মানুষ, ভিক্টোরীয় আদর্শবাদের প্রতিনিধি। নিজের ছেলেকেও তিনি নিজের সততা রক্ষার জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারেন। কিন্তু এই সমীহযোগ্য আদলটিকে এরপর মৃণাল সেন ভেঙে দেন। দেখা যায় ক্ষমতা তৃপ্তির জন্য দুর্নীতিকে তিনি প্রশ্রয় দিতে পারেন। রেলের রুটিন কাজের বাইরে গুজরাটে একবার পাখি শিকারে যান ভুবন সোম। সেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পটে এক নারীর লাবণ্যের শিকার হয়ে যান তিনি। সততা রক্ষার রুটিন ভেঙে সেই লাবণ্যময়ীর স্বামীর দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন।
১৯৬৯-এ রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে ইচ্ছাপূরণ নামে এক শিশুচিত্র তৈরি করেন তিনি।এরপরেই শুরু হয় মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র নির্মাণ জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল পর্বটি। আমরা পরপর তাঁর কাছ থেকে পাই ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ৭১ (১৯৭২), পদাতিক (১৯৭৩), কোরাস (১৯৭৪), একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯)। সত্তর দশকে তৈরি এই পাঁচটি ছবি মৃণাল সেন এর সবচেয়ে আলোচিত ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম।
নিঃসন্দেহে সত্তর দশকের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বাস্তবতা মৃণাল সেনের এই নাগরিক ছবিগুলি নির্মাণের পেছনে মূল প্রেরণা হিসেবে সক্রিয় থেকেছে। একদিকে নকশালবাড়ি আন্দোলন, মুক্তির দশক হিসেবে সত্তর দশককে দেখে ছাত্র যুবর প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি ভাবনাচিন্তা জীবনচর্যা, অন্যদিকে এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য নির্মম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, নাগরিক জীবনে অস্থিরতা এই দশকের কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য, যাকে মৃণাল সেন তাঁর এই পর্বের সিনেমায় নিয়ে আসেন।
ইন্টারভিউ ছবিতে আমরা এক যুবককে দেখি যে চাকরির সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। শেষমেষ দেখা যায় একটা স্যুট না থাকার জন্য তার চাকরিটা হল না। ভারতের নয়া শাসনও যে আধা ঔপনিবেশকতার পাঁকে পাঁকে জড়িয়ে আছে, সেই রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতার উপস্থাপণ ঘটে এখানে। ছবির শেষে ক্রুদ্ধ যুবকের ম্যানিকুইনের মূর্তি ভাঙা যেন সেই রাজনৈতিক মূর্তি ভাঙা আন্দোলনেরই দ্যোতক, যা ঔপনিবেশিকতার কাঠামো নির্মাণের সহযোগী দেশীয় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার নতুন মূল্যায়ন থেকে উঠে এসেছিল।
পরের ছবি কলকাতা ৭১ তিনটি আলাদা গল্প অবলম্বনে তৈরি। গল্প তিনটির লেখক যথাক্রমে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল এবং সমরেশ বসু। গল্প তিনটির পটভূমি যথাক্রমে ১৯৩৩, ১৯৪৩ ও ১৯৫৩ সাল। প্রথম আখ্যানে এক বস্তিবাসী পরিবারের বর্ষার রাতে দুর্ভোগের ছবি, পরের গল্পে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক অনটনের কথা রয়েছে। তৃতীয় গল্পে পাই চালের চোরাচালানকারীদের কথা, যারা সব মূল্যবোধ পেছনে ফেলে যেভাবে হোক বেঁচে থাকতে চায়।
মৃণাল সেনের কোলকাতা ট্রিলজির শেষ ছবিটি হল পদাতিক। তখন নকশালবাড়ির রাজনীতির প্রথম পর্বটি ধাক্কা খেয়ে গেছে। ছবিতে আমরা দেখি এক যুবককে যে গ্রেপ্তার হবার পর পুলিশের ভ্যান থেকে পালায়। আশ্রয় পায় এক পাঞ্জাবী মহিলার বাড়িতে। এখানে যুবকটির রাজনীতির ধরণ নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়। গণসমাবেশের রাজনীতির প্রয়োজনিয়তাকে সে ক্রমশ উপলব্ধি করে।
পরবর্তী কোরাস ছবিটিতে সিনেমার টেকনিক নিয়ে অনেক অভিনব পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন মৃণাল সেন। নিও রিয়ালিজম এবং ডকুমেন্টারি ছবির আঙ্গিককে এখানে মেলাতে চেয়েছেন তিনি। রূপকথার ঢঙে ছবিটি তৈরি হয়। দেবতাদের অধিপতি চাহিদার সমস্যার ব্যাপারটা বুঝে শয়ে শয়ে চাকরীর বন্দোবস্ত করেন, কিন্তু হাজারে হাজারে চাকরীপ্রার্থী জুটে যায়। অনেক মানুষ, অনেক মুখ, অনেক সমস্যা। ক্রমেই জনতার মোহভঙ্গ হয়। ক্যামেরাকে সরাসরি লক্ষ্য করে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার আঙ্গিককে এই সিনেমায় ব্যবহার করেছেন মৃণাল সেন।
১৯৭৬-এ হিন্দি ভাষায় “মৃগয়া” ছবিটি তৈরি করেন তিনি। ভুবন সেন আর মৃগয়ার মাঝে ১৯৭২ সালে সুবোধ ঘোষের গোত্রান্তর গল্প অবলম্বনে “এক আধুরী কাহানী” নামেও একটি হিন্দি ছবি বানিয়েছিলেন মৃণাল সেন।
১৯৭৭ সালে প্রেমচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে তেলেগু ভাষায় তৈরি করেন “ওকা উরি কথা”। অত্যন্ত ব্যতিক্রমী বলে বিবেচিত এই সিনেমাটির নায়ক ভেঙ্কায়া একজন শ্রমিক। অভিজ্ঞতা দিয়ে সে বুঝতে পারে তারই শ্রমের মুনাফা লুটছে মালিক। যতই শোষণ বাড়ে, ততই ভেঙ্কায়া প্রতিবাদের নতুন নতুন পরিকল্পনা আঁটে। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ শ্লেষ, সাময়িক সমঝোতা – সবই তার লড়াইয়ের কৌশল। কলকাতা ট্রিলজীতে উতরোল সমাজ রাজনীতির পটভূমিকায় এক ধরনের প্রত্যক্ষ পলিটিক্যাল সিনেমা বানান মৃণাল সেন। আর ওকা উরি কথাতে সমাজের কাঠামো বিন্যাসের মধ্যেকার রাজনীতিটাকে ধরে অন্য এক ধরনের ‘পলিটিক্যাল ডিসকোর্স সিনেমা’ নির্মাণের দিকে এগোন।
বাংলা সিনেমার জগতে আবার ফেরেন পরশুরাম ছবির মধ্যে দিয়ে। একদল বস্তিবাসীর জীবনচিত্র নিয়ে তৈরি এই সিনেমা।
১৯৭৯-তে তৈরি মৃণাল সেনের একদিন প্রতিদিন সিনেমাটি একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের অফিস থেকে সময়ে বাড়ি না ফেরা নিয়ে উদ্বেগ দুশ্চিন্তার প্রেক্ষাপটে তৈরি। তখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেমেছে, কিন্তু অনিশ্চয়তা দুর্ভাবনার রেশ থেকে গেছে। তার সাথেই জড়িয়ে থেকেছে মানসিকতার ক্ষুদ্রতা, অসহায়তা, স্বার্থপরতা।
আশির দশকে তৈরি মৃণাল সেনের ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে আকালের সন্ধানে (১৯৮০), চালচিত্র কলকাতা (১৯৮১) খারিজ, (১৯৮৩) খণ্ডহর (১৯৮৪), জেনেসিস (১৯৮৪) একদিন আচানক (১৯৮৯)। সোভিয়েত ভাঙনের পর উঠে আসা নতুন প্রশ্নচিহ্নগুলি নিয়ে তিনি বানালেন মহাপৃথিবী (১৯৯১)। সাদাত হাসান মান্টোর গল্প অবলম্বনে ১৯৯৩ তে তৈরি হল অন্তরীণ। ২০০২ তে বানান শেষ ছবি আমার ভুবন। তখন তাঁর বয়স প্রায় আশি। এই ছবিটিও কায়রো ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা চলচ্চিত্রকারের পুরস্কার জিতে নেয়। এই ছবিটিতে আফসার আমেদের গল্প অবলম্বনে মৃণাল সেন দেখান গ্রাম জীবনের আটপৌরে সহজ জীবন ছন্দটিকে। নূরের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর সাকিনা বিয়ে করে কৌশিককে। নূর এর পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসে বেশ ধনী হয়ে। অন্যদিকে কৌশিক সাকিনার অনটনের সংসার। নূর প্রাক্তন স্ত্রীর বর্তমান স্বামী কৌশিককে অনটনে সাহায্য সহযোগিতা করে, কোনও বিবাহ বিচ্ছেদের তিক্ততা মাঝখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় না। এই অনায়াস জীবনছন্দকে পরাবাস্তবের মতো করে নিয়ে আসা মৃণাল সেনের সিনেমার নতুন দিকচিহ্ন। আশি বছর বয়েসে নির্মিত শেষ সিনেমাতেও তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন সাফল্যের ছক মেনে নির্মাণ নয়, ছক ভাঙতে ভাঙতে অহরত নতুন পথের সন্ধানেই ছিল তাঁর সৃজনের মূল আগ্রহ।
মৃণাল সেন তাঁর ছবিতে একটানা গল্পবলার ন্যারেটিভ টেকনিককে বারবার ভেঙেছেন এবং সিনেমার ভাষা নিয়ে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। বামপন্থী ভাবনাচিন্তায় বিশ্বাস রেখে তিনি নানা প্রশ্নে নিরন্তর খোঁজ চালিয়ে গিয়েছেন তাঁর ছবিতে। সত্তরের কলকাতা ট্রিলজীতে সময়ের ক্ষোভ যন্ত্রণাকে তুলে আনতে তিনি যেমন সফল, তেমনি ভুবন সোম এ সচেতনভাবে অ্যারিস্ট্রোকাট ব্যুরোক্রেসির চকচকে আদলটিকে ভেঙে ফেলতেও পারদর্শী। একদিন প্রতিদিন বা একদিন আচানক-এ যথাক্রমে এক যুবতী মেয়ে ও এক বৃদ্ধ অধ্যাপকের বাড়ি না ফেরা নিয়ে নানা কথা ভাবনার সূত্রে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের সমস্যাগুলিকে তিনি উন্মোচিত করে দেন অনায়াস দক্ষতায়।
জীবৎকালেই বাংলা সিনেমা তথা সংস্কৃতি জগতের লিভিং লিজেন্ডে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। দেশবিদেশের চলচ্চিত্র জগতের নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন, বহুবার তাঁর বিভিন্ন ছবি নানা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। মস্কো, বার্লিন, কান, ভেনিস, শিকাগো, মন্ট্রিয়েল, কায়রো – সমস্ত বিখ্যাত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেই পুরস্কৃত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন ছবি। সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের পাশাপাশি বাংলা সিনেমার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হিসেবে তিনি সমাদৃত হবেন দীর্ঘদিন।
– সৌভিক ঘোষাল