বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বিশ্বযুদ্ধগুলির ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর পৃথিবী সম্ভবত ২০২০-র চেয়ে কঠিন দুঃসময়ের বছর আর দেখেনি। জনস্বাস্থ্যের এক অস্বাভাবিক বিপর্যয় সারা বিশ্বে দশ লক্ষেরও বেশি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বাভাবিক সামাজিক জীবন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কার্যত সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়েছিল। কারণ, একের পর এক দেশগুলো টানা কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস, বিভিন্ন মাত্রার লকডাউন আরোপ করে অতিমারী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। ভারতে জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ভয়ঙ্কর অপ্রতুলতা এবং মোদী-মডেল লকডাউনের চূড়ান্ত নিষ্ঠুর, দমনমূলক ও স্বেচ্ছাচারী চরিত্রের জন্য ভারতকে অতিমারী এবং লকডাউন — দু’টি ক্ষেত্রেই চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আর তাই, বছর শেষ হতে চললেও বিপর্যয় কমার কোনো লক্ষণ নেই।
ভারতবর্ষের মানুষ যখন অতিমারী আর প্রাণশক্তি নিংড়ে নেওয়া লকডাউনের মিলিত বিধ্বংসী প্রভাবে চোখে সরষে ফুল দেখছেন, মোদী সরকার তখন সংকটকে সুযোগ করে তোলার শ্লোগান নিয়ে হাজির হয়েছে। সঠিকভাবে রহস্য উন্মোচনের পর এই নয়া স্লোগানের আসল মানেটা ধরা পড়েছে — ‘ধনী ও ক্ষমতাশালীদের সুযোগ-সৌভাগ্য সৃষ্টির জন্য সাধারণ মানুষের কষ্টকে গুরুভার করে তোল’! আর এই কাজটা একেবারে ‘নিখুঁত’ ভাবে করার জন্য সংসদীয় গণতন্ত্রকে নির্লজ্জভাবে ‘স্যানিটাইজ’ করা হল এবং ‘সুযোগ’ নেওয়ার উপযোগী করে তোলা হল। গণতন্ত্রের উপর এই ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-কে আর কোনো কিছু এত জীবন্তভাবে বর্ণনা করতে পারবে না যেমনটা ধরা পড়েছে মোদী সরকারের নয়া কৃষি আইন লাগু করার মরিয়া চেষ্টায় — ভারতবর্ষের গোটা কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষের স্বার্থ ও মতামতকে চূড়ান্ত অগ্রাহ্য করে। পাঞ্জাবের কৃষক সম্প্রদায়, যাদের একদিন ভারতের শাসক শ্রেণী দেশের ‘সবুজ বিপ্লবের অগ্রদূত’ বলে প্রশংসা করেছিল, তারা আজ মোদীর ‘নয়া ভারতে’ দেশবিরোধী অবাঞ্ছিত ‘পরম শত্রু’ বলে ঘোষিত!
অতিমারীর চরম পর্যায়ের মাঝামাঝি, জুন মাসের গোড়ায় সরকার প্রথম তিনটি অধ্যাদেশ প্রকাশ্যে এনেছিল এবং পাঞ্জাবের কৃষকরা সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করেছিলেন। গোটা পাঞ্জাব দ্রুত এই প্রতিবাদী কৃষকদের পাশে সমাবেশিত হয়েছিল এবং আকালি দলের মন্ত্রী দিল্লীতে মোদীর মন্ত্রীসভা থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাঞ্জাব বিধানসভা দলমত নির্বিশেষে ঐকমত্য হয়ে অধ্যাদেশগুলো খারিজ করেছিল এবং এমনকি বিজেপি নেতারাও তাদের নিজেদের দল থেকে ইস্তফা দিতে শুরু করেছিলেন। সেই প্রতিবাদকে আদৌ গ্রাহ্য না করে, উল্টে মোদী সরকার বিল নিয়ে এল এবং সংসদে বুলডোজার চালিয়ে বিলগুলি আইনে পরিণত করেছে। আর এখন, যখন গোটা দেশ জুড়ে কৃষকরা এই কর্পোরেট-তোষণকারী আইনগুলি বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন, তখন সরকার সংসদের শীতকালীন অধিবেশন বাতিল করে দিল! এর মধ্যে, নতুন কৃষি আইনের ‘ভরসায়’ ‘আদানি গোষ্ঠী দেশের সমস্ত অঞ্চলে নিজেদের কৃষিব্যবসা পরিকাঠামো গড়ে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে — তারও ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কর্পোরেট স্যাঙাতদের সাথে সরকারের অবৈধ যোগসাজসে ছক আগে থেকেই কষা ছিল, অধ্যাদেশগুলো এবং সন্দেহজনকভাবে পাশ হওয়া আইনগুলো সেই ছককে বিধিবদ্ধ করেছে মাত্র।
নাগরিক আন্দোলনের উদ্দীপক আহ্বান নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২০ সাল যখন মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বে ‘শাহীনবাগ’-এর নাম ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছিল। আর শাহীনবাগের চেতনা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঠিক যখন অতিমারী ও লকডাউননের ধ্বংসাত্মক জোড়া ফলার সাঁড়াশি আক্রমণে দীর্ঘায়িত প্রতিবন্ধকতা এবং মোদী সরকার ও সঙ্ঘ বাহিনীর এক সুপরিকল্পিত হত্যাভিযানের মাধ্যমে প্রতিবাদীদের গুঁড়িয়ে দেওয়া, বদনাম রটানো ও দানবীয় আইনে তাদের শাস্তি দেওয়ার ষড়যন্ত্র মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে কীভাবে শাহীনবাগের চেতনাকে নতুন করে জ্বালিয়ে তোলা যায়, আদৌ তা যাবে কি না, ঠিক তখনই কৃষকরা ট্রাক্টর আর ট্রলি চেপে, জলকামানকে তুচ্ছ করে, খুঁড়ে রাখা রাস্তা অতিক্রম করে, কাঁটাতারের অবরোধ ভেঙে হাজির হলেন এবং দিল্লী ঘিরে তাদের তাঁবুর খুঁটি গাড়লেন। তাঁরা শুধু যে আমাদের কিসান শাহীনবাগ উপহার দিলেন তাই-ই নয়, পুলিশি নির্যাতনে কৃষক আন্দোলন গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিজেপি’র চক্রান্তকেও নস্যাৎ করলেন, তাঁরা ১৮৫৭-র চেতনাকে নতুন করে জ্বালিয়ে তুললেন যখন কৃষকরা সৈনিকের পোশাকে দিল্লীর অভিমুখে দীর্ঘ পথ হেঁটেছিলেন আর ব্রিটিশ কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজ আবার ভারতীয় কৃষকরা আরেক বার দিল্লি ঘিরলেন, এবার ফ্যাসিবাদী শাসকদের রুখতে এবং ভারতকে বেলাগাম আদানি-আম্বানি কোম্পানি রাজের পদানত করার কুৎসিত অভিসন্ধিকে খারিজ করতে!
শাহীনবাগ থেকে সিঙ্ঘু সীমানা এবং টিকরি সীমানার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, ২০২০ সাল ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য এক গৌরবময় বছর হয়ে উঠেছে। ভারতের উত্তরাধিকারকে ফ্যাসিবাদী রসাতলে ঠেলে দেওয়াকে মানুষ যে রুখে দিতে পারেন — জনতার আত্মঘোষণার সেই অমিত শক্তি সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে এই বছর! মোদী সরকার শাহীনবাগকে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এক বিপথগামী আন্দোলন বলে হাজির করে কোণঠাসা করা, অপবাদ দেওয়া এবং চূর্ণ করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এখন তারা কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধেও একই ষড়যন্ত্র আঁটছে — বলছে এটা নাকি খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী আর পাঞ্জাবের ধনী কৃষকদের শক্তি প্রদর্শনের এক সমাবেশ। বিপ্লবী কমিউনিস্টদের অবশ্যই এই অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করে দিতে হবে, শুধু দিল্লী ঘিরে প্রতিরোধকে শক্তিশালী করেই নয়, ভারতের প্রতিটি কোণায় কোণায় এই চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সমস্ত অংশের দেশব্যাপী সমাবেশের সঙ্গে দিল্লীর এনআরসি-প্রতিরোধকে সহায়তা করার মধ্য দিয়েও। গত ২৬ নভেম্বর ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘট এবং ৮ ডিসেম্বর ভারত বন্ধে যে সাড়া পাওয়া গেছে তা, বিভিন্ন অংশের জনগণের সংগ্রামগুলির এক বিন্দুতে এসে মিলিত হওয়ার মহান সম্ভাবনাকেই স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে। আর বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল, প্রতিরোধের চেতনাকে নির্বাচনী পরিসরে সঞ্চারিত করার ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনাকে নির্দেশ করছে!
আসুন, কৃষকদের প্রতিরোধের দৃপ্ত আওয়াজের মধ্যে আমরা ২০২১-এর আগমন ঘোষণা করি। সরকারকে কৃষক-বিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহারে বাধ্য করা শুধুমাত্র ভারতের কৃষকদের জন্যই নয়, কর্পোরেট-আগ্রাসন ও ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সমস্ত স্তরের মানুষের জন্যই হবে এক বিরাট জয়। আর এই জয়, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভোট-যুদ্ধ সহ আগামী দফার বিধানসভা নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের কার্যকরী হাতিয়ার হয়ে উঠবে। ভারতের লড়াকু বাহাদুর কৃষকরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠুন! গণতন্ত্রের জন্য ভারতের সংগ্রাম জয়যুক্ত হোক!
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়)