ভারতবর্ষের সংবিধানে গৃহীত সমাজতান্ত্রিক শব্দটির মর্মবস্তু আজ বিলোপের পথে
constitution-of-india

১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪৬তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটিকে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় যুক্ত করা হয়েছিল। সমাজতন্ত্র বলতে যেটা বোঝায় তাহল উৎপাদনের উপকরণের সামাজিক মালিকানা এবং উৎপাদিত দ্রব্যের সামাজিক বণ্টন। এটা আমাদের ভারতবর্ষে কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “আমাদের সমাজতন্ত্র আমাদের নিজস্ব রীতির সমাজতন্ত্র। যেসব ক্ষেত্রে প্রয়োজন মনে করব সেইসব ক্ষেত্রেই আমরা রাষ্ট্রীয়করণ করব। কেবল রাষ্ট্রীয়করণ করাই আমাদের রীতির সমাজতন্ত্র নয়।” রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প পরিচালনার সাথে সাথে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিল্প গড়ে তোলার বিষয়টিকেও মান্যতা দেওয়া হয়েছিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রেখে সেই সম্পত্তি দেশের স্বার্থেব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম সব সম্পত্তি জাতীয়করণের পরিবর্তে ভারতে মিশ্র অর্থনীতির প্রবর্তন করা হয়েছিল।

ইতিপূর্বেই শিল্প সংস্থার জাতীয়করণ এবং নতুন নতুন রাষ্ট্রীয় শিল্প সংস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ভারতের অর্থনীতিতে সমাজতন্ত্রের বীজ প্রোথিত করার সূচনা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি এবং পরবর্তীতে ইউনিট ট্রাষ্ট, ন্যাশনাল ইন্সিওরেন্স, জীবন বীমা ইত্যাদি জাতীয়করণ করা হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী ভারতবর্ষের দুর্বল অর্থনীতিকে সবল করতে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ভারি শিল্পের। যারজন্য প্রয়োজন ছিল বৃহৎ পুঁজির। সে সময় ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থাগুলির পক্ষে সম্ভব ছিল না সে পুঁজি বিনিয়োগ করা। দেশবাসীর টাকায় সরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক পুঁজি-নিবিড় এবং শ্রম-নিবিড় রাষ্ট্রীয় শিল্প সংস্থা। যেমন রৌরকেল্লা, দূর্গাপুর, ভিলাই, বোকারোর মতো বড় বড় শিল্প। একই সাথে চলতে থাকে আঞ্চলিক উন্নয়ন, কর্ম সংস্থান, দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও অনুসারী শিল্পের বিস্তার। স্বাধীনতার পূর্বে কিছু রাষ্ট্রীয় শিল্প সংস্থা গড়ে উঠেছিল। যেমন অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি, পোর্টট্রাস্ট, অল ইন্ডিয়া রেডিও, পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাম, রেল ইত্যাদি। স্বাধীনতার পর প্রথম ও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় রাষ্ট্রের মালিকানাধীন শিল্প সংস্থা গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং এইসব ক্ষেত্রে সরকারি পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়। এই বিনিয়োগ শিল্পের পরিকাঠামো গড়ে তোলার উপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেমন ব্যাঙ্ক, বীমা, ইঞ্জিনিয়ারিং, সার, ইস্পাত, পেট্রোলিয়াম, বিদ্যুৎ, কয়লা ইত্যাদি। আমরা দেখেছিলাম জাতীয়করণ ও রাষ্ট্রীয় শিল্প গড়ে তোলার দীর্ঘযাত্রায় ভারতের অর্থনীতি অনেকটাই স্বনির্ভরতা অর্জন করেছিল। রপ্তানির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বিশেষ ভুমিকা দেখা গেছে। যেমন হিন্দুস্থান মেশিন টুলস, স্টেট ট্রেডিং কর্পোরেশন, ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড, হিন্দুস্থান স্টিল লিমিটেড, মিনারেলস অ্যান্ড মেটালস ট্রেডিং কর্পোরেশন, ইত্যাদি। অপরদিকে বিদেশের উপর আমদানি নির্ভরতা কমাতে এক বিশাল অবদান দেখা গেছে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, হিন্দুস্থান অ্যান্টিবায়োটিকস লিমিটেড, অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কমিশন, ইন্ডিয়ান ড্রাগস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থাগুলিকে। এই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বিশাল এক সম্ভার গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষে। এটা লক্ষ্যনীয় যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় যেখানে দেশে মাত্র ৫টা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ছিল তা পরবর্তীতে ২০১১ সালে ২৪৮টিতে পরিণত হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মালিকানাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থার সংখ্যা হয়েছিল প্রায় সাড়ে সাতশটি।

১৯৯০ পরবর্তী ভারতের শাসকশ্রেণী ‘নয়া আর্থিক নীতি’ গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাস্ট্রীয় শিল্প সংস্থার উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ এবং বিলগ্নীকরণ শুরু হল। সংস্থাগুলিতে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ কমিয়ে দেওয়া এবং শূন্যপদে নিয়োগ বন্ধ করে চুক্তি প্রথায় নিয়োগ চালু করা হল। যার নামকরণ করা হল ‘স্ট্রাকচারাল রি-এ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’। এই প্রক্রিয়া একদিকে ক্রমশ যেমন নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগকে তলানিতে নিয়ে গেছে তেমনি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে বি-রাষ্ট্রীয়করণ, বিলগ্নীকরণ বা চিরতরে বৃহৎ পুঁজিপতি বা কর্পোরেট সংস্থার কাছে বেঁচে দেওয়ার কর্মকান্ডকে ত্বরান্বিত করেছে। আমরা যদি বিগত প্রধানমন্ত্রীদের সময়কালে রাষ্ট্রীয় শিল্প সংস্থা গড়ে তোলা এবং বেঁচে দেওয়ার সংক্ষিপ্ত খতিয়ান দেখি তাহলে দেখব যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী, গড়ে তোলা, বেচে দেওয়া জহরলাল নেহেরু - ৩৩টি, ০; লাল বাহাদুর শাস্ত্রী - ৫টি, ০; ইন্দিরা গান্ধী - ৬৬টি, ০; মোরারজী দেশাই - ৯টি, ০; রাজীব গান্ধী - ১৬টি, ০; ভিপি সিং - ২টি, ০; পিভি নরসিমা রাও - ১৪টি, ০; আই কে গুজরাল - ৩টি, ০; অটল বিহারি বাজপেয়ী - ১৭টি, ৭টি; ডঃ মনমোহন সিং - ২৩টি, ৩টি, নরেন্দ্র মোদী - ০টি আর বেচে দিয়েছেন ২৩টি।

পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে রাস্ট্রীয় শিল্প সংস্থার অবগতির তীব্রতা। একইভাবে দেশের বিভিন্ন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও সরকারি মালিকানাধীন শিল্প সংস্থার প্রশ্নে এই নীতিকেই অনুসরণ করা হচ্ছে।

ভারতীয় অর্থনীতিকে বিদেশী পুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র নামে বিদেশী পুঁজিকে আমন্ত্রণ জানানো, যৌথ উদ্যোগের নামে সরকারি শেয়ার কমিয়ে পুঁজিপতিদের হাতে সিংহভাগ শেয়ার হস্তান্তর করা, পিপিপি মডেল চালু করার মধ্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে বেসরকারীকরণ এবং চিরকালের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়াটাই আজ মূল নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্যাঙ্কিং সেক্টরগুলিকে পুনর্গঠনের নামে সংকুচিত করা হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণের বোঝা আজ সাধারণ মানুষের উপর চাপানো হচ্ছে। অথচ বড় বড় পুঁজিপতি ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনোরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল না। ব্যাঙ্কশিল্প আজ ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা বিগত দিনে দেখেছি আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় ভারতের আর্থিক ক্ষেত্রটি নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল। বিদেশী পুঁজির অস্থিরতা বা বিদেশী পুঁজির আগ্রাসনের হাত থেকে ভারতীয় আর্থিক ক্ষেত্রকে রক্ষা করতে সার্বভৌম ভারত রাষ্ট্র যে সমস্ত রক্ষাকবচ ও বিধিনিষেধ চালু করেছিল সেগুলিকে দুর্বল করার মধ্য দিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে শুধু সমাজতান্ত্রিক উপাদানগুলিই লুপ্তপ্রায় হয়নি এর সাথে সাথে ভারতীয় অর্থনীতি আজ এক অত্যন্ত বিপদজনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নের নামে বা আর্থিক সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে বিদেশী ঋণের বোঝা আজ আকাশ ছুঁতে চলেছে। বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, ইন্টারন্যাশানাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট, ইন্টারন্যাশানাল ব্যাঙ্ক অফ রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের মতো সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে ভারত। ২০২০-২১ সালে ঋণের পরিমান দাঁড়িয়েছে ১৯৭ লক্ষ ৪৫ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এই ঋণের টাকা শোধ করতে জনগণের উপর ক্রমশ বাড়বে করের বোঝা এবং বিক্রি করা হবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও সরকারি জমি।

জনগণের আয় নিম্নমুখী হওয়ার কারণে বিশাল এক আর্থিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৪ সালে দেশের ১ শতাংশ ধনকুবের হাতে ছিল দেশের ৪৯ শতাংশ সম্পদ। ২০১৫ সালে ৫৩ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে তা হয়েছে ৭০ শতাংশ।

এই আর্থিক বৈষম্য, জাতীয় সম্পদ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বিলোপ শেষ বিচারে ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে যে সমাজতান্ত্রিক মর্মবস্তু একদিন প্রোথিত হয়েছিল তার বীজ উৎপাটন ছাড়া আর কিছুই না। সময় থাকতে ভারতীয় জনগণকেই সজাগ হতে হবে যাতে ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক উপাদানগুলিকে রক্ষা করা যায়।

- দিবাকর ভট্টাচার্য্য

খণ্ড-30
সংখ্যা-7