নয়া দিল্লী, ৩১ মার্চ; ২০২০
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে দিল্লীতে তবলিগি জামাতের একটি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সমাবেশকে বেছে নিয়ে যেভাবে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে তা চরম নিন্দনীয়।
একথা তো জানা যে, ভাইরাস প্রতিরোধে বিদেশ থেকে ভারতে আসা বন্ধ করার এবং বড় জমায়েত নিষিদ্ধ করতে নির্দেশিকা বা সতর্কতা জারি করার দায়িত্ব ও ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের; কেন্দ্র সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তার বদলে, মার্চ মাসের অর্ধেকটা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও, কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড-১৯ এর বিপদকে অস্বীকার করছিল এবং বিরোধী দলনেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করলে উল্টে তাদেরকেই “অযথা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে” বলে অভিযুক্ত করছিল।
ভারতে কোভিড-১৯ এর প্রথম আক্রমণ নথিভুক্ত হয় ৩০ জানুয়ারী ২০২০। কিন্তু সমগ্র ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকার ভাইরাস আটকাতে ন্যূনতম পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। তার বদলে কেন্দ্রীয় সরকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে স্বাগত জানাতে বড় বড় সমাবেশের আয়োজন করছিল যার ফলে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে বিজেপি সমর্থকরা দিল্লীতে সাম্প্রদায়িক হানাদারদের এক জায়গায় জড়ো করছিল। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে বিরোধী নেতারা যখন কোভিড-১৯ এর আসন্ন মহামারি সম্পর্কে বারবার সতর্ক করছিল তখন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যুত্তরে আসছিল কেবলমাত্র ব্যঙ্গ বিদ্রুপ।
শুধু কি তাই? বিপদ যখন সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে, যখন লকডাউন ঘোষণা হয়ে গেছে, তখনও বিজেপি নেতা ও সমর্থকেরা বড় বড় জমায়েতে নেতৃত্ব দিয়েছে। ৭০০ সাংসদ সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থেকেছে এবং মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা দখল করতে বিজেপি ষড়যন্ত্র করেছে ও শেষে ২৪ মার্চ এক বিশাল জমায়েত করে বিজয়োৎসব করছে।
দিল্লির রাজ্য সরকারও তবলিগি জামাতের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করাকেই বেছে নিল ! অথচ সেই জমায়েতটি কোন অর্থেই বেআইনি ছিল না। বাস্তবে দিল্লি পুলিশের (যা কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পরিচালিত) এবং সংশ্লিষ্ট এসডিএম (দিল্লি রাজ্য সরকারের অধীন)-এর অনুমতি ও সহযোগিতা নিয়েই সেই জমায়েত সংগঠিত হয়েছিল। যদি সেই সমাবেশ বেআইনিই হবে তাহলে দিল্লি রাজ্য সরকার সঠিক সময়ে তা বন্ধ করার নোটিশ দেয়নি কেন?
তাছাড়া, জামাতের বিরুদ্ধে ফৌজদারী অভিযোগ আনা ও তার সাথে টিভি চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক প্রচার জুড়ে দেওয়াটা ওই জমায়েতে অংশগ্রহনকারী তথা সম্ভাব্য সংক্রমিত ব্যক্তিদের এগিয়ে এসে শারীরিক পরীক্ষা করানোর পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
কিছু কোভিড-১৯ রোগীর ও মৃত্যুর সংযোগ সেই জমায়েত সংশ্লিষ্ট বলে নির্ণীত হয়েছে। ওই সময়েই অন্যান্য যে সব বড় বড় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জমায়েতগুলি হয়েছিল সেই সংযোগে কতজনের সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে তা জানা অবশ্য খুব কঠিন। কারণ ভারতে করোনা পরীক্ষার হার খুবই ধীর।
অন্যান্য ধর্মীয় জমায়েতগুলির মধ্যে আছে শিরডি সাইবাবা মন্দির, এক শিখ প্রচারকের জমায়েত, এবং অতি সম্প্রতি বৈষ্ণোদেবী তীর্থের যাত্রীরা, যারা লকডাউনের ফলে সেখানেই আটকে পড়েছে (এবং এঁরা প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী জনসম্প্রদায়ের মধ্যেও ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা)। এইসব জমায়েতগুলিকে বা তবলিগি জামাতের জমায়েতটিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিৎ নয়, সম্প্রদায়কে দোষারোপ তো আরোই অন্যায়। দায়টা তো কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরই বর্তায়। প্রথম থেকেই সরকার বিভ্রান্তিকর বার্তা দিয়েছে, সুস্পষ্ট নির্দেশিকা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, জমায়েত করা না করার সিদ্ধান্ত ছেড়ে রেখেছে ব্যক্তি ও সংগঠনগুলির নিজস্ব বিচার বিবেচনার ওপর।
কোভিড-১৯ সংকট সংক্রান্ত খবরাখবর চেপে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার আদালতকে হাতে নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের কন্ঠরোধ করতে চাইছে যাতে “সরকার অনুমোদিত” ছাড়া কোনও খবর প্রকাশ না পায়। একথা তো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে, যে ভিড় এড়াতে লকডাউন ঘোষণা হল বাস্তবে লকডাউন সেই ভিড়কেই বাড়িয়ে দিয়েছে এবং অনাহার মৃত্যু ঘটাচ্ছে, পথদুর্ঘটনা বাড়িয়েছে, পুলিশি নৃশংসতার সুযোগ তৈরি করেছে, কৃষকের আত্মহত্যা বাড়িয়েছে আর গরিব কৃষক শ্রমিক পরিযায়ী দিনমজুরদের প্রাণান্তকর হয়রানিতে ফেলেছে। ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে কোভিড-১৯ কে মুসলমান ও চীনা জনতার সাথে জুড়ে দিয়ে যে বিষাক্ত ইসলামবিদ্বেষী ও জাতিবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার শুরু হয়েছে তাকে আটকাতে কোনোরকম উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষেরা ইতিমধ্যেই জাতিবিদ্বেষী বৈষম্য তথা কোভিড-১৯ এর নামে ঘৃণামূলক হিংসা ও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, এবারে মুসলমানদেরও সেরকম নিশানা বানানোর চক্রান্ত চলেছে।
আমরা ভারতের সকলকে আবেদন জানাচ্ছি কোভিড-১৯ মহামারীর এই পরিস্থিতিকে সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার বানানোর বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে রুখে দাড়ান এবং ভিড় এড়িয়ে ও সবরকম সতর্কতা মূলক বন্দোবস্ত অনুসরণ করে মানুষকে সাহায্য করার জন্য যথাসাধ্য প্রচেষ্টা করুন।
সিপিআই (এম-এল) কেন্দ্রীয় কমিটি