২০২০ পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করছি ২০২১ বর্ষে। অতিমারী সংকট, সেই গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন কর্মসংস্থান ও আরও কিছু ব্যাপক সংকটের যোগফলে ২০২০-র জনজীবন জেরবার হয়েছে। রুজি-রোজগার ফিরে আসার কিছু কিছু ক্ষেত্র খুললেও বেকারি আর গরিবী দূরীকরণের ন্যূনতম ছন্দ আসার সম্ভাবনা বহু দূরে। রাজ্য সরকার ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প চালু করেছে। চলার পথে বোঝা যাবে উপশম মিলবে কেমন। প্রাপ্য আদায়ের চাপ রেখে চলতে হবে। তবে মাথায় রাখতে হবে কেন্দ্রের মোদী-অমিত শাহ’দের জমানা সমস্ত দিক থেকেই সর্বনাশা অবস্থা তৈরি করছে। পশ্চিমবঙ্গের জন্য অবশ্য ‘প্রতিশ্রুতি’ ফেরী করছে এখানে ক্ষমতায় আনলে ‘সোনার বাংলা’ বানিয়ে দেবে! কথায় আছে, দূরাত্মার ছলের অভাব হয়না। তাই বিশেষ করে বাংলার কাছে ২০২১-এর গুরুত্ব ভীষণভাবেই আলাদা। আর ক’মাস পরেই হবে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন, হবে পেছনে অনেক অমীমাংসিত ফয়সালার জের নিয়ে। তবু যে প্রশ্নগুলো আজ সবচেয়ে জ্বলন্ত হয়ে উঠেছে তা হল, বাংলা আর “বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের” বহুত্বের জন্য লড়াইয়ের মাভূমি থাকবে কিনা, জনগণের প্রকৃত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার অধিকারের জন্য রণভূমি থাকবে কিনা, সামাজিক সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির পরিবেশ থাকবে কিনা? নাকি বাংলার দখল নেবে গণতন্ত্রের ভেকধারী সর্বগ্রাসী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী দুর্বৃত্তের দল! আম্বানী-আদানি’দের কোম্পানিরাজের দালাল বিজেপি! আগ্রাসী যুদ্ধটা শুরু করে দিয়েছে ওরা, সঙ্গে কুখ্যাত আরএসএস এবং তাদের আই টি সেল, কোটি কোটি টাকা, মিডিয়া চ্যানেল সমেত মজুদ অঢেল সমস্ত যুদ্ধোপকরণ। বাড়তি কৌশল নিয়েছে রাজ্যের শাসকদলের ঘর ভেঙ্গে ‘নিজেদের’ অর্থাৎ কেন্দ্রের শাসকদলের ঘর বাড়ানোর। ভয়-টোপের নানা প্যাঁচে-ডীলে কিছু কিছু ‘গদ্দার’ও জুটেও যাচ্ছে, যদিও পরিণাম বুঝিয়ে দেবে সংখ্যায় ‘গন্ডার’ কত আর ‘গরু’ কত! তবে এই পয়লা নম্বরের শত্রুদলকে আর এতটুকু হাল্কা করে দেখার কোনো মানে হয় না। বিজেপি নিজের আধিপত্য কায়েমের উদ্দেশ্যে তার বিপরীতে মূলত দু’রকম অবস্থা চায়। একদিকে সমাজে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি ছড়ানোর ওপর নির্ভর করতে, অন্যদিকে তার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে তার পছন্দ অনুসারে বিভাজিত করে রাখতে। কিন্তু বিজেপিকে রুখে দেওয়ার নীতিগত প্রশ্নে আর বিভ্রম দ্বিধান্বিত থাকলে চলবে না। জঘন্য গেরুয়া ষড়যন্ত্র ও কুৎসার শিকার হওয়া এমনকি স্বয়ং অমর্ত্য সেনও জোর দিচ্ছেন এই অভিমতের সপক্ষে। রাজ্যের বাম-গণতান্ত্রিক-উদারবাদী-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোকে এই অভিন্নমতে সহমত হয়ে উঠতে হবে। এই সহাবস্থানকে রূপ দিতে উপায় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র থাকুক, কিন্তু ছোট-বড়-মাঝারি সব উদ্যোগকে আগে “বিজেপি হটাও” পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করার দায় দায়িত্ব পালন করতে হবে। ঐ মূল শত্রুদল এতটুকু ছাড় পেয়ে যায় এমন কোন বিমূর্ত ‘উচ্চ মার্গী’ বিতর্ক থেকে বিরত থাকা উচিত।
মেরুকরণকে তীব্র ও ব্যাপক করে তুলতে বিজেপি বহুরূপী কৌশল নিচ্ছে। তারই অঙ্গ হল, আবারও সিএএ-র জুজু দেখানো, রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে আসার ফাঁকে কর্মরত কেন্দ্রের ‘নিয়া’র (এনআইএ) অফিসারদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর রুদ্ধদ্বার বৈঠক, রাজ্যের আইন শৃংখলার প্রশ্ন তুলে কিছু আইপিএস অফিসারদের কেন্দ্রে তলব করা, বিজেপি রাজ্য সভাপতির তরফে অহরহ ‘ধরো-মারো’ রব তুলে বাজার গরম করা, রাজভবনকে কার্যত বিজেপির অফিসে পরিণত করা, রাজ্যপালের বস্তুত বিজেপি নেতারূপী ভূমিকায় নেমে পড়া, বিশ্বভারতীকে এক অনুচর উপাচার্য ও আধিকারিকবর্গকে হাতিয়ার করে বিদ্বেষ-বিভাজনের দর্শন-মতাদর্শ ও রাজনীতি প্রচারের ঘাঁটি বানানো, যারাই পথের কাঁটা তাদেরই শান্তিনিকেতন ছাড়া করার পন্থা নেওয়া। রবিঠাকুরের ‘গুজরাটপ্রিয়তা’র ‘কহানী’ শোনাচ্ছেন মোদী। অমর্ত্য সেন ওদের চক্ষুশূল, তাই তাঁকে আজ দেগে দিচ্ছে বিশ্বভারতীর ‘জমি চোর’! কারণ, অমর্ত্য সেন বরাবরই সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ব বা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে আসছেন। তিনি কখনই “কর্পোরেট পোস্টার” মোদীকে ক্ষমতায় দেখতে চাননি। গান্ধীর গুজরাট আর মোদীর গুজরাটের বৈপরীত্যকে ডেঁটে তুলে ধরেন। তাছাড়া তাঁর ‘প্রতীচি’ সংস্থা মোদীর ‘উন্নয়ন মডেল’-এর সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও দলিতদের অধিকার লুন্ঠণকান্ডের লাগাতার উন্মোচন করে আসছে। বিজেপির গাত্রদাহ এইসব কারণেই। নারীসমাজকে বিজেপি অনুশাসিত রাখতে চায় খাপ পঞ্চায়েতী মডেলে, এপ্রশ্নে তাদের কাছে পুরুষতন্ত্রের ‘পসন্দ্-না পসন্দ্’ই বিচারের একমাত্র মানদন্ড। তারই ন্যক্কারজনক নমুনা মিলল দলবদলের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিজেপি সাংসদের পক্ষ থেকে তুরন্ত স্ত্রীকে বিচ্ছেদের নোটিশ পাঠানোয়।
‘ইনটেলেকচুয়াল আউটরিচ’ থেকে ‘আমার বুথ সবচেয়ে মজবুত’ — হরেক প্রকল্প নামাচ্ছে বিজেপি। ওদের বিরুদ্ধে তাই চাই পাল্টা রাজনৈতিক প্রতিরোধ, রাজ্য স্তর থেকে বুথ স্তর পর্যন্ত। “বিজেপিকে ভোট নয়” — এটাই হোক ২০২১-এর নির্বাচনের মূল আওয়াজ।