মোদী সরকারের নামানো বেলাগাম জরুরি অবস্থাকে প্রতিরোধ করুন
modi-regime

ত্রিপুরায় অল্প ব্যবধানে ক্ষমতা ধরে রাখার পর মোদী সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে এক সার্বিক আক্রমণ নামিয়েছে, এবং সেটা তারা করছে রাস্তার ক্ষমতা, প্রচার ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভয়াবহ সমন্বয় ঘটিয়ে যেটা এই ফ্যাসিবাদী জমানার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। ত্রিপুরায় মোটামুটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পর সংঘ বাহিনী রাজ্যে নতুন করে সন্ত্রাস, প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও হিংসার এক রাজত্ব নামিয়েছে, তারা বিরোধী দলগুলো, তাদের ভোটার এবং এমনকি সন্ত্রাস কবলিত রাজ্যটা পরিদর্শনে যাওয়া বাম ও কংগ্রেসের বিধায়ক ও সাংসদদের নিয়ে গঠিত তথ্যানুসন্ধানী দলের ওপরও আক্রমণ হানছে। এরই সাথে রাজ্য বিধানসভায় প্রধান অ-বিজেপি দল হিসাবে উঠে আসা আঞ্চলিক দল টিপ্রা মোথার বিরোধিতার ধারকে ভোঁতা করে দিতে মোদী সরকার ঐ দলের দাবির ‘সাংবিধানিক সমাধান’ খুঁজে পেতে এক মধ্যস্থতাকারীকে নিয়োগ করতেও সম্মত হয়েছে।

মেঘালয়ে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকারের শরিক থাকা বিজেপি ঐ সরকারকে সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিপরায়ণদের অন্যতম বলে অভিযুক্ত করার পর আলাদাভাবে নির্বচনে লড়ে। নির্বাচনে বিজেপি মাত্র দুটো আসনেই জয়লাভ করতে পারে, এবং নির্বাচন শেষ হওয়ার পর বিজেপি ঐ সরকারের শরিক হওয়ার জন্য সেই এনপিপি-র সঙ্গেই হাত মিলিয়েছে। তরুণ গগৈ নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারে গুরুত্বের দিক থেকে দু-নম্বরে থাকা হিমন্ত বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে বিজেপির আনা দুর্নীতির অভিযোগকে আমরা ভুলে যাইনি। হিমন্ত বিশ্বশর্মা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর সাংবাদিকরা তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কথা অমিত শাহকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ঐ প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন এবং নির্লজ্জভাবে সাংবাদিকদের বলেন যে ঐ প্রশ্ন ওঠানো উচিত নয়! হিমন্ত বিশ্বশর্মা আজ শুধু আসামের বর্তমান বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি-নেতৃত্বাধীন উত্তর-পূর্বাঞ্চল গণতান্ত্রিক জোটের প্রধানই নন, তিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সংঘ বাহিনীর ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বর্শা মুখ।

দুর্নীতি এবং অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত যে কোনো নেতার পক্ষে বিজেপিতে যোগদানই সবচেয়ে ফলপ্রসূ বীমা প্রকল্প হয়ে উঠেছে। বস্তুত, বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতা প্রকাশ্যেই যে কোনো কেন্দ্রীয় সংস্থার দ্বারাই তদন্ত থেকে তাঁদের অব্যাহতির বড়াই করে থাকেন। কর্নাটকে এক ক্ষমতাশালী বিজেপি বিধায়কের ছেলের অফিসে তল্লাশি চালানোর জন্য লোকায়ুক্ত কর্মীরা চাপ প্রয়োগ করেন, এবং ঐ তল্লাশি থেকে নগদ ছ-কোটি টাকা পাওয়া যায়। মধ্যপ্রদেশে তদন্তে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলেও লোকায়ুক্তকে অকেজো করে রাখা হচ্ছে, কেননা, অভিযোগ খাড়া করার কোনো অনুমতি সরকার দিচ্ছে না। বিজেপি এইভাবে যখন দুর্নীতিপরায়ণদের কাছে অবিসংবাদী আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে, মোদী সরকার তখন ইডি ও সিবিআই-এর মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে বিরোধীদের তাড়া করছে, যে সংস্থাগুলো এখন তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডার চরিতার্থতায় সরকারের পুরোদস্তুর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলই, বিশেষভাবে যারা ক্ষমতায় রয়েছে, মোদী সরকারের এই প্রতিহিংসাপরায়ণ ও নিগ্ৰহের ঔদ্ধত্যপূর্ণ অভিযানের ধাক্কার মুখে পড়ছে।

২০২৪-এর নির্বাচনের আগে মোদী সরকার বিহারের রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। ২০১৫ সালে বিজেপিকে যখন নীতীশ কুমারের জেডিইউ-র সমর্থন ছাড়াই বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল, তাদের মোট আসনসংখ্যা কমে গিয়ে ৫৩-তে দাঁড়িয়েছিল। এরপর সরকার আরজেডি নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে জেডিইউ-আরজেডি জোটকে ভেঙে দিতে সমর্থ হয় এবং নতুন করে জোট বাঁধা বিজেপি-জেডিইউ-এলজেপি নেতৃত্ব ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিহারে বিপুলভাবে জয়ী হয়। জেডিইউ ২০২২ সালে পুনরায় আরজেডি-বাম-কংগ্রেস মহাজোটে যোগ দেওয়ায় বিহারের এই জোটকে ভাঙ্গার জন্য বিজেপি মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের ত্রিমুখী রণনীতির লক্ষ্য হল সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলা, জোটকে কালিমালিপ্ত করা এবং দলগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করে এবং নতুন মিত্রদের টেনে নিয়ে বিজেপির অনুকূলে রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসকে রূপায়িত করা। লালু প্রসাদ যাদবের গোটা পরিবারকে নিশানা বানাতে পুরনো মামলাগুলোকে পুনরায় চালু করা হয়েছে। এমনকি পাটনায় জাল ভিডিও তুলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে এই ভূয়ো আখ্যান বানানোর চেষ্টা হয়েছে যে তামিলনাড়ুতে বিহারী শ্রমিকদের মারধর এবং এমনকি হত্যা করাও হচ্ছে, যদিও বিহারে শাসক জোট এবং তামিলনাড়ুর শাসক দলের মধ্যে সখ্যতা রয়েছে।

ইডির চালানো তল্লাশি অভিযানগুলোর মধ্যে দিয়ে সরকার দুর্নীতি-বিরোধী জেহাদের এমন এক নজরকাড়া দৃশ্য সৃষ্টি করতে চাইছে যা অনেকটাই ২০১৬’র নভেম্বরের বিমুদ্রাকরণের মতো যেটাকে কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে চালানো হয়েছিল। এই তল্লাশি অভিযানগুলো ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এবং প্রায়শই দেখা যায় যে, ইডি তল্লাশির ফলাফল নিয়ে কোনো সরকারি বিবৃতি না দিলেও মিডিয়া অনুল্লেখিত ‘সূত্র’কে উদ্ধৃত করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার সত্যতা যাচাই না করা দাবির ভিত্তিতে দুর্নীতি সম্পর্কে একটা ধারণা সৃষ্টি করে। সংসদে সরকারের নিজের স্বীকারোক্তিই জানিয়েছে, ২০২২-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত ইডি অর্থ নয়ছয়ের যে ৫৪২২টি মামলা চালিয়েছে তার মধ্যে মাত্র ৯৯২টির ক্ষেত্রে চার্জশিট পেশ হয়েছে এবং মাত্র ২৩ জন অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। স্পষ্টতই, ইডির সক্রিয়তার লক্ষ্য অনেকটাই হল প্রচারের মধ্যে দিয়ে কৌশলে জনগণের ধারণাকে প্রভাবিত করা, রাজনৈতিক দিক থেকে সরকারের বিরোধীদের হুমকি দেওয়া ও কালিমালিপ্ত করা এবং মিডিয়ায় সরকারের সমালোচনামূলক কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়া। এই বিষয়টার উল্লেখও যথেষ্ট শিক্ষাপ্রদ যে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মতো ইডিও পরিচালিত হচ্ছে বেছে নেওয়া এক আমলার দ্বারা। সরকার ২০২১-এর নভেম্বরে আইন সংশোধন করে ইডি ও সিবিআই প্রধানের জন্য নির্ধারিত দু-বছরের সময়কালকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করে এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে লঙ্ঘন করে ইডির বর্তমান প্রধান সঞ্জয় মিশ্রের কার্যকালের মেয়াদ রেকর্ড সংখ্যক তিন বার বৃদ্ধি করে।

মোদী সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ণ ও নিপীড়নমূলক শাসনধারাকে অঘোষিত জরুরি অবস্থা বলে বর্ণনা করাটা আর যথেষ্ট নয়। এটা লাগামছাড়া জরুরি অবস্থা এবং ভারতের জনগণ ও বিরোধী পক্ষ এতে যদি রাশ টানতে না পারে তবে স্বৈরাচারী শাসন উদ্ধত রূপে প্রকট হওয়ার দিকে চলে যাবে। ১৯৭০-এর দশকে জরুরি অবস্থা থেকে অব্যাহতি পেয়ে এগিয়ে যাওয়ার সম্বল ভারতের ছিল। ২০২০-র দশকে ভারতকে আবার জনগণের সেই গণতান্ত্রিক দৃঢ়তাকে জাগিয়ে তুলে ও তার আত্মপ্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী বিনাশকে রুখে দিতে হবে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৪ মার্চ ২০২৩)

খণ্ড-30
সংখ্যা-7