২৪ মে ১৯৬৭-তে বড় ঝরুজোতে শুরু হয় এক আলোড়ন তোলা অধ্যায়ের। পুলিশী অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে কিষাণসভার নেতৃত্বে সেখানে তখন সমাবেশিত হয়ে রয়েছেন কৃষক আন্দোলনকারীরা। চা বাগানের শ্রমিকেরা। যাদের বেশিরভাগই ছিলেন আদিবাসী ও রাজবংশী। পুলিশ বারবার এই সমাবেশ ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু সফল হচ্ছিল না। সোনাম ওয়াংদি নামের এক অত্যাচারী পুলিশ অফিসার দলবল নিয়ে জোর করে সমাবেশ ভাঙতে আসলে তার দিকে ছুটে আসে আদিবাসীদের বিষাক্ত তীর। সোনাম ওয়াংদির প্রাণ যায় কৃষক শ্রমিক আদিবাসী প্রতিরোধে।
২৫ মে ১৯৬৭-তে সোনাম ওয়াংদির মৃত্যুর প্রেক্ষিতে পুলিশী অভিযান শুরু হয়। কিন্তু পুলিশকে কৃষক শ্রমিক আদিবাসী জনতা ঘিরে ফেলে। পুলিশ তাদের হাতে পায়ে ধরলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই অবকাশে পালিয়ে গিয়ে তারা গুলি চালায় দূর থেকে। গুলিতে আটজন কৃষক রমণী, দুজন শিশু ও এক কিশোরের মৃত্যু হয়। শহীদেরা ছিলেন ধনেশ্বরী দেবী, সীমাশ্বরী মল্লিক, নয়নশ্বরী মল্লিক, মুরুবালা বর্মন, সোনামতি সিং, ফুলমতি দেবী, সামসরি সৈবানি, গাউদ্রাউ সৈবানি, খরসিংহ মল্লিক এবং দুটি শিশু, যাদের নাম জানা যায়নি।
এরপর আন্দোলনের ঝড়ের মধ্যে দিয়ে, রাষ্ট্র ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে বিকল্প ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ বাজি রেখে নামা আন্দোলনের সূত্রে অপরিচিত একটি ছোট্ট এলাকা নকশালবাড়ি অচিরেই দেশ এবং আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত হয়ে গেল একটি আন্দোলনের সূত্রে। কিন্তু নকশালবাড়ি আজ কোনও এলাকার বা নির্দিষ্ট আন্দোলনের নাম নয়। প্রতিস্পর্ধার, লড়াইয়ের নাম হয়ে উঠেছে। দেশের যেখানেই কৃষক শ্রমিক ছাত্র দলিত আদিবাসীরা লড়ছেন, নারীরা লড়ছেন — সেখানেই আমরা নকশালবাড়িকে খুঁজে পাই।
শাসকের চোখে ইতিহাসকে দেখার যে চোখ তাকে নকশালবাড়ি বদলে দিয়েছিল। আন্দোলনের চোখে, লড়াই সংগ্রামের চোখে ইতিহাসকে দেখতে বলেছিল নকশালবাড়ি। তেভাগা তেলেঙ্গানার ধারায় দেশপ্রেমের নতুন ধারণা দিয়েছিল নকশালবাড়ি। রাষ্ট্রবাদ যেভাবে ভারতমাতার জয় বলে, সমরাস্ত্রের প্রদর্শন আর খোলা তলোয়ার নিয়ে মিছিল করে দেশভক্তির কথা বলে সেখানে জনগণ আর তাদের অধিকারের কথা নেই। নকশালবাড়ি জনগণের মুক্তির যে গান তৈরি করেছিল “মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি”, সেখানে দেশপ্রেমকে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের মুক্তির সঙ্গে সমীকৃত করার কথা ছিল। নকশালবাড়ির এই আদর্শই আমাদের প্রেরণা, যা শাসকদের বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে, আঘাত করে।
তখন রাজ্যে যারা শাসক ছিলেন তারাও ভেবেছিলেন যে সদ্য ক্ষমতায় আসা সরকারের স্থায়ীত্বটাই মূল প্রশ্ন। তারাও নকশালবাড়িকে দমন করতে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ শাসনের শেষে কৃষক আন্দোলনের জোয়ারেই তাদের উৎখাত হতে হয়। আবার যে তৃণমূল সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সূত্রে ক্ষমতায় এলো, তারাও ভাঙরে কৃষক আন্দোলনের কড়া চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে ক্ষমতায় ফেরার পর মোদী সরকার যে সর্বনাশা কৃষি বিল আনেন, সংসদ তাকে রুখতে না পারলেও কৃষক আন্দোলনের মাটিই তাকে আটকে দেয়। বিপুল গরিষ্ঠতার সরকার বাধ্য হয় আইন প্রত্যাহারে। কৃষকের আন্দোলন, জমির আকাঙ্ক্ষার লড়াই নকশালবাড়ির প্রেরণা ও মর্মবস্তু, যা আজও ভীষণভাবেই প্রাসঙ্গিক।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের মর্মবস্তু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পার্টির প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক কমরেড বিনোদ মিশ্র এই দেশব্রতীর পাতাতেই কলম ধরে যা লিখেছিলেন তা আজ আর একবার স্মরণ করা যাক।
“নকশালবাড়ির প্রকৃত তাৎপর্য বলতে কী বোঝায়? নকশালবাড়ির অর্থ বুনিয়াদী কৃষক জনগণের জাগরণ। সশস্ত্র কিছু স্কোয়াড দিয়ে এদিক ওদিক বিক্ষিপ্ত কিছু কার্যকলাপ বা কিডন্যাপের মতো চমকপ্রদ এ্যাকশন করে বেড়ানো নয়। তার অর্থ কলকাতা, দিল্লী, বোম্বেতে কফিহাউসে বসে বড় বড় বিপ্লবী বুলি আওড়ানোও নয়। নিজেদের ব্যর্থতাকে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী আমাদের যতই গালাগালি দিয়ে বেড়াক না কেন, সত্য এটাই যে নকশালবাড়ির ধারায় এই কৃষক জাগরণ একমাত্র ঘটছে বিহারেই এবং আমাদের পার্টিই রয়েছে তার সামনের সারিতে।
নকশালবাড়ির অর্থ এই কৃষক জাগরণের ভিত্তিতে জাতীয় রাজনীতিতে এক বৈপ্লবিক রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন। স্থানীয় ভিত্তিতে কৃষকের কিছু অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া পূরণের মানেই কিন্তু নকশালবাড়ি নয়। পাহাড়ে-জঙ্গলে গিয়ে ‘লাল সেনা ও ঘাঁটি এলাকা’ গড়ে যারা বিকল্প রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তাদের সকলেই ব্যর্থ হয়েছেন। এখন সেখানে রাজনীতি বন্দুক চালাচ্ছে না, উল্টে বন্দুকই রাজনীতি চালাচ্ছে।
নকশালবাড়ি মার্কসবাদ বনাম সংশোধনবাদ, সশস্ত্র সংগ্রাম বনাম সংসদীয় পথের মধ্যকার কোনো বিমূর্ত সংগ্রামের সাফল্য নয়। পেটিবুর্জোয়া বিপ্লববাদ কিন্তু তাই ভাবে। কাজেই সে মনে করে বিপ্লবী ভাবাবেগ দিয়ে ও কিছু মৌলিক মার্কসবাদী সূত্র দিয়ে যখন খুশি, যেখানে খুশি নকশালবাড়ি গড়ে তোলা সম্ভব। যাবতীয় নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপ, তদজনিত হতাশা এবং অবশেষে উল্টো পথে যাত্রা — যার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে — এসবের পিছনে বিপ্লব সম্পর্কে মধ্যবিত্তের সেই কল্পনাবিলাসই কাজ করে।
নকশালবাড়ির শিকড় রয়েছে ভারতের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে, তার পেছনে আছে দীর্ঘ কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস, তেভাগা-তেলেঙ্গানার ধারাবাহিকতা। আছে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুই বিপরীতমুখী কৌশলগত লাইনের মধ্যকার দীর্ঘ সংগ্রামের প্রক্রিয়া। একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যার পরিণতি ঘটেছিল নকশালবাড়ির বিদ্রোহে। নকশালবাড়িকে বুঝতে হলে এসবই বুঝতে হবে।
মেহনতি কৃষক জনগণের জাগরণের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা হবে নাকি বুর্জোয়াদের কোনো না কোনো অংশের সাথে যুক্তফ্রন্টের স্বার্থে কৃষক জনগণের উদ্যোগকে স্তিমিত করা হবে — এই দুই বিপরীতমুখী কৌশলের লড়াই দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল। ১৯৬৭ সালের বিশেষ এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই এই লড়াই তার চরম বিন্দুতে পৌঁছায় — যখন ক্ষমতাসীন যুক্তফ্রন্ট সরকার কৃষক আন্দোলনের ঢেউকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা এগিয়ে যান এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে।
নকশালবাড়ির পক্ষে আপোশ বা পশ্চাদপসরণ করা সম্ভবও ছিল না, উচিতও ছিল না, কারণ তা হয়ে উঠেছিল এক নতুন বিপ্লবী পথের অগ্রদূত। ইতিহাসে সর্বদাই প্রথম বিপ্লবী অভিযানগুলি চূড়ান্ত মীমাংসার দিকেই ধাবিত হয়ে থাকে এবং তাই তারা ইতিহাসও সৃষ্টি করে যায়। কৌশলগত দিকগুলির সমন্বয় সাধন করতে দুপা পিছনে সরে আসা ইত্যাদি ইত্যাদি সবই সংরক্ষিত থাকে পরবর্তী প্রচেষ্টাগুলির জন্যই।…
ইতিহাস যেমন কখনও নিজের অবিকল পুনরাবৃত্তি করে না, তেমনি একটি মহান আন্দোলনের পুনর্জন্মও তার পুরোনো রূপে আর হয় না। যে যুগে আমরা ভালোরকম অধিবিদ্যায় ভুগতাম, বছরের পর বছর পুরোনো রূপে ও পদ্ধতিতেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য কত চেষ্টাই না চালিয়েছি কিন্তু তাতে সফলতা আসেনি।
কোনো সংগ্রামই সরলরেখায় চলে না। ঠিক সময়ে এগিয়ে গিয়ে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে আঘাত যেমন হানতে হয়, তেমনি প্রয়োজন হলে দুপা পেছনে সরে এসে নিজের শক্তিকে পুনর্গঠিত করতেও শিখতে হয়। যেকোনো আন্দোলন, সংগ্রাম বা যুদ্ধ এই উভয় দিককে নিয়ে গড়ে ওঠে। এই উভয় দিকের সঠিক সমন্বয় ঘটানোই হল নেতৃত্বের দক্ষতা বা যোগ্যতার প্রমাণ।”
‘নকশালবাড়িঃ একাল ও সেকাল’ – বিনোদ মিশ্র (দেশব্রতী, সেপ্টেম্বর ১৯৯০ থেকে উদ্ধৃত)।
জরুরি অবস্থার পর নকশালবাড়ির রাজনীতি ও সংগঠন ধারণা এক বড় বাঁকের মুখোমুখি হয়েছিল। আমাদের পার্টিও গণসংগঠন বয়কট বা নির্বাচন বয়কটের পুরনো অবস্থান ছেড়ে নতুন সময়ে নতুন ধরনের রাজনীতির প্রয়োজনের ডাকে সাড়া দেয়। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েতের পতনের পর আবার এক নতুন সন্ধিক্ষণ আসে। পার্টির জন্য জরুরি হয়ে পড়ে গোপন সাংগঠনিক পর্ব ছেড়ে প্রকাশ্য রাজনীতির। আজকের নকশালবাড়ি রাজনীতি বা বিপ্লবী কমিউনিস্ট রাজনীতি আবারো এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। গোটা দেশে যখন ফ্যাসিবাদের বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তখন সমস্ত রকম পথ ও পদ্ধতিতে ফ্যাসিবাদের মোকাবিলাই আজকের বিপ্লবী রাজনীতির অন্যতম প্রধান কর্তব্য। আর এই রাজনীতি স্বাভাবিকভাবেই শত্রু মিত্রের সমীকরণকে নতুন করে হিসাব নিকাশ করার দাবি জানায়। এও এক যুদ্ধ পরিস্থিতি। সেখানে যুদ্ধের নিয়মেই শত্রু শিবিরকে যতখানি সম্ভব ছোট ও মিত্র শিবিরকে যতখানি সম্ভব বড় করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। রাস্তার লড়াই থেকে সংসদের লড়াই — সম্ভাব্য সমস্ত ধরনের পথে ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে।
শেষ করা যাক কমরেড বিনোদ মিশ্রের উক্ত প্রবন্ধের শেষ কথাগুলি দিয়েই।
“হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭০’র দশকে যে নতুন ইতিহাস আমরা লিখতে গিয়েছিলাম, তা কি শুধু ইতিহাসই হয়ে থাকবে? অসাধারণ বীরত্ব, আত্মবলিদান, বেদনা ও বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা এক বেদনাদায়ক ইতিহাস হয়ে থাকবে? যা নিয়ে কবিরা কবিতা লিখবে, শিল্পীরা ছবি আঁকবে, গবেষকরা থিসিস রচনা করবে, বিপ্লবের শত্রুরা উপহাস করবে এবং আমরা মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান করে স্মৃতিমন্থন করব? না, তা আমরা হতে দিতে পারি না। বাংলার আকাশে বাতাসে আবারও প্রতিধ্বনিত হবে সেই চিরপরিচিত রণধ্বনি ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’। সেই দিনকে এগিয়ে আনার শপথই তো নিতে হবে আজকের দিনে।”
– সৌভিক ঘোষাল
স্বঘোষিত ‘বিশ্বগুরু’ যখন জাপানের হিরোশিমায়, ঠিক সেই দিন, ১৯ মে আরবিআই বাজার থেকে ২,০০০ টাকার নোট তুলে নেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করল। আর, সাথে সাথে ফিরে এল দেশে নোট বন্দির জুজু! ঠিক সাড়ে ছ’বছর আগে, ৮ নভেম্বর ২০১৬ সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আচমকাই দেশের সমস্ত ৫০০ এবং ১,০০০ টাকার নোট বাতিল করে দিয়ে দেশবাসীকে, দেশের অর্থনীতিকে বিরাট এক সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন, যার অভিঘাত আজও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। ডি-মনিটাইজেশন বা আম জনতার পরিভাষায় যা নোটবন্দি হিসাবেই পরিচিতি পেল।
৮ নভেম্বর ২০১৬’র ঠিক দু’দিন পর নোটবন্দির সূতিকাগারে জন্ম নিল ২,০০০’র গোলাপী নোট। কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার অন্যতম লক্ষ্য হিসাবে মোদীর প্রচারিত এই নোটবন্দির উদ্দেশ্যকে তখন কতই না মনের মাধুরী মিশিয়ে গোদী মিডিয়া প্রচার করেছিল। বলা হয়েছিল, নতুন এই ২,০০০ টাকা নোটের ভেতর নাকি এমন এক চিপ রয়েছে যা অবৈধভাবে গচ্ছিত রাখলে প্রশাসন ঠিক তার হদিশ খুঁজে পাবে! এই নোট কালো টাকার বয়ে চলা স্রোতকে, জাল নোটকে ঠেকাবে। এদিকে, ক’দিন আগে মোদী সরকারের প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কে ভি সুব্রহ্মণ্যন জানিয়েছেন, “৮০ শতাংশ গোলাপী নোটই কালো টাকা মজুত রাখতে কাজে লাগানো হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকা”! এই নোট এবার বদলাতে পরিচয়পত্র বা প্রমাণপত্রের কোনো প্রয়োজন না থাকায় কালো টাকার মালিকদের আর নোটগুলো ‘সাদা’ করতে কোনো বাধাই থাকল না। ঠিক সাড়ে ছ’বছর পর সেই নোটকে বাজার থেকে তুলে নেওয়ার সময় আরবিআই বুঝল, এই নোট লেনদেনের জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠতে পারল না — প্রথম প্রচলনের সময়েই যে কথা অনেক অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন। আরবিআই জানিয়েছে, ৩১ মার্চ ২০১৮-তে বাজারে ২,০০০ টাকার নোট ছিল ৬.৭৩ লক্ষ কোটি আর সেটাই তখন ছিল সর্বোচ্চ, যা মোট প্রচলিত সমস্ত নোটের ৩৭.৩ শতাংশ। ধাপে ধাপে তা কমে আসে আর ৩১ মার্চ ২০২৩-এ এসে দাঁড়ায় ৩.৬২ লক্ষ কোটিতে, যা মোট প্রচলিত নোটের মাত্র ১০.৮ শতাংশ। ২০১৮-১৯ থেকেই আরবিআই এই ২,০০০ টাকার নোট ছাপানো বন্ধ করে দেয়।
দেশবাসী দেখেছেন, রাতারাতি মোদী নোট বাতিল করে গোটা দেশকে কী চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। সন্ত্রাসবাদীদের উচিত শিক্ষা দেওয়া, কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, নগদ লেনদেন কমিয়ে ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়া — বারবার গোলপোস্ট বদল করা হয় নোটবন্দিকে যুক্তিসম্মত হিসাবে প্রচার করতে। কিন্তু দেখা গেল, নগদ লেনদেন কমল না, উল্টে নোটবাতিলের পর তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, কালো টাকা উদ্ধার হল না, ডিজিটাল অর্থনীতিও দূর অস্ত! আর উচিত শিক্ষা তো দূরে থাক, গণতান্ত্রিক আলাপ আলোচনা ছাড়াই চালু করে দেওয়া হল জিএসটি, অতিমারী ঠেকাতে হঠাৎ মোদীর ঘোষিত দেশব্যাপী লকডাউন — একের পর এক সর্বনাশা ধ্বংসাত্মক নীতি গোটা দেশকে নিয়ে গেছে খাদের কিনারে।
কর্নাটক ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ ভারত বিজেপির মুখে উপর এঁটেছে তালা। আগামী দিনগুলোতে আসন্ন কয়েকটি রাজ্যের মানুষ এই ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে কী রায় দেয়, তার অপেক্ষায় গোটা ভারতবাসী।
কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল এক মধুর বিস্ময় হয়ে উঠেছিল, এমনকি তাদের কাছেও যারা বিজেপির পরাজয়ই আশা করেছিলেন। কর্ণাটক রায়ের তাৎপর্য নিহিত আছে, কংগ্রেসের জয় ও বিজেপির পরাজয়ের বিশালত্বে এবং বিজয় অর্জনের পরিস্থিতিতে।
কর্ণাটক ছিল মোদী জমানার বিপুল ঢক্কানিনাদিত ‘ডবল ইঞ্জিন’ মডেলগুলির একটি। বেশ কয়েক বছর ধরে রাজ্যটি গেরুয়া বাহিনীর ধ্বংসাত্মক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর এক আদর্শ গবেষণাগার এবং ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির দক্ষিণী রঙ্গালয় হিসেবে সঙ্ঘের প্রশিক্ষণাধীনে রয়েছে। তীব্র সাম্প্রদায়িক উল্লাসধ্বনি আর তার সঙ্গে শ্রোতাদের তাতিয়ে তোলার জন্যে নরেন্দ্র মোদীর বারংবার বজরংবলীর জয়ধ্বনি উচ্চারণ — সব মিলে বিজেপির নির্বাচনী প্রচার সত্যিই হয়ে উঠেছিল অনায়াস জয়ের লক্ষ্যে এক ঝটিকা অভিযান। ‘গোদী মিডিয়ার’ চ্যানেলগুলো আমাদের বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল, বজরংবলীর জয়ধ্বনি আর মোদীর রোড-শো প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার সব চিহ্ন মুছে সাফ করে, নির্বাচনটাকে একেবারে সন্দেহাতীতভাবে বিজেপির অনুকূলে নিয়ে যাবে।
গোটা নির্বাচনী মরশুম জুড়ে ভোট বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষা এবং অবশ্যই বুথ ফেরত সমীক্ষা অন্য গল্পই শুনিয়ে এসেছে। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি এবং দুর্নীতি, নির্বাচনী ইস্যু হিসাবে জনপরিসরের চর্চায় সবচেয়ে সামনে উঠে এসেছে। উন্নয়ন নিয়ে বিজেপির লম্বা চওড়া সব দাবিকে নস্যাৎ করে সমীক্ষাগুলোতে গরিব মেহনতি মানুষের বাড়তে থাকা ক্রোধই ধরা পড়েছে। টিকিট বিতরণ নিয়ে বিজেপিতে বড় মাপের বিদ্রোহ, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রীসহ বেশ কিছু হাই-প্রোফাইল বিজেপি নেতার দল ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া এবং দুর্নীতিগ্রস্ত এক ক্ষুব্ধ মন্ত্রীকে শান্ত করতে মোদীর ব্যক্তিগত ফোন — সবকিছুই এই ধারণাকে পোক্ত করেছে যে বিজেপি হারতে চলেছে।
ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে, একমাত্র বেঙ্গালুরু ছাড়া কর্ণাটকের সব অঞ্চলেই বিজেপি আসন হারিয়েছে। বিজেপির তীব্র তীক্ষ্ণ উচ্চগ্রামের সাম্প্রদায়িক প্রচার সত্ত্বেও, এমনকি কর্ণাটকের উপকূল অঞ্চলেও ভোট এবং আসন দুই-ই কমেছে, যেটি সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণপ্রবণ অঞ্চল। বিজেপির ভোট-শেয়ার মোটামুটি একই আছে যেমনটা ২০১৮-তে ছিল — ৩৬ শতাংশের আশেপাশে। কিন্তু একটু তীক্ষ্ণ নজরে দেখলে ধরা পড়বে বিজেপির ভোট অনেকটাই কমেছে যেটা খানিক পুষিয়ে দিয়েছে বেঙ্গালুরু এবং মহীশূর অঞ্চলে বিজেপির পাওয়া বাড়তি ভোট। বিপরীতে, কংগ্রেসের অর্জিত সাফল্য কিন্তু সব অঞ্চল ও বিভিন্ন সামাজিক বর্গের মধ্যে একইরকম, বিশেষ করে তারা উল্লেখযোগ্য সমর্থন পেয়েছে তফসিলি জাতি, উপজাতি, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া বর্গ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, মহিলা এবং গ্রামীণ ও মফঃস্বলের যুব সমাজের ভোটারদের।
বিজেপির কর্ণাটক বিপর্যয়কে নিছক একটি রাজ্যের সরকার পরিবর্তনের প্রথাগত নকশার নিশ্চিত স্বীকৃতি হিসেবে দেখলে হবে না। বস্তুত, দলটি, অনেক রাজ্য যেখানে এটি তথাকথিত ‘প্রতিষ্ঠান-মুখী’ হাওয়ার সওয়ার বলে জাঁক করে বলে থাকে, সেখানে নিজেই এই নকশা পাল্টেছে বলে দাবি করে। যদিও প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট রাজ্যভিত্তিক একটা নির্দিষ্ট প্রেক্ষিত থাকে, অতি-কেন্দ্রিকতা ও ব্যক্তিপূজার মোদী জমানায় বিজেপির ছকে প্রতিটি নির্বাচন হয়ে ওঠে ২০১৪ পরবর্তী মোদী জমানার ভোট। কর্ণাটকে, এই নির্বাচনে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে সম্পূর্ণ ব্রাত্য রেখে গোটা নির্বাচনী প্রচারের সরাসরি দায়িত্ব নিয়েছিলেন মোদী-শাহ-নাড্ডা ত্রয়ী এবং কড়া হিন্দুত্বের আইকন যোগী আদিত্যনাথ অথবা হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তাই কর্ণাটকের রায়কে, ২০২৪’র বিরাট লড়াইকে সামনে রেখে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে কোনোমতেই বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না।
তাহলে, দেশ যখন বিধানসভা নির্বাচনের পরবর্তী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের এবং ২০২৪’র নির্ণায়ক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, কর্ণাটক নির্বাচন থেকে কী প্রাপ্তি? তথাকথিত ‘মোদী ম্যাজিক’ এবং অমিত শাহের নির্বাচন পরিচালনার রণকৌশল ঘিরে তৈরি হওয়া বিজেপির নির্বাচনযন্ত্রের কল্পিত অপরাজেয়তার অতিকথা, উপকারভোগীদের তথাকথিত নতুন শ্রেণির আনুগত্যের লোককথা আর সঙ্ঘ বাহিনীর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের স্বতন্ত্র্যচিহ্নিত রণকৌশলের প্রাণঘাতী কার্যকারিতার অমোঘতা — সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে কর্ণাটকে। একথা বলার মানে এই নয় যে, কর্ণাটকের রায়ের অবিকল প্রতিরূপ অন্য রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বা এক বছরের মাথায় অনুষ্ঠেয় দেশের লোকসভা নির্বাচনে নিজে থেকেই তৈরি হয়ে যাবে; তবে কর্ণাটক অবশ্যই দেশ জুড়ে অনুরণন তৈরি করবে।
কর্ণাটকে কংগ্রেসের প্রচারে ছিল সুচিন্তিত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জোর, ছিল প্রাণবন্ততা। যথেষ্ট আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল; ‘ভারত জেড়ো যাত্রা’ শুধু কংগ্রেসের সংগঠনকেই উদ্দীপ্ত করেনি, বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আম জনতার আশা আকাঙ্ক্ষা ইচ্ছার চেহারাটা তুলে ধরতে সহায়তা করেছে, যা কোনোভাবেই বিজেপির হাই-ভোল্টেজ প্রচারে দিশা বা মনোবল হারায়নি। বরং খানিকটা, দু’বছর আগে বাংলার ‘নো ভোট টু বিজেপি’র ধাঁচে কর্ণাটকেও প্রগতিশীল শক্তি ও নাগরিক সমাজের উদ্দীপ্ত প্রচার চোখে পড়েছে — ‘বহুত্ব কর্ণাটক’ (কর্ণাটক রাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে তুলে ধরার একটি প্রচার মঞ্চ) এবং ‘এড্ডেলু কর্ণাটক’ (বিজেপি এবং তার সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে পরাস্ত করার আহ্বান রেখে একটি সচেতনতা প্রচার অভিযান)-এর মতো মঞ্চের উদ্যেগে। এই প্রচার বিজেপিকে ভোটে হারানোর ইচ্ছাকে প্রবল সমর্থন ও উৎসাহ যুগিয়েছে। এই গণপ্রচার এমনকি নির্বাচন সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ অভিমতকেও প্রভাবিত করেছে এবং নির্বাচনের সব চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সমীক্ষাগুলির একটি তৈরি করে দিয়েছে।
এত বড় মাপের পরাজয়ে সঙ্ঘ বাহিনীর আঘাতটা বেশ গুরুতরই হয়েছে আর তাই আগামীদিনে তার আক্রমণ তীব্রতর হতে বাধ্য। কিন্তু কর্ণাটকের ফলাফল প্রতিটি গণতন্ত্রপ্রেমী নাগরিককে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা প্রতিটি আন্দোলনকে এবং সংবিধান ও সংসদীয় গণতন্ত্রের একেবারে বুনিয়াদি শর্তগুলোর ক্রমবর্ধমান বিপন্নতার প্রগাঢ় ভয়াবহতা নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন তথা প্রতিবাদী, বিরোধী রাজনীতির সেই সমস্ত শাখাও অনুপ্রাণিত হয়েছে। কর্ণাটক মোদী ভজনা এবং হিন্দুত্ববাদী প্রচারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে দিয়েছে। কর্ণাটকে মোদীর নিজের কৃতকর্মের দায় অন্যের ওপর চাপানোর চিরাচরিত বদভ্যাস এবং মুহুর্মুহু বজরংবলীর জয়ধ্বনির আচ্ছামতো মুখ পুড়েছে। গণতান্ত্রিক বিরোধী শক্তির শঙ্কিত হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না, বরং তাদের বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে, মানুষের কল্যাণ ও অধিকারের জন্য অপরিহার্য শর্তগুলিকে আরো জোরে সঙ্গে তুলে ধরা এবং বহুত্ববাদী সমাজের সমন্বয়ে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে আগামী ভারতের জন্য আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দৃঢ়পায়ে এগিয়ে যেতে হবে। কর্ণাটকে বিজেপির জোরালো হার সঙ্ঘ বাহিনী-বিজেপির ভয়, ঘৃণা আর ধ্বংসের রাজত্বের শেষের শুরু হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাক!
- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৬-২২ মে ২০২৩
নিজের হাতের মুঠোয় দিল্লীর আইনসভা ও প্রশাসনিক কার্যকলাপকে কব্জা করে রাখতে মোদী সরকার রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে এমন এক অধ্যাদেশ জারি করল, যা কার্যত খারিজ করে দিল সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়কে। সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দিল্লী সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যকার ক্ষমতা ও দায়দায়িত্বের মধ্যে এক বিভাজন রেখা টেনেছিল, সাংবিধানিক ভাবে দিল্লী যে বিশেষ স্ট্যাটাস ভোগ করে তাকে মাথায় রেখে। যদিও গতকাল রাত্রে জারি করা এক বিশেষ অধ্যাদেশ বলে দিল্লীর আমলাকুলকে বদলি বা নিয়োগ করার ক্ষেত্রে লেফটেনেন্ট গভর্নরকেই চূড়ান্ত ক্ষমতা দিয়ে খারিজ করা হল নির্বাচিত দিল্লী সরকারের ক্ষমতা ও দায়দায়িত্বগুলোকে, যা সংবিধান ও সাংবিধানিক বেঞ্চ অর্পন করেছিল।
দ্য গর্ভমেন্ট অফ ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটারি অফ দিল্লী অ্যাক্ট, ১৯৯১-কে সংশোধন করা হল একটা অধ্যাদেশ এনে, আর তৈরি করা হল ন্যাশনাল ক্যাপিটাল সিভিল সার্ভিসেস অথরিটি, যার মাথায় থাকবে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী, দিল্লীর মুখ্যসচিব এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্য স্বরাষ্ট্রসচিব। এই সংস্থা জাতীয় রাজধানীতে আমলাদের নিয়োগ ও বদলি করার ক্ষমতার অধিকারী, তবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটের ভিত্তিতে। এই সংস্থাই লেফটেনেন্ট গভর্নরের সিদ্ধান্তগুলোকে সুপারিশ করবে, আবার তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন যে ওই সংস্থার সুপারিশগুলো গ্রহণ বা বর্জন করা হবে কিনা। মতপার্থক্য রয়ে গেলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার লেফটেনেন্ট গভর্নরের উপরই থাকবে।
সুপ্রিম কোর্ট জোর দিয়েই বলেছিল, রাজ্যের শাসনতন্ত্রকে কেন্দ্রীয় সরকার কখনই কব্জা করতে পারে না। সে আরও আদেশ দেয়, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ ও জমি বাদে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাটি ন্যস্ত থাকবে জাতীয় রাজধানীর ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে জাতীয় রাজধানীর সরকারের উপরই।
ঘটনাচক্রে, সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্গত হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদের নীতিমালাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সময় এই পর্যবেক্ষণ রাখে যে, দু’টি ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যগুলোর সরকার “আমরা, জনগণ” দ্বারা নির্বাচিত হয়। আর উভয় ক্ষেত্রেই তা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকেই প্রতিফলিত করে। এই পর্যবেক্ষণের পর সুপ্রিম কোর্ট জোর দিয়েই বলে, “যে ২৩৯এএ ধারা জাতীয় রাজধানীর ভূখন্ডে দিল্লীকে এক বিশেষ স্যট্যাটাস দিয়েছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদের নির্যাসকে সামনে রেখে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ধরনকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছে এই লক্ষ্য নিয়ে যাতে রাজধানীর নাগরিকরা কীভাবে শাসিত হতে চায় সে প্রশ্নে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে পারে। এনসিটিডি সরকারের উপর এই দায়িত্ব বর্তায় যারা তাঁদের নির্বাচিত করেছেন, তাদের আকাঙ্ক্ষাকে এবার মর্যাদা দিতে হবে। তাই একমাত্র যে যুক্তিসঙ্গত উপসংহারে উপনীত হওয়া যায়, তা হল, জিএনসিটিডি’র হাতে থাকবে পরিষেবার নিয়ন্ত্রণ, কিন্তু সেগুলো তার এক্তিয়ারে আসবে না যেগুলো তার আইনি পরিধির বাইরে।”
কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা অধ্যাদেশ সরাসরি শীর্ষ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। ক্ষমতার বিভাজন ও বিচারব্যবস্থার কর্তব্যের প্রতি অবজ্ঞার এটা হল নগ্ন এক প্রকাশমাত্র।
আমরা বারেবারে দেখেছি, কিভাবে মোদী কর্তৃক নিয়োজিত লেফটেনেন্ট গভর্নর ও রাজ্যপালেরা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করেছে, বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলোতে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোকে অমান্য করেছে। দিল্লীর এই অচলাবস্থার জন্য দায়ী এলজি’র অতি সক্রিয়তা। নানান সময়ে দিল্লী সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোকে যিনি রূপায়িত করতে দেননি। এটা আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেখানেই বিজেপি হারছে, সেখানেই তারা এলজি ও রাজ্যপালকে ব্যবহার করছে শাসন প্রণালী ও গণতন্ত্রকে বানচাল করতে।
এমন একটা সময়ে এই অধ্যাদেশ আনা হল যখন সুপ্রিম কোর্ট যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদের নীতিমালাকে জোরের সাথে সামনে নিয়ে এল। এটাই দেখিয়ে দেয় আমাদের দেশের সাংবিধানিক নীতিমালা ও বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থার প্রতি বিজেপির চূড়ান্ত অবজ্ঞা। ক্ষমতা ধরে রাখতে মোদী সরকারের কদর্য খেলা দিল্লী জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাকে দলন করল। সিপিআই(এমএল) এর তীব্র বিরোধীতা করছে। জনগণের স্বার্থকে মাথায় রেখে, তাঁদের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান দিতে অবিলম্বে কেন্দ্রীয় সরকারের এই অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত।
- রবি রাই, সম্পাদক, দিল্লী রাজ্য কমিটি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
আবার বাজি বিস্ফোরণে মর্মান্তিক মৃত্যু। এবার পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় খাদিকুল গ্রামে। মুহূর্তের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কয়েকজন মহিলা সহ আটটা দেহ, নিভে গেল তাজা প্রাণ। তাঁরা সকলেই হতদরিদ্র গ্রামের মানুষ। এত তীব্র ছিল বিস্ফোরণের অভিঘাত যে উড়ে গেল বাড়ি, কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিও যে বীভৎস ছবি দেখে আঁতকে উঠেন।
বেআইনি এই বাজি কারখানার মালিক, নেপথ্যের খলনায়ক, প্রতাপশালী বাহুবলী কৃষ্ণপদ ওরফে ভানু বাগ দগ্ধ অবস্থায় ওড়িশার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন প্রয়াত হলেন। মারা গেলেন কলকাতায় এসএসকেএম’এ বিস্ফোরণে আহত আরও দু’জন। বদলি করা হল এগরা থানার আইসি’কে। কিন্তু, অজস্র যে সমস্ত প্রশ্ন উঠে গেল, তার জবাব পাওয়া গেল না।
ভানুর এই বেআইনি বাজির কারখানায় প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৯৫ সালে। তখন মৃত্যু হয় পাঁচ জনের। ফের ২০০১ সালে বিস্ফোরণ ঘটে ওখানেই, আর তখন নিজের ভাই সহ তিন জনের মৃত্যু হয়। বার বার প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায় দিব্যি রমরমিয়ে চলে আসছিল এই বেআইনি বাজি কারখানা। এমনকি, বর্তমান বিরোধী দলের নেতা, যিনি অনেক লম্বা চওড়া বিবৃতি দিচ্ছেন, তাঁরও রয়েছে এর পেছনে প্রশ্রয়ের আশীর্বাদ।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ওই এলাকার চরম আর্থিক দুর্দশার কাহিনী। একশ দিনের কাজ নেই, নেই অন্য কাজকর্মের সুযোগ সুবিধা। চরম কর্মহীনতা মমতার বাংলায় গ্রাস করে যে নিদারুণ অবস্থা তৈরি করেছে, এই অঞ্চলে তার ছাপ রয়েছে পরতে পরতে। ডুবন্ত মানুষের শেষ অবলম্বন ১০০ দিনের কাজ করা সত্ত্বেও ২০২১-২২ আর্থিক বছরে কর্মীদের মজুরি বাবদ বকেয়া ৩ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা কেন্দ্র আটকে রেখেছে। ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে বকেয়ার পরিমাণ ২ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা। গত ফেব্রুয়ারিতে শাসক দলের পরিচালিত সাহাড়া পঞ্চায়েতটি নির্দলকে নিয়ে কব্জা করেছে বিজেপি। তারা আসার পরও অবস্থার উন্নতি হয়নি একরত্তি। এগড়া-১’র বিডিও স্বীকার করেছেন, গত দেড়বছর গোটা ব্লকে বন্ধ রয়েছে ১০০ দিনের কাজ। নিঃস্ব রিক্ত অভাব অনটনে দীর্ণ ওই এলাকার কর্মহীন রোজগারহীন গ্রামবাসী ছিল ভানুর অবৈধ কারখানার স্থায়ী মজুত বাহিনী। অভাবগ্রস্তদের নানা সময়ে সাহায্যের ছল চাতুরিতে ঋণের ফাঁদে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, হুমকি দেখিয়ে নিজের কারখানায় কাজ করাতে বাধ্য করেছিল। স্থানীয় প্রশাসন বা বিরোধী দলের আগুনখোর নেতা যে এইসব জানতেন না, তা কিন্তু নয়। নামমাত্র মজুরিতে গ্রামের মানুষেরাই কাজ করতে বাধ্য হতেন। দিনমজুর মা ছেলের পড়ার খরচ জোগাড় করতেই ওই মৃত্যুপুরীতে কাজ করতেন, জানিয়েছে তাঁর ছেলে। যারা যারা মারা গেছেন তাঁদের প্রায় কারুর জবকার্ড ছিল না। মজুরি না পাওয়ায় গ্রামের মানুষেরা ১০০ দিনের কাজে আগ্রহ হারাচ্ছে।
বিস্ফোরণের অভিঘাত থেকেই মালুম হয়, কী ভয়ংকর বিস্ফোরক সেখানে মজুত ছিল। বোঝাই যায়, যত পঞ্চায়েত নির্বাচন এগিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ও প্রধান বিরোধী দলের অস্ত্র বোমা-বিস্ফোরকের উপর নির্ভরতা ততই বেড়ে চলেছে। ফলে, তার চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর আগেও রাজ্যের একাধিক জায়গায় এই সমস্ত অবৈধ বাজি (পড়ুন বোমা) তৈরির কারখানায় দুর্ঘটনার খবর সামনে আসে। কিন্তু পরিস্থিতির কোন বদল হল না।
আমাদের দেশে ২০১৭-২০২০ অব্দি গড়ে প্রতিদিন তিনজন শ্রমিক প্রাণ হারায় শিল্প দুর্ঘটনার জন্য। আর, কোনো বেআইনি কারখানায় নয়, সবগুলোই ঘটেছে সরকারি নথিভুক্ত কারখানায়! কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থানের ডাইরেক্টরেট জেনারেল ফ্যাক্টরি অ্যাডভাইস সার্ভিস অ্যান্ড লেবার ইন্সটিটিউটের কাছ থেকে ইন্ডিয়া স্পেন্ড নভেম্বর ২০২২-এ তথ্য জানার অধিকার আইনে উক্ত তথ্য জানতে পেরেছে। এই সমস্ত দুর্ঘটনায় সরকারিভাবে ৩,৩৩১টি মৃত্যু নথিভুক্ত হয়েছে, কিন্তু ফ্যাকট্রি আইন, ১৯৪৮ মোতাবেক মাত্র ১৪ জনের কারাদন্ড হয়েছে ওই সময়ের মধ্যে। মনে রাখা দরকার এই তথ্য কেবলমাত্র সরকারি নথিভুক্ত কারখানার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু, আমাদের দেশে ৯০ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন ইনফর্মাল ক্ষেত্রে, যা সরকারি দপ্তরে নথিভুক্ত নয়।
মানেসর ভিত্তিক এক সংগঠন ‘সেফ ইন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’ (এসআইআই) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘ক্রাশড ২০২২’, যা হল ছ’টা রাজ্যের অটো সেক্টারে শ্রমিকদের কাজের পরিবশ ও কর্মস্থলে দুর্ঘটনা ও আঘাতজনিত বহু ঘটনার অনুসন্ধান ভিত্তিক এক সমীক্ষা। রিপোর্ট দেখিয়েছে, প্রতিবছর কয়েক হাজার শ্রমিক তাঁদের হাত, হাত-পায়ের আঙুল হারিয়েছে কর্মস্থলে দুর্ঘটনার জন্য। এই সমস্ত অটো হাবে বহু শ্রমিক রয়েছেন যারা পরিযায়ী। তাঁদের নেই কোন ধরনের আইনি সুরক্ষা কবচ, অত্যন্ত নিম্নহারে মজুরি পান, যেখানে কার্যকর নয় দেশের শ্রম কানুনের কোনো ধারা।
২০২০-তে দেশে ৩,৬৩,৪৪২টি নথিভুক্ত কারখানা ছিল, যারমধ্যে ৮৪ শতাংশ চালু আর তাতে ২ কোটি ৩ লক্ষ শ্রমিক কর্মরত ডিজিএফএএসএলআই’র সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী। সেই রিপোর্ট জানাচ্ছে, গড়ে প্রতি বছর ওই কারখানাগুলোতে ১,১০৯ জনের মৃত্যু ও ৪,০০০’র উপর দুর্ঘটনায় আহত হন।
আইএলও তার রিপোর্টে বলেছে, যুদ্ধের থেকেও বেশি মানুষ নিরাপত্তাহীন কর্মস্থলের দরুণ প্রাণ হারাচ্ছে, যার সংখ্যা দৈনিক প্রায় ৬,০০০। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ২৭ কোটি শিল্প দুর্ঘটনা হয়, আর তাতে মারা যাচ্ছে ২২ লক্ষেরও বেশি মানুষ। আইএলও আরও জানিয়েছে যে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি। অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক কাজের পরিবেশও কেড়ে নিচ্ছে বহু প্রাণ। শুধুমাত্র অ্যাসবেসটসের দূষণে প্রতিবছর ১,০০,০০০ শ্রমিক প্রাণ হারান। অস্বাস্থ্যকর, দূষিত কর্মস্থল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্রমেই অনেক বেশি মৃত্যু ডেকে আনছে। আইএলও তার রিপোর্টে এটাও দেখিয়েছে যে হাড়-ভাঙা খাটুনি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করার জন্য স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় স্বাভাবিক অবসরের অনেক আগেই বহু শ্রমিক বাধ্যতামূলক ভাবে অবসর নিচ্ছেন। আইএলও অধিকর্তা আক্ষেপ করে বলেছেন, “কুড়ি বছর আগে ভোপালে ঘটেছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা যাতে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ২,৫০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে, অসুস্থ হয়ে পড়েন ২ লক্ষের উপর মানুষ। পরবর্তীতে আরও ২০,০০০ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কিন্তু, তারপরও পরিস্থিতি বদলালো না।”
২০২০-তে মোদী সরকার আগেকার কারখানা আইন, ১৯৪৮-কে বাতিল করে ওকুপেশনাল সেফটি হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন কোড নিয়ে আসে। আগের কারখানা আইন (ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট, ১৯৪৮) বর্তমান এই আইনের তুলনায় কয়েকটি ক্ষেত্রে বেশ কঠোর ছিল। যেমন, যেকোনো বিপজ্জনক কারখানা, তার আয়তন যাই হোক না কেন, তাতে সেফটি কমিটি গঠন করতে হতো, কিন্তু নতুন কোডে একমাত্র সরকারি বিজ্ঞপ্তি বা নির্দেশিকা থাকলেই তা গঠন করা যাবে।
যে বিপজ্জনক কারখানায় ন্যূনতম ২৫০ শ্রমিক কাজ করেন, সেখানে সুরক্ষা কমিটি গঠন করা যাবে। কারখানার সংজ্ঞাও পাল্টে গেছে। বিদ্যুতবিহীন সেই সংস্থাগুলোকেই কারখানা বলা যাবে যেখানে ন্যূনতম ৪০ জন শ্রমিক কাজ করেন, আগে যে সংখ্যা ছিল ২০, আর, বিদ্যুতচালিত সেই সংস্থা যেখানে ন্যূনতম ২০ জন কাজ করে, সেগুলোই কারখানা সংজ্ঞার আওতায় আসবে।
ভারতে কয়েক লক্ষ কারখানা নতুন এই সংজ্ঞার পরিবর্তনে ‘কারখানা’র আওতার বাইরে চলে গেল। এমনকি কারখানা নিরীক্ষণ করার শর্তগুলো বদলে ফেলা হল। ফ্যাক্টরি আইন, ১৯৪৮ থাকা সত্ত্বেও বেআইনি কারখানার গজিয়ে ওঠা, বা সেখানে নিয়ম কানুন লাগু করা যায়নি। নতুন কোড আসার পর সবকিছুই উবে যাবে। শ্রমিকদের ঠেলে দেওয়া হবে চরম নিরাপত্তাহীন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশে।
ভারতে সবচেয়ে বেশি শিল্প দুর্ঘটনা হচ্ছে শিল্পপ্রধান রাজ্যগুলোতে। একই ভাবে, বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বেড়ে চলেছে শিল্প দুর্ঘটনা। আরও ঝুঁকিপূর্ণ, নিরাপদহীন হয়ে উঠছে কর্মস্থল। সরকারের রঙ যাই হোক না কেন, বিশ্বে দেশগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও যাই হোক না কেন, নব্য উদারবাদী অর্থনীতি দ্রুত অত্যাধিক মুনাফা আদায়ে শ্রমিকদের সমস্ত সুরক্ষা কবচগুলো হরণ করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। চিনেও কিছুদিন আগে ফক্সকনের শ্রমিকরা সুরক্ষিত কর্মস্থলের দাবিতে যে আন্দোলন করেন, তা প্রচারের আলোয় আসে।
এই রাষ্ট্রীয় অপরাধ, রাষ্ট্র কর্তৃক এই গণহত্যার আয়োজনের বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলনকে অনেক মারমুখী আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে হবে। ট্রেড ইউনিয়নের অন্যতম দাবি এখন সুরক্ষিত কর্মস্থল, শোভন কাজ, সামাজিক সুরক্ষা। এই দাবিতেই সোচ্চার হতে হবে সর্বত্র।
- অতনু চক্রবর্তী
২৪ মে এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সম্পাদক দিবাকর ভট্টাচার্য এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন — সকাল সাড়ে ১০টায় মৌলালীর রামলীলা ময়দান থেকে সিলিকোসিস আক্রান্ত মানুষের মিছিল শুরু হয়। এই মিছিল ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে পৌঁছানোর পর অবস্থান শুরু হয়। অবস্থান মঞ্চ থেকে ১০ জনের একটি প্রতিনিধি দল শ্রম আধিকারিকের মাধ্যমে শ্রমমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে একটি ডেপুটেশন দেন। ডেপুটেশনের মাধ্যমে যে দাবীগুলিকে তুলে ধরা হয় —
(১) অবিলম্বে সিলিকোসিস পুনর্বাসন নীতি কার্যকরী করতে হবে।
(২) বেআইনি পাথর ক্রাশার ও খাদানকে আইনের আওতায় এনে শ্রম আইন লাগু ও শ্রমিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
(৩) মালিকের মুনাফা থেকে ডিএফএম ফান্ড তুলে আক্রান্ত শ্রমিকদের জন্য ব্যবহার করতে হবে।
ঐ ডেপুটেশন দলে এআইসিসিটিইউ’র অশোক সেনগুপ্ত, সিআইটিইউ’র আসাদুল্লাহ গায়েন, এসএএসএসসি’র সুগত রায়, আইএফটিইউ’র আশীষ দাসগুপ্ত, পিবিভিএম’র সৌরভ চক্রবর্তী প্রমুখ প্রতিনিধিত্ব করেন। অবস্থান সভায় বিভিন্ন গ্রামের আক্রান্ত মানুষেরা বক্তব্য রাখেন — মনিরুল ইসলাম, মরিয়ম বিবি, সেখ আজিজুল প্রমূখ। এছাড়াও বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও বিভিন্ন গণসংগঠনের নেতৃত্ব বক্তব্য রাখেন। এআইসিসিটিইউ’র পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন দিবাকর ভট্টাচার্য্য, সিআইটিইউ’র আসাদুল্লাহ গায়েন, বিজ্ঞান মঞ্চের মিলন গায়েন, এসএএসএসসি’র সাইদুল গায়েন, ইউটিইউসি’র সুধাংশু মন্ডল, টিইউসিআই’র হায়দার আলী, আইনজীবী শামিম আহমেদ, ডাক্তার সুজয় বালা, সুগত রায়, টিইউসিসি’র দীনেশ রায় প্রমূখ। অবস্থান সভায় গান কবিতা পাঠ ও ছবি আঁকা সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
৭ মে ২০২৩ এমসিসি’র নিরসা অফিসে সিপিআই(এমএল) ও এমসিসি একটা বৈঠকে মিলিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড জনার্দন প্রসাদ। বৈঠকে সিপিআই(এমএল) এবং এমসিসি’র অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ঐ বৈঠকে নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি পাশ হয়।
১) মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী হামলা দেশ এবং জনগণের জীবনে প্রতিকূল প্রভাব ফেলেছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন অর্থনৈতিক এবং কর্পোরেট কেলেঙ্কারি প্রকাশ পাচ্ছে। অবাধ বেসরকারিকরণ এবং শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার খর্ব করাটা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। শ্রমজীবী জনগণ, বিশেষভাবে উপজাতি সম্প্রদায়ের ওপরই কর্পোরেট লুট ও উচ্ছেদের ধাক্কাটা এসে পড়ছে। তাঁদের ওপর যৌন হেনস্থার অভিযোগ জানিয়ে মহিলা কুস্তিগিররা এফআইআর করেছিলেন। এসত্ত্বেও বিজেপি অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ সরণ সিংকে মদত দিয়ে চলেছে এবং তা বিজেপির নারী-বিরোধী চরিত্রকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। বৈঠক মহিলা কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
২) মোদী সরকার সাংবিধানিক সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে সেগুলোকে দুর্বল করতে এবং এইভাবে রাষ্ট্রের লাগামহীন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উঠেপড়ে লেগেছে। বিচারবিভাগ এবং তার সাথে নির্বাচন কমিশনের ওপর অসঙ্গত চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিরোধীপক্ষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যগুলোর অধিকারকে খর্ব করতে ইডি ও এনআইএ’র অপব্যবহার ঘটানো হচ্ছে। ঝাড়খণ্ড এই স্বেচ্ছাচারের সাক্ষ্য বহন করছে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্ট্যানস্বামীর প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার পর অন্যান্য আন্দোলন কর্মীদের ওপর নিয়মিতভাবেই হামলা নামছে।
৩) বিজেপি ঝাড়খন্ডে তাদের নোংরা খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছে। দু’কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি সরকার তার থেকে পিছিয়ে এসেছে। অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এরাজ্যে ১০০ দিনের কাজে প্রদেয় মজুরি অনেক কম দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিজেপি বিধায়ক ও সাংসদরা এনিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। বিজেপি-আজসু আইনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং রাজ্যপালের কার্যালয়ের অপব্যবহার ঘটিয়ে খতিয়ান ভিত্তিক পরিকল্পনা নীতি, স্থানীয়ভিত্তিক নীতি এবং সংরক্ষণ নীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। এরফলে যুবকদের ভবিষ্যৎ নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে, যে যুব সম্প্রদায়কে বিজেপি তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে।
৪) মোদী সরকারের প্রতারণার বিরুদ্ধে সোরেন সরকার ও জেএমএম’এর নীরবতা অত্যন্ত হতাশজনক হয়েই দেখা দিচ্ছে। শুধু বিধানসভা এবং বিধায়কদের ওপর ভর করেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং স্থানীয় ভিত্তিক কর্মনীতি তৈরির চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা যাবে না। শক্তিশালী রাস্তার আন্দোলনই এখন সময়ের দাবি যা বিজেপির দুমুখো নীতির উন্মোচন ঘটাবে এবং স্থানীয় উন্নয়নের ওপর ভর করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মোদী সরকারকে বাধ্য করবে। উপরে উল্লেখিত নীতমালাগুলোকে নবম তফশিলের কাঠামোর অধীনে নিয়ে আসার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হলে তা রাস্তার এক দৃঢ় আন্দোলন হয়েই উঠবে যা একটু আগে দেওয়া লক্ষ্যের বাস্তবায়ন ঘটাতে পারবে। হেমন্ত সোরেন সরকার এবং জেএমএম তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করতে বাধ্য হবে।
৫) কর্মসংস্থান এবং খতিয়ান ভিত্তিক বাসস্থানের ইস্যু দুটি এবং তার সাথে সংরক্ষণের বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এই ইস্যুগুলোকে ধরে আন্দোলন শুরু করাটা আবশ্যক হয়ে উঠেছে। এমসিসি এবং সিপিআই(এমএল) সব সময়েই ঝাড়খন্ডের জনগণের সংগ্রামের সামনের সারিতে থেকেছে। যুব জাগরণের কর্মসূচি রূপে ২৪ থেকে ৩১ মে ২০২৩ এক যৌথ প্রচারাভিযান শুরু হবে এবং স্থানীয় স্তরের প্রতিবাদগুলিকে সংগঠিত করা হবে।
(প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়ক নিউজক্লিক’এর ৭ মে ২০২৩ সংখ্যায় এই লেখাটি লেখেন। লেখাটার গুরুত্ব বুঝে আমরা এখানে তা প্রকাশ করছি। শিরোনাম আমাদের। - সম্পাদকমন্ডলী)
সিএমআইই’র বেকারত্ব সংক্রান্ত তথ্য সামনে মেলে ধরল অত্যন্ত বিবর্ণ এক ছবিকে। বেকারত্ব যে মাত্র কয়েক বছর আগে থেকে মাথা তুলেছে, ব্যাপারটা তা কিন্তু নয়। বরং অতিমারীর আগে থেকে এই বেকারত্বের হার বাড়তে শুরু করে। অতিমারীর সময়ে বেকারত্বের যে হার এক লাফে বেড়েছিল, বহু ঢাক পেটানো জিডিপি বৃদ্ধি কিন্তু সেই হারে লাগাম পরাতে পারল না।
বেকারত্বের যে হার ছিল ২০১৭-১৮’তে ৪.৭ শতাংশ, তা ২০১৮-১৯এ বেড়ে হল ৬.৩ শতাংশ। অতিমারীর সময়ে লকডাউনের হাত ধরে তা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। উদাহরণ স্বরূপ, ডিসেম্বর ২০২০তে ৯.১ শতাংশ। তারপর থেকে এই হার একটু কমলেও অর্থনীতির অংশত বা খানিক পুনরুজ্জীবনের সাপেক্ষে যতটা অনুমান করা হয়েছিল, তা নিতান্তই কম। ২০২২’র ডিসেম্বরে যা ছিল ৮.৩ শতাংশ, তা সামান্য একটু কমে ২০২৩’র জানুয়ারিতে হল ৭.১৪ শতাংশ। কিন্তু, আবার মার্চে তা মাথা তুলে দাঁড়াল ৭.৮ শতাংশে, সিএমআইই’র তথ্য অনুযায়ী।
জিডিপি বৃদ্ধি থমকে রয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত ২০২২-২৩’র জন্য জিডিপি’র যে আনুমানিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছে তা ২০১৯-২০’র সাপেক্ষে ৮.৪ শতাংশ বেশি আর ২০১৮-১৯’র সাপেক্ষে ১২.৯৫ শতাংশ বেশি। জিডিপি’র ১২.৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি হলেও বেকারত্বের হার ২০২২-২৩’র শেষে বেশি (৭.৮ শতাংশ), ২০১৮-১৯এ যা ছিল ৬.৩ শতাংশ। যেহেতু এই চার বছরে শ্রমশক্তির বৃদ্ধি হয়নি, বা তা ১২.৯৫ শতাংশের ধারেকাছে আসেনি, এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে প্রতি ইউনিট জিডিপি বৃদ্ধিতে কর্মসংস্থান ২০১৮-১৯ ও ২০২২-২৩এ কমেছে।
এখান থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, অতিমারীর সাপেক্ষে বর্তমানের উঁচু বেকারত্বের হারের পেছনে রয়েছে দু’টো কারণ : প্রথমত, যেটুকু আর্থিক পুনরুজ্জীবন হয়েছে, তা ঘটেছে এমন ক্ষেত্রগুলোতে যেখানে কর্মসংস্থান হয় না। অর্থাৎ, যে সমস্ত ক্ষুদ্র ছোট শিল্প ইউনিটগুলো শ্রমনিবিড়, সেই ক্ষেত্রগুলো পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়ার বাইরেই থেকে গেছে। আর দ্বিতীয় কারণ হল, বাজারে চাহিদার অভাবে বড় মাত্রায় লে-অফ হয়েছে, অথবা, ব্যয় সংকোচের নামে শ্রম সংকোচন ঘটানো হয়েছে।
ছাঁটাইয়ের জলজ্যান্ত উদাহরণ রয়েছে সিএমআইই’র দেওয়া তথ্যে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কর্মী সংখ্যা ফেব্রুয়ারিতে ৪০ কোটি ৯৯ লক্ষ থেকে কমে মার্চে এসে দাঁড়ায় ৪০ কোটি ৭৬ লক্ষে। ২০১৯-২০’তে ভারতে সমগ্র কর্মরত কর্মীর সংখ্যা ছিল ৪০ কোটি ৮৯ লক্ষ। যার অর্থ, ২০২৩’র মার্চে সমগ্র কর্মীর সংখ্যা ২০১৯-২০’র তুলনায় কম ছিল। এটা অত্যন্ত মলিন এক ছবি, যা দেখিয়ে দেয়, নতুন নতুন কাজ তৈরি হওয়ার বিপরীতে উল্টে যে কাজগুলো ছিল, সেগুলোই অনেকাংশে খোয়া গেল।
পরিহাস এটাই যে, সরকারি মুখপত্র দাবি করেছেন, দেশে কর্মসংস্থানের চিত্র নাকি অনেকটাই উন্নত হয়েছে। তারা নিজেদের যুক্তির সপক্ষে দু’টো দাবি তুলে ধরছেন। এক, সিএমআইই’র তথ্য সত্যনিষ্ঠ নয় আর পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভের (পিএলএফএস) তথ্যের সাথে তার কোনো সাযুজ্য নেই যা থেকে কর্মসংস্থানের উন্নতির ছবি বেরিয়ে আসে। আর দ্বিতীয় কারণটা হল, মনরেগার কাজে যুক্ত হওয়ার চাহিদা বেশ কমেছে, যা কর্মসংস্থানের উন্নতির অবস্থাকে প্রতিফলিত করে।
এই দু’টো যুক্তিরই কোনো সারবত্তা নেই। পিএলএফএস এবং কর্মসংস্থান সংক্রান্ত সিএমআইই’র দেওয়া তথ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় তফাৎ হল, প্রথমোক্তটি কর্মসংস্থানের সংজ্ঞার অধীনে গার্হস্থ্য আর্থিক কর্মকান্ডে মজুরিহীন শ্রমকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা শেষোক্তটি করেনি। কিন্তু, গার্হস্থ্য কর্মকান্ডের মধ্যে মজুরিহীন শ্রমকে অন্তর্ভুক্ত করলে তখনই সমস্যা হয় যখন বহির্জগতে ছাঁটাই বা সংকুচিত কর্মসংস্থানের ঘটনা ঘটে। মোদ্দা কথাটা হল, একটি পরিবারের উপার্জন যখন বন্ধ হয়ে যায়, পরিবারের সদস্যরা বাইরে কাজকর্ম থেকে বঞ্চিত হয়, তখন বাধ্যতামূলকভাবে তাঁরা ঘরের মধ্যে যেটুকু কাজ পান, তাই করতে বাধ্য হন। এক্ষেত্রে পিএলএফএস বেকারত্বের বৃদ্ধি দেখায় না। অন্য কথায়, পিএলএফএস ঘরের কোণে বাধ্যতামূলকভাবে আটকে থাকা আর উপার্জনশীল গাহর্স্থ্য কর্মকান্ডের মধ্যে তফাৎ টানে না।
সিএমআইই এই সমস্ত ফাঁক ফোকর থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছে। তারা ধারাবাহিকভাবেই বহির্জগতে কর্মসংস্থানের চিত্রটাকেই সমীক্ষা করে চলেছে। ফলে, তাদের সমীক্ষা অনেক নিখুঁত ও বিশ্বাসযোগ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত।
লকডাউনের সময় মনরেগা প্রকল্পে যে বিরাট চাপ লক্ষ্য করা যায় তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এটা ভুলে গেলে চলবেনা, ঠিক সময়ে মনরেগা প্রকল্পের মজুরি কেন্দ্রীয় সরকার দিচ্ছেনা দেখে এই প্রকল্পে মজুররা কাজ করতে চাইছেনা। তাই, এই প্রকল্পে কাজ হওয়াটা এখন কর্মসংস্থান পরিমাপের দুর্বল সূচক। ঠিক সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার বকেয়া মজুরি প্রদান না করায় অনেকেই এই প্রকল্পে আগ্রহ হারাচ্ছে। আর এটাকেই প্রচার করা হচ্ছে যে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর কমছে! কী অদ্ভুত যুক্তি।
যে কোনো ব্যক্তি স্বাভাবিক কারণেই আশা করবেন যে, কর্মহীনদের সংখ্যা সামগ্রিক কর্মরত মানুষদের গড় প্রকৃত আয়ের সাথে, স্বনিযুক্ত ব্যক্তিদের গড় প্রকৃত আয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত হবে। এই কারণে, স্বনিযুক্ত গ্রুপের মধ্যেই শ্রমের মজুতবাহিনী নিহিত। কর্মসংস্থান হ্রাসপ্রাপ্ত হলে ওই মজুত বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, যার ফলশ্রুতিতে স্বনিযুক্ত ক্ষেত্রটির গড় প্রকৃত মজুরিও হ্রাসপ্রাপ্ত হবে। এটা বেশ মজার ব্যাপার যে, সরকারের নিজস্ব পিএলএফএস’এর পরিসংখ্যানই দেখিয়েছে যে, ২০২২’র এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে স্বনিযুক্ত কর্মীদের গড় প্রকৃত আয় ২০১৯’র এপ্রিল-জুন’এর ত্রৈমাসিকের সাপেক্ষে গ্রাম ও শহরে বেশ নিচে ছিল (চন্দ্রশেখর ও ঘোষ, ম্যাক্রোস্কান)। এই তথ্য আরো একবার সিএমআইই’র বেকারত্ব সম্পর্কিত সমীক্ষাকেই প্রতিষ্ঠিত করল।
ভারতের বেকারত্ব সম্পর্কিত পরিসংখ্যান কিছু মৌলিক বিষয়কেই তুলে ধরে, আর তা হল, নব্য উদারবাদ কখনই এক সামাজিক বন্দোবস্ত হতে পারে না যা কিনা দেশের বেকারত্বের সমস্যাকে ঘুচিয়ে দেবে। যেহেতু, অল্প মাত্রায় হলেও কিছু আর্থিক কর্মকান্ডের দৌলতে মহানগরের ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সম্প্রসারিত হয়েছে আর তা তুলনামূলকভাবে মজুত বাহিনীর ছোট্ট একটা অংশ সেখানে জায়গা করে নিতে পেরেছে। তারা এখান থেকে এই যুক্তি হাজির করেন যে, এটাই যদি অন্যত্র অনুসরণ করা হয়, যদি বাকি বিষয়গুলো ‘বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়’, সরকার বৃহৎ পুঁজির স্বার্থ ছাড়া অন্য সব দিক থেকেই নিজের হাত যদি গুটিয়ে নেয়, তবে ‘সমৃদ্ধি ও একশভাগ কর্মসংস্থানের’ রাস্তা পাকা হবে।
একথা ঠিক, ‘একশভাগ কর্মসংস্থান’ পুঁজিবাদী অর্থনীতি কখনই অর্জন করতে পারবে না, কারণ বেকারদের মজুত বাহিনী ছাড়া সে অর্থহীন। কিন্তু, নব্য উদারবাদ এই মজুত বাহিনীর একটা বড় অংশকে ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা অনেক প্রগতিশীল মানুষের চোখে ঠুলি পরিয়ে দেয়। ওই যুক্তিতে ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসানের পর তৃতীয় বিশ্বে যে ‘রাষ্ট্র’ সামনে এল, তা ধীরে ধীরে নিজের হাত গুটিয়ে নিতে সফল হয়, আর সাধারণভাবে মহানগরের পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে এক আপেক্ষিক স্বায়ত্ততার হাবভাব নিয়ে চলতে শুরু করে।
নব্য উদার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কিছু মহৌষধী দিয়ে বেকারত্বের সমস্যা সমাধান করা যাবেনা। বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী এক আর্থিক সামাজিক ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে, যে ব্যবস্থাটি বেকারদের মজুত বাহিনীর উপর নির্ভর করবেনা, বরং শ্রমজীবী মানুষের দ্বারা সচেতনভাবে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে অনুমোদন দেবে।
পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে বা পিএলএফএস হল এমন এক সমীক্ষা যা বাৎসরিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রধান প্রধান কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব সংক্রান্ত সূচক, যেমন শ্রমে অংশগ্রহণের হার, কর্মী জনসংখ্যার অনুপাত, কর্মহীনতার হার ইত্যাদি সম্পর্কে আলোকপাত করে।
ভাষান্তরঃ অতনু চক্রবর্তী
বিশ্বায়ন, উদারিকরণ, বেসরকারিকরণের পথ বেয়ে আজ দেশজুড়ে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ তীব্রতর হয়েছে। ফ্যাসিবাদী এই আক্রমণে শ্রমজীবী মানুষের শ্রম সময়, মজুরি, চাকুরির নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি হামলা হচ্ছে। সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর ৯৪ শতাংশ যে অসংগঠিত অংশ তারা যেন আজ ক্রমশ নেই জগতের মানুষ হয়ে পড়ছে। এরা কোনো একটা নিদির্ষ্ট পেশায় যুক্ত থাকতে পাড়ছে না। সব সময় একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। কাজের সন্ধানে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে। তাতেও দুবেলা গ্রাসাচ্ছাদন হচ্ছে না ফলে ভারত ক্ষুধার সূচকে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। জঁ-দ্রেজের কথায় নির্মাণ শিল্প শ্রমিকদের মজুরি নেগেটিভ পর্যায় চলে গেছে। অমর্ত সেন একটি নিবন্ধে যখন লেখেন দিনের উজ্জ্বল আলো ক্ষুদার্ত শিশুর কাছে আরো ভয়ঙ্কর। ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ব্যস্ততম সারাদিন কিভাবে যাপন করবে। এ কথাগুলো শুনলে ভেতরটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
সমগ্র শ্রমিকশ্রেণির এই ৯৪ শতাংশ, যা ক্রমবিকাশমান অর্থাৎ সংগঠিত ক্ষেত্রে অসংগঠিত অংশ তৈরি করা। শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে শাসকশ্রেণীর নানা গবেষণা চলছে। এদের মধ্যেই ফ্যাসিবাদের প্রভাব বৃদ্ধি হয়ে চলেছে। নানা রঙ্গের সরকার নানা রূপের সামাজিক প্রকল্পের ললিপপ ঝুলিয়ে নিজেদের অনুকূলে কিভাবে টানা যায় তারই খেলা চলছে। এই প্রকল্পের কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। সরকারের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। সরকার পরিবর্তন হলে, সামাজিক প্রকল্পগুলোও পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। নয়া অর্থনীতির এটাই দস্তুর। সমস্ত ন্যায্য অধিকার কেড়ে নাও, দয়ার ওপর নির্ভরশীল সামান্য সামাজিক প্রকল্প চালু করো।
বর্তমানে দেশজুড়ে নির্মাণকান্ড চলছে। চাষ থেকে লাভ না পেয়ে এবং পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাওয়ায় শহরতলীর পঞ্চায়েত অঞ্চলের জমিগুলোর প্রতি প্রমোটারদের নজর বেশি পড়ছে। বিশেষ করে আরো বেশি মুনাফার জন্য শহর ছেড়ে পঞ্চায়েত অঞ্চলে ব্যাপক জমির লুঠ চলছে। বেআইনিভাবে জল প্রভাহকে বন্ধ করে চাষের জমিকে বাস্তু জমিতে পরিণত করা চলছে। নগরায়ন ক্রমবিকাশমান। এরসাথে বহুমূল্যবান জমি শহরাঞ্চলে হকার ও বস্তি উচ্ছেদের জন্য বুলডোজার রাজ চলছে। যদিও শহরে তীব্র রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকায় এই কাজে মন্থর গতি।
নির্মাণ শিল্প করোনাকালে সামান্য ধাক্কায় ছিল। এখনো ঠিক আগের পর্যায়ে ফিরে আসেনি। তা সত্ত্বেও উন্নয়নের প্রতীক হিসাবে দেশজুড়ে ছ-চার লেনের চওড়া সড়কপথ, রেললাইন, হাইরাইজ বিল্ডিং, শপিংমল, ফ্লাইওভার, ব্রীজ, বিমানবন্দর, নানারকম বিনোদন ক্ষেত্র, বেসরকারি হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ নানা রকম ঝলমলে নির্মাণকান্ড চলছে। তার সাথে চলছে নিজেদের থাকার জন্য ব্যাক্তিগত ছোট-মাঝারি বাড়ি এবং গ্রাম শহরে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা সরকারি প্রকল্প। অসংগঠিত শ্রমিকদের ৯৪ শতাংশের সবচেয়ে বড় অংশ এই নির্মাণ কাজে যুক্ত। তারা গ্রাম শহরে ছড়িয়ে আছে। বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলে বিরাজ করে। গ্রামাঞ্চলের সমস্ত শ্রমশক্তিকে চাষাবাদ ধরে রাখতে পাড়ছে না তাই দলে দলে মানুষ শহরের অভিমুখে যাত্রা করছে কাজের সন্ধানে। এদের মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিক সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এদের ভালো মাত্রায় সংগঠিত করে কর্মক্ষেত্রে আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে বা যেটুকু সামাজিক সুরক্ষা টিঁকে আছে তাকে আদায় করতে হলে গ্রাম শহরের সংগঠক ও পার্টি কমিটিগুলোকে বড় উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এদের একটা বড় অংশই গ্রাম থেকে শহরে বড় বড় নির্মাণ শিল্পে যুক্ত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে এদের জেলখানার মতো ব্যারাকে রেখে দেওয়া হয়। সেখানে মস্তান-প্রমোটার-প্রশাসনের এক অশুভ শক্তির জোড়ালো উপস্থিত থাকায় এবং বেশিরভাগ শ্রমিক বহিরাগত হওয়ায় সংগঠিত হওয়া কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তাই তাদের বাসস্থানে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। এদের ধরেই পঞ্চায়েত/পৌরসভা/নগরনিগম অঞ্চলে বড় বড় নির্মাণ শিল্পে আন্দোলন গড়ে তোলার সম্ভাবনা দেখা দেবে।
বহু বড় বড় অনেক শিল্পের জিয়নকাঠি এই নির্মাণ শিল্প। তাই নির্মাণশিল্পে ১০০ শতাংশ বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশের অনুমতি দেওয়া, ব্যাঙ্কের সুদ কমানো সহ নানা ছাড় চালু করা হয়েছে। এই নির্মাণশিল্পের সাথে যে বিশাল শ্রমশক্তি যুক্ত আছে বা প্রয়োজন তাদের আন্দোলনের চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৬ সালে একটা আইন, বিধি ও রাজ্যে রাজ্যে বিধি তৈরি করে। সেই আইনি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক সুরক্ষা আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী নির্মাণ শ্রমিকরা সংগঠিত হতে থাকে, আন্দোলন গড়ে ওঠে, নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে কেস চলতে থাকে, পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটির রির্পোট পেশ করতে হতো।
সংগঠিত হওয়া এই শ্রমিকদের বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত করতে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ, হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত তহবিল লুঠ করা ও কাদের নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে আইনের অধীনে আসবে তার পরিবর্তন ঘটানো হল (সামাজিক সুরক্ষা পয়সা দিয়ে কেনার কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পনা রচনা করেছে), মোদী সরকার দ্বারা রচিত নয়া ৪টি লেবার কোডে। যেহেতু সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠিত প্রতিবাদের ফলে ৪টি লেবার কোড বাস্তবায়নে সরকার কিছুটা পিছুপা, ঠিক এই সময় নির্মাণ সহ অসংগঠিত শ্রমিকদের দাবি আদায়ে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে গ্রামীণ নির্মাণ শ্রমিক থেকে বৃহৎ নির্মাণ শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ করা চলবে না, বিএমএসএসওয়াই ফর্মে ট্রেড ইউনিয়নের স্বাক্ষর করার অধিকার দিতে হবে। নির্মাণ শ্রমিকদের নথিভভুক্তিকরণের জন্য পুরণ করা নথি ব্লকে জমা নিতে হবে। অন্যথায় ব্লকস্তরে (IMW) নুন্যতম মজুরি পরিদর্শকদের নির্মাণ শ্রমিকদের নথিভুক্তিকরণের অনুমোদন প্রদান করতে ই-ডিস্ট্রিক্ট আইডি পাশওয়ার্ড (e-district ID password) দিতে হবে, উৎসব ভাতা চালু করা সহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা বজায় রাখা, সারা বছর কাজের গ্যারান্টি, ন্যায্য মজুরি (দৈনিক নুন্যতম মজুরি দ্বিগুণ করে সরকারকে ঘোষণা করত হবে) কোনো অজুহাতে পেনশন প্রাপকদের অধিকার হরণ করা চলবে না, নুন্যতম পেনশন ৩ হাজার টাকা করতে হবে। বিভিন্ন দাবিতে ব্লকে নুন্যতম মজুরি পরিদর্শক (IMW), সহ শ্রমাধক্ষ্য ‘ALC’র নিকট দাবি সনদ পেশ করে সমাজের সবচেয়ে নীচুতলার, সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার সুবিশাল অংশকে সংগঠিত করার কাজে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে সরকারি ভাবে নথিভুক্ত হওয়ার যে সুবিধা আছে তাকে কাজে লাগাতে হবে যেমন — ই-ডিস্ট্রিক্ট, বিএমএসএসওয়াই এবং ই-শ্রমে (ইতিমধ্যে ই-শ্রমে ২৮ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকের নাম নথিভুক্ত হয়েছে, উত্তরপ্রদেশে সবচেয়ে বেশি নথিভুক্ত হয়েছে)। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছে এই ২৮ কোটি শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। নাম নথিভুক্তি করার উদ্যোগের সাথে সাথে সদস্য সংগ্রহ চলুক। ২০-৩০ হাজার সদস্য সংগ্রহ করে আগামী ৮-৯ জুলাই ২০২৩ তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে AICWF’র সর্বভারতীয় সম্মেলন সফল করার মধ্যদিয়ে একগুচ্ছ দাবি সনদ নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ নেওয়া হোক। সমাজের সবচেয়ে নীচুতলার সর্ববৃহৎ অংশ, শোষিত এই মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই শাসকশ্রেণীর ভিত্তিভূমিকে কাঁপিয়ে দেবে। তাই আসুন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজে নামি। জয়ী হোই।
- কিশোর সরকার
চাকরি জীবনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া ইডি ডিরেক্টর সঞ্জয় কুমার মিশ্রকে স্বপদে রেখে দেওয়ার সময়কাল আরও বাড়িয়েছে কেন্দ্র। এ প্রসঙ্গে ‘অনীতিনিষ্ঠ’ মন্তব্য করে প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনিক মহল থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনৈতিক মহল সব ক্ষেত্র থেকেই। প্রশ্নটি নতুন মাত্রা পেল উপরন্তু সুপ্রীম কোর্টের তিন সদস্যের এক ডিভিশন বেঞ্চ একই জিজ্ঞাসা করে বসায় — শ্রীযুক্ত মিশ্র কী “এতই অপরিহার্য?” প্রত্যুত্তরে কেন্দ্রের সলিসিটার জেনারেল জানান, এই মেয়াদ বাড়ানোর মধ্যে অন্য কোনও উদ্দেশ্য লুকোনো নেই, এফএটিএফ (ফিনানসিয়াল একশন টাস্ক ফোর্স)-এর তরফে পিএমএল আইনে একগুচ্ছ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদের অপরাধের তদন্ত পর্যালোচনা করতে মিশ্রের মতো পোড় খাওয়া অফিসারকে আগামী নভেম্বর পর্যন্ত রেখে দেওয়া হয়েছে মাত্র। তারপরেও বিচারপতিরা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেন, মামলা নভেম্বরের পরে গড়িয়ে গেলে তখন কী হবে? যথারীতি কোনও “উত্তর মেলে না”।
(দ্য টাইমস্ অব ইন্ডিয়া, ৪ মে ২০২৩)
গুজরাত সাম্প্রদায়িক গণহত্যা সংক্রান্ত বিষয়ে নরেন্দ্র মোদী, আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ভূমিকা সম্বলিত ‘দি মোদী কোয়েশ্চেন’ শীর্ষক ডকুমেন্টারি প্রচার করার বিরুদ্ধে বিজেপির জনৈক কার্যকর্তার দায়ের করা মানহানির মামলায় বিবিসি, উইকিমিডিয়া ও ইন্টারনেট আর্কাইভ সংস্থাত্রয়কে তলব করল এক দিল্লী কোর্ট।
(দ্য টাইমস্ অব ইন্ডিয়া, ৪ মে ২০২৩)
শেয়ার গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর অনীতিনিষ্ঠ কার্যকলাপ নিয়ে এবছরের ২৪ জানুয়ারি রিপোর্ট প্রকাশ করার পর ঐ কোম্পানিগুলোর কার্যকলাপ নিয়ে তদন্তের দাবি ওঠে। অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল — আদানিরা শেয়ার আইন লঙ্ঘন করেছে, কোম্পানির ২৫ শতাংশ শেয়ার নিজেদের ও পরিবারের গণ্ডির বাইরে রাখার বিধিকে ভেঙে ঐ ২৫ শতাংশ শেয়ারের অধিকাংশই নিজেদের দখলে নিয়ে এসেছে এবং সন্দেহজনক উৎস থেকে বিনিয়োগ ঘটিয়ে কারচুপির মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যের বহুগুণ বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী সরকার ঐ তদন্তের দাবিতে বাধা দিলে এবং যৌথ সংসদীয় কমিটির অধীনে তদন্তের দাবিকে আটকালেও সুপ্রিম কোর্ট সর্বোচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এম সাপ্রের নেতৃত্বে এক বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে তদন্ত করতে বলে। উল্লিখিত অভিযোগগুলোর অনুধাবনে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবির কোনো ব্যর্থতা ছিল কিনা সেটাই ঐ কমিটির বিচার্য বিষয় হয়। ঐ কমিটি সম্প্রতি তাদের রিপোর্ট জমা করেছে এবং রিপোর্টের বিষয়বস্তুও প্রকাশ পেয়েছে।
কমিটি তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে — আদানিরা আইন ও তার প্রয়োগ বিধি ভেঙেছে, এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ সেবি পায়নি। এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ সেবির হস্তগত হয়নি যার ভিত্তিতে বলা যাবে যে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধিতে আদানিরা কারচুপির আশ্রয় নিয়েছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “সেবির দেওয়া ব্যাখ্যাকে ধর্তব্যের মধ্যে নিলে এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় যে, শেয়ারের দামে কারচুপির অভিযোগ বুঝতে নিয়ন্ত্রকের দিক থেকে ব্যর্থতা ছিল।” আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছেন। তাঁরা বলেছেন, এই সমস্ত বিনিয়োগ আসলে আদানিদেরই টাকা। টাকা ভারত থেকে বিদেশে গিয়ে মরিশাসের মতো করের স্বর্গরাজ্যে নথিবদ্ধ কোম্পানির বিদেশি বিনিয়োগ হিসাবে ফিরে এসে আদানিদের কোম্পানিতেই খাটছে। এবং এই ধরনের বিনিয়োগের পরিমাণ বিপুল হলে কোম্পানির শেয়ারের দামও অতি দ্রুত লাফিয়ে বেড়ে চলে। এই সমস্ত বিদেশি কোম্পানির প্রকৃত পরিচিতি সম্পর্কে রিপোর্টের অভিমত হল, “যে সন্দেহের ভিত্তিতে সেবি আদানিদের নথিভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের (এফপিও) অংশিদারি নিয়ে তদন্তে উদ্যোগী হয় তা হলো এই যে, তাদের মালিকানার কাঠামো ‘অস্বচ্ছ’, কেননা, আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের ভাগিদার ১৩টা বিদেশি সংস্থার মালিকানা শৃঙ্খলের শেষটা স্পষ্ট নয়।” অর্থাৎ, ঐ ১৩টা সংস্থা নামে বিদেশি হলেও সেগুলো গৌতম আদানিরই খাড়া করা কোম্পানি কিনা, সেগুলোর বিনিয়োগের টাকা আদানিদেরই টাকা কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ সেবির থাকলেও তার কিনারা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই ঘটনা সুবিদিত যে, এই ১৩টা বিদেশি কোম্পানি বা তাদের অর্থের দৌলতেই আদানি একেবারে শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, কিছু সময়ের জন্য বিশ্বের তৃতীয় ধনি ব্যক্তির মর্যাদা লাভও করেছিলেন। এই ১৩টা সংস্থায় আবার অর্থ জুগিয়েছে ৪২টা অজ্ঞাত পরিচয়ের জোগানদার যাদের পরিচিতির উন্মোচন ঘটানো সেবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই কোম্পানিগুলোকে খাড়া করার পিছনে যদি আদানিদের হাত থেকে থাকে এবং কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের মধ্যে দিয়ে তাদের হস্তগত শেয়ারের পরিণতিতে যদি মূল কোম্পানি ও তাদের পরিবারের বাইরে ২৫ শতাংশ শেয়ার রাখার বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন ঘটে থাকে, তবে ৪২টা জোগানদারের পরিচিতির উন্মোচন ছাড়া সেটা ধরতে পারা সম্ভব হবে না। এদের পরিচিতির উদঘাটন না হলে আদানিদের টাকাই বিদেশ ঘুরে ভারতে বিনিয়োগ হচ্ছে কিনা তা অবিদিতই থেকে যাবে। বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টে সেবির এই প্রচেষ্টা অভিহিত হয়েছে ‘গন্তব্যহীন যাত্রা’ হিসাবে। অর্থাৎ, ৪২টা অর্থ জোগানদারের পরিচিতির উন্মোচনে সেবি প্রয়াসী হলেও তা তাদের সাধ্যের বাইরে থেকে যাবে। এবং এই অর্থের প্রকৃত উৎস আদানিরা হলেও তার অনুদঘাটন তাদের শঙ্কাহীন এবং কারচুপি ও জালিয়াতিতে আরও বেপরোয়া করে তুলবে।
গৌতম আদানির কোম্পানিগুলোতে সন্দেহজনক বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে চর্চা হালফিলের কোনো বিষয় নয়। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার অনেক আগে তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র ২০২১’র জুলাই মাসেই আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তাঁর প্রশ্ন ছিল — আদানিদের বিরুদ্ধে সেবি, আয়কর বিভাগ, ইডি, কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক, ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইনটেলিজেন্স কোনও তদন্ত করছে কিনা। তার উত্তরে কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধরি ২০২১’র ১৯ জুলাই সংসদে বলেন, “হ্যা, মহাশয়া, সেবির নিয়ন্ত্রণ মেনে চলা বিষয় নিয়ে সেবি আদানি গোষ্ঠীর কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে।” আর সেবি এবছরের ১৫ মে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামায় জানাল — আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ২০১৬ সাল থেকে তাদের তদন্ত চালানোটা ‘তথ্যগতভাবে ভিত্তিহীন’। তাহলে, কে সত্যিটা বলছে — মোদী মন্ত্রীসভার মন্ত্রী না সেবি? মন্ত্রী ও সেবির অবস্থানের এই বৈপরীত্য মহুয়া মৈত্রর কাছে চরম বিস্ময়কর হয়েই ঠেকেছে — “এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য যে ভারতের প্রধান বাজার নিয়ন্ত্রকের আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে এতটাই যোগসাজশ রয়েছে যে সংসদে লিখিত বিবৃতি দিয়ে ওরা মিথ্যা বলছে যে ওরা তদন্ত করছে। অর্থ মন্ত্রকে ওদের ওপরওয়ালারা সংসদে মিথ্যা বলছে যে সেবি তদন্ত করছে।… আর তারপর সেবি সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে বলছে যে তারা তদন্ত করেনি। এটা সত্য বলার হলফ করেও মিথ্যাকথন।”
মহুয়া মৈত্রর সূত্র ধরেই অনামিকা জয়সওয়াল সুপ্রিম কোর্টে তাঁর জনস্বার্থ মামলায় জানিয়েছেন, মরিশাসে নথিবদ্ধ তিনটে কোম্পানি আলবুলা ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, ক্রেস্টা ফান্ড এবং এপিএমএস ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড আদানিদের চারটে কোম্পানিতে (আদানি এন্টারপ্রাইজেস, আদানি গ্রীন এনার্জি, আদানি ট্রান্সমিশন এবং আদানি টোটাল গ্যাস) ৪৩,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এই তিনটে সংস্থার আসল মালিক কারা, আদানিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী, এই বিনিয়োগগুলো কী আদানিদের কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যের বৃদ্ধিতে কোনো অবদান রাখেনি? জয়সওয়ালের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে প্রতিনিধিত্ব করছেন অ্যাডভোকেট প্রশান্ত ভূষণ এবং সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের সামনে তাঁর উপস্থাপনা ছিল এরকম — “এটা একেবারেই পরিষ্কার যে আদানির কোম্পানিগুলোকে আড়াল করার একটা প্রচেষ্টা চলছে। লিখিত আকারে ওদের বলতে হবে ২০১৬ সাল থেকে চালানো তদন্তের ফল কী হয়েছে। আদানিদের শেয়ার মূল্যে যদি ১০,০০০ বা ৫,০০০ শতাংশ বৃদ্ধি হয়ে থাকে তবে বিপদসূচক ঘন্টা অবশ্যই বাজাতে হতো।… সেবি যদি এই ব্যাপারগুলোয় তদন্ত চালিয়ে থাকে তবে বিস্তারিত এই ব্যাপারগুলো ওদের নজর এড়িয়ে গেল কী ভাবে,” অতএব, সুপ্রিম কোর্ট গঠিত প্যানেল তাদের রিপোর্টে সেবির কোনো ত্রুটি খুঁজে না পেলেও আদানির কোম্পানিগুলোতে সন্দেহজনক উৎস থেকে বিনিয়োগ সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নই উত্তরের অপেক্ষায়।
সুপ্রিম কোর্ট হিন্ডেনবার্গের অভিযোগুলো, বিশেষভাবে বিদেশি লগ্নিকারীদের স্বচ্ছতা নিয়ে ২ মার্চ সেবিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে দু’মাসের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করতে বলেছিল। সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেছে ২ মে ২০২৩, এবং সেবি তদন্ত সম্পন্ন করতে সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে আরো ছ’মাস সময় চাইলে সুপ্রিম কোর্ট তাদের তিন মাস সময় দিয়ে ১৪ আগস্টের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছে। এবং নির্দেশ দিয়েছে, সেবি যেন তদন্তকে নানা দিকে না ছড়িয়ে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে উল্লিখিত অভিযোগ অনুসারে কোম্পানির শেয়ার দরে কারচুপি, অর্থাৎ, সন্দেহজনক উৎস থেকে বিনিয়োগ এনে শেয়ার দরের বৃদ্ধি ঘটানো এবং হিসাব-নিকাশের জালিয়াতির ওপরই তাদের তদন্তকে নিবদ্ধ রাখে। সেবি প্রশাসনিক চাপকে অগ্রাহ্য করে কতটা নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারে এবং তাদের তদন্তের মধ্যে হিন্ডেনবার্গ, মহুয়া মৈত্র এবং অনামিকা জয়সওয়ালের তোলা অভিযোগের ওপর কতটা আলোকপাত হয়, তার দিকে আমরা সাগ্ৰহে তাকিয়ে থাকব। তবে, সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটি যেভাবে আদানি ও সেবিকে ক্লিনচিট দিয়েছে, তাতে সেবির তদন্তের অভিমুখ তার থেকে কতটা ভিন্ন হতে এবং তাদের তদন্ত কতটা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ হতে পারবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
সবশেষে একটা বিষয়ের উল্লেখ আবশ্যক হয়েই দেখা দিচ্ছে। অর্থের যে ৪২টা জোগানদার ১৩ বিদেশি সংস্থায় অর্থ জুগিয়েছে, তাদের প্রকৃত পরিচিতির উন্মোচন কি একেবারেই দুঃসাধ্য? এরা ছড়িয়ে রয়েছে সাতটা দেশে — কেম্যান আইল্যান্ড, মালটা, কিউরাকো, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, বারমুডা, আয়ারল্যান্ড ও গ্রেটব্রিটেনে। সেখানে গিয়ে তদন্ত করে এদের সন্ধান পাওয়াটা অসম্ভব নয় বলেই মনে হয়। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত এ এম সাপ্রের নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, এদের লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত জে পি মরগান চেজ, গোল্ডম্যান স্যাকস, সিটি গ্রুপ, ব্যাঙ্ক অব আমেরিকা ও মরগান স্ট্যানলির মতো ব্যাঙ্কগুলোকে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হলেও তারা আসেনি। রিপোর্ট জানিয়েছে, “কোনো আন্তর্জাতিক সিকিউরিটি ফার্ম ও ব্যাঙ্ক এই ব্যাপারে অংশ নিতে আগ্ৰহ দেখায়নি।” ভারতের তদন্তের প্রয়োজনে কেন এদের হাজির হতে বাধ্য করা যাবে না? এটা ঐ কমিটির অক্ষমতাকেই প্রতীয়মান করে। নরেন্দ্র মোদীর ইচ্ছায় আয়কর দপ্তর বিবিসির দিল্লী ও মুম্বই অফিসে হানা দিতে পারলে এবং বিবিসি ভারতের আইনের প্রতি মান্যতা দেখাতে পারলে এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপ্রকাশিত জরুরি তথ্যের উদঘাটনে অবশ্যই বাধ্য করা যায়। কেউ-কেউ এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, যৌথ সংসদীয় কমিটির সেই ক্ষমতা আছে এবং তার সমনকে অগ্রাহ্য করা এদের পক্ষে সম্ভব হবে না। অতএব, সাপ্রের নেতৃত্বাধীন কমিটি ও সেবির অনির্ভরযোগ্য ও ফাঁপা তদন্তের পরিবর্তে প্রশাসনিক চাপকে অগ্রাহ্য করা সনিষ্ঠ তদন্ত ও যৌথ সংসদীয় কমিটির নেতৃত্বাধীন তদন্তের দাবিকে আমাদের দৃঢ়তার সাথে ওঠাতে হবে।
- জয়দীপ মিত্র
জম্মু ও কাশ্মীরের শেষ রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক এখন নরেন্দ্র মোদীর বিষ নজরে। তিনি ২০১৯’র সাধারণ নির্বাচনের আগে জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে ৪০ জনেরও বেশি সিআরপিএফ জওয়ান নিহত হওয়ার ঘটনায় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে মুখ খুলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সিআরপিএফ জওয়ান হত্যাকাণ্ডের পর নরেন্দ্র মোদী প্রশাসনিক ত্রুটি নিয়ে কিছু না বলার নির্দেশ দিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি এখন চুপ থাক’। নরেন্দ্র মোদীর সত্যপাল বিদ্বেষ আরও তীব্র হয়েছে দুর্নীতি সম্পর্কে মোদীর মনোভাব নিয়ে মালিকের মন্তব্যে। মালিক বলেছেন, দুর্নীতি বিষয়টাকে মোদী তেমন ঘৃণা করেন না। আর এই প্রসঙ্গে তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের দুটো প্রকল্প বাতিলের কথা উত্থাপন করেছেন এবং সেই প্রকল্প দুটোতে দুর্নীতি জড়িয়ে থাকলেও (প্রকল্প দুটো পাশ করানোর জন্য ৩০০ কোটি টাকার ঘুষের প্রস্তাব ছিল) আরএসএস-বিজেপি নেতা রাম মাধব প্রকল্প দুটো পাশ করানোর জন্য মালিকের কাছে যে দরবার করেছিলেন সে কথা তিনি ফাঁস করে দিয়েছেন। মালিক তাহলে মোদীর নিশানার বাইরে থাকবেন কি করে? মালিকের অভিযোগের ভিত্তিতে সিবিআই ২০২২’র এপ্রিলে ঐ দুটো প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্তে দুটো এফআইআর করে এবং মালিককে দুবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সিবিআই আবারও গত ২৮ এপ্রিল ঐ প্রকল্প দুটোর একটা নিয়ে — যেটা ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারি কর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প এবং যেটি পেতে মুখিয়ে ছিল মোদী ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতি অনিল আম্বানি — সত্যপাল মালিককে আবারও পাঁচ ঘন্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এখন আবার সিবিআই সত্যপালকে ছেড়ে ঝাঁপাল সত্যপালের ঘনিষ্ঠ ও অনুগত ব্যক্তিদের নাকাল করতে।
গত ১৭ মে ২০২৩ সিবিআই দিল্লীর দশটি ও রাজস্থানের দুটি স্থানে হানাদারি চালায়। সিবিআই’এর নিশানায় ছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল থাকার সময় সত্যপাল মালিকের সংবাদ সচিব সৌনক বালি। নয়াদিল্লীর ডিফেন্স কলোনি ও ওয়েস্ট এন্ডে তাঁর বাড়িতে বুধবার সকাল থেকে সিবিআই তল্লাশি শুরু করে। সিবিআই আরও যাদের বাড়িতে হানা দেয় তাঁদের মধ্যে ছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরে থাকার সময় মালিকের জনসংযোগ অফিসার বীরেন্দ্র সিং রানা এবং ব্যক্তিগত সহায়ক কুনওয়ার সিং রানা। সিবিআই’এর থাবা আরও যাঁর ওপর পরে তিনি হলেন রাজস্থানের বিজেপি নেত্রী ডঃ প্রিয়ঙ্কা চৌধরি। তিনি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান এবং সত্যপাল মালিকের প্রতি অনুগত। রাজস্থানের বারমের ও জয়পুরে তাঁর বাসস্থানে সিবিআই হানা দেয় ও তল্লাশি চালায়। এঁরা ছাড়া ছয় চাটার্ড অ্যাকান্টেন্টের বাড়িতেও সিবিআই তল্লাশি চালায়।
সিবিআই’এর হামলার পর এক সরকারি কর্তা জানিয়েছেন, “আজ যাদের বাড়িতে এবং অফিসে তল্লাশি চালানো হয়, মালিক রাজ্যপাল থাকার সময় তাদের কয়েকজনের জম্মু ও শ্রীনগরের রাজভবনে অবাধ গতিবিধি ছিল।” যে প্রশ্নটা এরসঙ্গেই উঠছে তা হলো — স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পে তদন্তের স্বার্থে সত্যপাল মালিক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বাড়িতে হানাদারি কি অপরিহার্য ছিল? সিবিআই কী যথার্থভাবেই বিশ্বাস করেছিল যে, এই তল্লাশিগুলোয় তদন্তের কিনারার সূত্র মিলবে? সিবিআই’এর অফিসাররা বলছেন, অভিযুক্তদের কাছ থেকে পাওয়া লিখিত ও ডিজিটাল বিভিন্ন নথি বিশ্লেষণ করেই তাঁরা ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ জনগণের চোখে এই হানাদারির মধ্যে মোদী প্রশাসনের মার্কামারা বৈশিষ্ট্যের ছাপই সুস্পষ্ট। কোনো ধরনের বিরোধিতাকে সহ্য না করাটা নরেন্দ্র মোদীর মজ্জাগত অভ্যাস, আর সত্যপাল মালিককেও প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে বৈরীর যা প্রাপ্য তা মিটিয়ে দিতেই তিনি মনস্থ করেছেন বলে মনে হয়। মালিক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে আসলে মালিককেই একটা বার্তা দেওয়া হল। মালিক নিজেও বলেছেন, তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বাড়িতে তল্লাশির আসল উদ্দেশ্য তাঁর হেনস্তা ঘটানো। মালিককে শিক্ষা দিতে এইভাবে তদন্তকে ঢাল করা হলো। তদন্তের এই কপটতার মধ্যে দিয়ে একটা শব্দই সুস্পষ্টভাবে ফুটে বেরোলো — ‘প্রতিহিংসা’।
২০২৪’র সাধারণ নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ক্রমেই সরগরম হয়ে উঠছে। নির্বাচনী আবহে এখন থেকেই শুরু হয়েছে কোন দল কত আসন জয়লাভ করবে, তা নিয়ে জল্পনা ও নানান হিসাব নিকেষ। তূণমূল কংগ্রেস জনগণের কাছে আবেদন করছে ৪০টি আসনে জয়ী না করলে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে থেকে দাবি-দাওয়া আদায় করা যাবে না, কেন্দ্রীয় সরকারে বিরুদ্ধে চাপও দেওয়া যাবে না। ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচনে জমি তৈরির লক্ষ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে হাতিয়ার করতে বিজেপি এবং তূণমূল কংগ্রেস উভয় শাসক পার্টি সামাজিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্র সহ তৃণমূল সরকারের আপাদমস্তক দুর্নীতি আজ রাজ্য রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। আর সেই সুযোগ নিয়ে বিজেপি সিবিআই, ইডি’কে কাজে লাগিয়ে রাজ্যের শাসকদল ও তার নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমেছে। বাংলায় বিজেপি তার সমস্ত ধরনের সংগঠনকে যেমন, আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, এবং ধর্মীয় উৎসব প্রভৃতিকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণের লক্ষ্যে খুব সক্রিয় হয়ে নেমে গেছে ময়দানে। বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে থাকার সুবাদে আরএসএস’এর শাখা এরাজ্যে বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি ধর্মীয় উৎসবকে কাজে লাগিয়ে হাওড়া ও হুগলি জেলায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি ও সামাজিক বিভাজন তৈরি করার ঘৃণ্য খেলায় নামে। উত্তর দিনাজপুর জেলায় কালিগঞ্জে একটি দুঃখজনক প্রেম ঘটিত বিষয়কে মূলধন করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে ব্যাপক নৈরাজ্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করে বিজেপি। ঘটনাস্থলে শাসক পার্টির পঞ্চায়েত প্রধানের ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। স্থানীয় দুই সাংসদ ও বিজেপির অন্যান্য নেতারাও সরাসরি ইন্ধন যুগিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদকে অবজ্ঞা করে নিজের মুঠোয় সমস্ত ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করার নোংরা খেলায় নেমেছে মোদী সরকার। আর, এই কাজে তার সহযোগী হয়েছে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে এই ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা হচ্ছে। ২০২১ সালে বিজেপি বাংলায় ক্ষমতার আসার দিবাস্বপ্ন দেখায়। কিন্তু, বাংলার জনগণ তাকে বেশ ধাক্কা দিয়েছিল। কর্নাটকের নির্বাচন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে, মোদী-বিজেপি বিরোধী গণরায় সারা দেশের জনগণ ও বিরোধী শক্তিকে ২০২৪’র জন্য শক্তি বৃদ্ধি করতে সুযোগ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে এই পরিবেশকে আমাদের পার্টি ও সমস্ত গণসংগঠনকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হতে হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনকে বিচার করতে হবে।
২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচন বাংলার জনগণের কাছে অনেক নেতিবাচক শিক্ষা নিয়ে হাজির হয়। বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় শাসক দলের দখলে আসন সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। রাজনৈতিক সন্ত্রাসের পরিবেশ এবং পুলিশের গুলিতে কোচবিহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছিল। সংবিধানের নিয়মকানুন না মেনে খোলা মঞ্চে হুমকি, খুনের বার্তা, কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে নির্বাচন করা প্রভৃতি প্রচার করেও বিজেপি ফলাফলে বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি। কাজেই ২০২৩’র পঞ্চায়েত নির্বাচন বিরোধী শক্তির কাছে দু’দিক থেকেই এক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসাবে সামনে আসছে।
একদিকে বিজেপি সরকার অন্যদিকে তূণমূল কংগ্রেসের শাসনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করেই পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের রাজ্যের ১০০ দিনের কাজের অর্থ আটকে রেখেছে, বকেয়া মজুরিও পরিশোধ করেনি। কেন্দ্রীয় বাজেটে টাকাও কমিয়ে ১০০ দিনের প্রকল্পকে ১৭ দিনে নামিয়ে আনা হল। প্রতিহিংসা পরায়ণ বিজেপি সরকারের মনোভাব হচ্ছে ‘হাতে মারা ও ভাতেও মারা’র কৌশল। বিজেপির ফ্যাসিবাদি রাজনীতি যেমন পরাস্ত করতে হবে, তেমনি ১০০ দিনের কাজ ও মজুরি এরাজ্যে আটকে রাখার বিরুদ্ধে আমাদের জোরাল আওয়াজ তুলতে হবে। রাজ্য সরকারের পঞ্চায়েত পরিচালনার সাথে বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকারগুলির মধ্যে ফারাক টানা মুশকিল। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে বা সরিয়ে আমলা বা পার্টি নেতারাই আজ মুরুব্বি ও সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই পঞ্চায়েতে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না, গ্রাম সংসদের কাছে হিসাব পেশ করার কোনো নিয়মনীতি চালু নেই। বিধবা ভাতা, বয়স্কদের পেনশন, বা আবাস যোজনা পাওয়ার ক্ষেত্রে কাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে সে সব ক্ষেত্রে বিচার বিবেচনা বা মতামত সংগ্রহ করা হয় না। অর্থাৎ গণতান্ত্রিকভাবে পঞ্চায়েত পরিচালনা করার পদ্ধতিই নেই। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা হল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। কিন্তু এই ব্যবস্থাকে সব রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার নিজ নিজ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে অর্থবল, বাহুবল ও প্রশাসনকে কাজে লাগায়। পশ্চিমবাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক লড়াই। স্বাভাবিক ভাবে গ্রামে গ্রামে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশ গড়ে উঠে। বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে যাদের হাতে রাজনৈতিক দলের সরকার রয়েছে তাদের পক্ষেই ফলাফল যায়। পঞ্চায়েত জনগণের কাছে হিসাব নিকাশ জমা দেয়না। এই অভিযোগ বিস্তর। আমাদের অবশ্যই পঞ্চায়েতের হিসাব জনগণের কাছে তুলে ধরবার আওয়াজ তুলতে হবে। বাংলার শাসককে কাঠগড়ায় তুলে প্রচার সংগঠিত করতে হবে। আমাদের বামপন্থী শক্তির সাথে আসন সমঝোতা করার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসাবে নিজেদের জায়গা করে উঠতে না পারে। বিজেপি ইতিমধ্যে নিজেকে মূল বিরোধী শক্তি হিসাবে তুলে ধরে সব ধরনের শক্তিকে জোটবদ্ধ করার প্রচেষ্টা নিয়েছে। এমনকি সংখ্যালঘু এলাকায় লোকসভা নির্বাচনের কথা ভেবে সেই কাজে জোর দিচ্ছে। গ্রামবাংলায় যাতে বামপন্থীরা কোন জায়গা না পায় সেটাও তাদের লক্ষ্য। তাতে আমাদের বন্ধুরা অনেকাংশে বিভ্রান্ত। আমাদের সেই অবস্থান থেকে তাদের সরাতে হবে। তূণমূল কংগ্রেস বিরোধী প্রধান শক্তি হিসাবে বিজেপি নিজেকে তুলে ধরে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদের পার্টি ও সমস্ত গণসংগঠনকে বিজেপির এই পরিকল্পনা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। আদিবাসী ও সংখ্যালঘু এলাকায় এবং তার সাথে রাজবংশী জনগণের মধ্যে বিজেপি এবং তার সমস্ত শাখা সংগঠনকে রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরণের জন্য উদ্যোগী করে তুলেছে। এই প্রশ্নে আমাদের বুথগুলিকে, পার্টি ব্রাঞ্চ, লোকাল কমিটিগুলিকে সচেতন করার চেষ্টা করতে হবে। ত্রিস্তর পর্যায়ে এই নজরদারী দরকার। আমাদের কাজের অবস্থা অনুযায়ী বেশিরভাগ গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে আমরা জোর দিই কিন্তু রাজনৈতিক বোঝাপড়া ব্লক ও জেলা পরিষদে হয়। এখন থেকে আমাদের সেই দিকটা নজর দিতে হবে। কাজেই এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজনৈতিক দিকটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখন থেকেই সেই সমস্ত দিক মাথায় রেখে আমাদের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
- কার্তিক পাল
২৮ এপ্রিল ২০২৩ আমরা সোদপুর, দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যাপীঠে ছাত্রীছাত্রদের জন্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছিলাম। খুব প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে, সবাই জানিয়েছেন, আমরা সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা যখন আগরপাড়ায় জেলাসভায় ব্যস্ত ছিলাম, তখন আগের সিনেমা প্রদর্শনের সূত্র ধরে ব্যারাকপুর, নোনাচন্দনপুকুর উমাশশী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, অভিজিৎ ঘোষ মহাশয় বিদ্যালয়ে সিনেমা দেখানোর জন্য যোগাযোগ করেন। অনেক কৌতুহলের মধ্যে তিনি প্রশ্ন করেন, কেন এই উদ্যোগ। আমরা বলি, কোভিডে অতিমারীর সময়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষা ও তাদের অবচেতন মন। আজ চারিদিকে মানুষে মানুষে হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজন বেড়েই চলেছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ছাত্রীছাত্রদের মন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানারকম অনায্য কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রীছাত্রদের মন। মানুষ নিজেদের হাতেই গাছ-জঙ্গল কেটে, জল-বায়ু দূষণ করে, পুকুর ভরিয়ে, পাহাড় ফাটিয়ে ধ্বংস করছে পরিবেশকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রীছাত্রদের, শিশুদের মন। শিশুদের স্বপ্নের ডানা মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৭ মে ২০২৩ প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের ডাকে আমরা, মানে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সংগঠন ‘স্টিল এন্ড মুভি প্ল্যাটফর্ম’ ও ‘সিনেমা অফ রেজিস্ট্যান্স’এর কর্মীরা হাজির হই নির্দিষ্ট শিক্ষা অঙ্গনে। সমস্ত টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। প্রর্দশনের জন্য সবকিছু ব্যাবস্থা হয় ও ১৮ মে ২০২৩ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রীছাত্রদের সিনেমা দেখানোর সিদ্ধান্ত হয়। আমরা জানাই, বিশ্বের বহু বিখ্যাত পরিচালকদের শিশু মনোপযোগী সিনেমা নিয়ে আমরা হাজির হবো।
আমরা ১৮ মে ২০২৩ সদলবলে সিনেমার ঝুলি নিয়ে যথা সময়ে হাজির হই। সবধরনের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো ঠিকঠাক করে, বেলা সাড়ে বারোটা থেকে ছাত্রীছাত্র, অভিভাবক, শিক্ষিকা-শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মচারীসহ একশো দর্শকদের সামনে সিনেমা দেখানোর ব্যাবস্থা হয়। প্রধান শিক্ষক মহাশয় আমাদের শুরু করতে বলেন। আমাদের অন্যতম কর্মী মৃত্যুঞ্জয় দে অনুষ্ঠানের ফটো তোলার কাজে ব্যাস্ত থাকেন। স্বস্তিকা সিনেমা স্ক্রিনিং’এর কাজে পেশাদারী মনোভাবে নিয়োজিত থাকেন। আমরা কারা, কেন আমরা স্কুলে স্কুলে সিনেমা দেখাই, এবিষয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সাগর চ্যাটার্জী। দেবলীনা পরিচালিত একটি ছোট্ট মিউজিক ভিডিও ‘ছবির মধ্যে ছবি’র গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। আমরা দেখাই, আব্বাস কিয়ারোস্তমির ‘টু সলুউসন ফর ওয়ান প্রবলেম’, সত্যজিৎ রায়ের ‘টু’, একতারা কালেকটিভের ‘চান্দা কে জুতে’, নর্ম্যান ম্যাকলারেনের ‘নেইবর্স’ এবং অশ্বিন কুমারের ‘লিটল টেরোরিস্ট’ প্রভৃতি পাঁচটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। অন্যতম সংগঠক মিতালি বিশ্বাস প্রতিটি সিনেমা সম্পর্কে ছাত্রীছাত্রদের সাথে একে একে ডেকে ডেকে সজীবতার সাথে প্রশ্ন করে বিস্তারিত কথা বলেন। তিনি ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান ছোট-বড়, উঁচু-নীচ, মেয়ে-ছেলে, গরিব-বড়লোক সমাজকে বিভাজিত করেছে, কলুষিত করেছে। অন্ধকারময় সমাজকে আলো দেখাতে নতুনভাবে গঠন করতে হবে।
এইসব বিষয় নিয়ে ছাত্রীছাত্ররাও ইতিবাচক অর্থে কথা বলতে শুরু করে। সংগঠক অশেষ চক্রবর্তী ও সাগর চ্যাটার্জী সিনেমা কেন শক্তিশালী মাধ্যম ও সিনেমা দেখানোর পর ছাত্রীছাত্রদের মনে কী কী অনুভুতি এনেছে, তা পারস্পরিক ছাত্রীছাত্রদের সাথে মুখোমুখি সংলাপে বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়। দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী সোনালী নন্দী জানান, পরিবারের কারণে নাচ শেখা হল না। সোনালী অব্যক্ত যন্ত্রণায় কেঁদে ফেলেন। মিতালী ও স্বস্তিকা সোনালীকে শান্ত করে। তৃতীয় সিনেমা দেখানোর পর একটা টিফিন ব্রেক হয়। ব্রেকের পর দশম শ্রেণীর ছাত্রী প্রদীপ্তা বড়ুয়া ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটির সাথে নৃত্য পরিবেশন করেন। দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী ফারহিন খাতুন, দশম শ্রেণীর ছাত্র অয়ন পাল, দেবজিৎ দত্ত, শুভম পাল, ছাত্রী ঈশা ঘোষ, পায়েল কর ও কৃষ্ণা মাহাতো বিভিন্ন ভাবে জানায় হিংসা, বিদ্বেষ, বিভাজন, অশান্তি এর একমাত্র বিকল্প ভালোবাসা দিয়ে জয় করা। তারা বলে ধর্মে-ধর্মে, জাতে-জাতে, বর্ণে-বর্ণে বিভেদ নয়, আমরা সবাই মানুষ। সমাজে নারী পুরুষে ভেদাভেদ আছে, এটাও ঠিক নয়, একথা তারা জানায়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র, দেশ, রাজ্য এমনকি পাড়ায় পাড়ায় দূরত্ব ঘুচিয়ে, অভিন্ন মানসিকতা রাখার কথা তারা বলে। আমরা ‘হীরক রাজার দেশে’র একটা ছোট্ট অংশ দেখিয়ে শেষ করি। সবাই এক সাথে বলে, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’। আমরা ‘স্টীল এন্ড মুভি প্লাটফর্ম’ (পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সংগঠন) এবং ‘সিনেমা অফ রেজিস্ট্যান্স’ মিলিতভাবে ছাত্রীছাত্রদের জন্য একটা ফোল্ডার প্রকাশ করি এবং তা ছাত্রীছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করি। ছাত্র-ছাত্রীরা হাততালি দিয়ে বলে, এই ধরনের সিনেমা আবার হবে। প্রধান শিক্ষক ও সহশিক্ষকরা এবিষয়ে জানায়, তারা সহমত। আমাদের এই প্রক্রিয়ায় (প্রোজেক্টঃ সিনেমা ইন স্কুলস) স্বাধীন কল্পনার ডানায় উড়ে ছাত্রীছাত্ররা স্বপ্ন দেখুক নতুন পৃথিবীর। এই নতুন প্রজন্ম নতুন পরিবেশের রূপকারে উজ্জীবিত হোক। তাদের স্বপ্ন সত্যি হোক এই আশা নিয়ে, আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হয়। আপনাদের কাছে আবেদন, স্কুলে, পাড়ায়, শ্রমিক মহল্লায় প্রভৃতি স্থানে আমাদের নিয়ে চলুন। সিনেমার ডালি নিয়ে আমরা চলে যাবো আপনাদের কাছে।
মহিলা কুস্তিগীরদের সমর্থনে মৌলালীতে মোমবাতি নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি
===0===