প্রতিবেদন
জম্মু ও কাশ্মীরে নাগরিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার হীনতার, বৈষম্যের শিকার হওয়ার দায় নরেন্দ্র মোদী সরকার অস্বীকার করতে পারে না
Narendra Modi govt cannot deny

জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদার বিলোপ ঘটিয়ে ২০১৯’র আগস্টে যখন রাজ্যটাকে দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হলো, ৩৭০ ও ৩৫এ ধারার বিলোপ ঘটানো হলো, কেন্দ্র সরকারের মতে সেই পদক্ষেপে নাকি জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ ‘খুশি’ হয়েছিল। আর সেই ‘খুশি’র নিদর্শন হিসাবে জনগণ দেখেছিলেন প্রায় সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে গৃহবন্দী করা হয়েছে, ইন্টারনেট সহ সংযোগের সমস্ত মাধ্যমকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে। সেই পদক্ষেপের লক্ষ্য হিসাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জঙ্গি কার্যকলাপের দমনকে তুলে ধরা হয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর আজ দেখা যাচ্ছে সেনাপীড়ন জনগণের ঘাড়ে আরো জোরালো হয়ে চেপে বসেছে, সেখানে একরকম সামরিক শাসনই চলছে; গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন, জঙ্গিরা তাদের সন্ত্রাসের স্বাক্ষর রেখে চলেছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার দাবি প্রতিদিনই প্রহসনে পরিণত হচ্ছে, আর জম্মুতে পুনর্বাসনের কাশ্মীরী পণ্ডিতদের দাবিতেও কোনো ছেদ পড়ছে না। এরই ধারাবাহিকতায় এখন আবার সামনে আসছে বৈষম্যের অভিযোগ, যে বৈষম্য চালিত হচ্ছে জাত ও ধর্মকে কেন্দ্র করে, ভুক্তভোগীদের মতে যার শুরু হয়েছে রাজ্য মর্যাদা হরণের পর লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বকলমে বিজেপি শাসনের পথে।

কাশ্মীরী পণ্ডিতরা যদি জঙ্গি হামলার শিকার হয়ে থাকেন তবে মুসলিমরাও জঙ্গি হামলার শিকার কম হননি। কাশ্মীর পুলিশই সম্প্রতি জানিয়েছে যে, জঙ্গি হামলায় হিন্দুদের তুলনায় মুসলিমদের নিহত হওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু প্রশাসন প্রদত্ত অনুদানের ক্ষেত্রে মুসলমানরা এবং এমনকি হিন্দু দলিতরাও ব্রাহ্মণদের তুলনায় অনুদান পাচ্ছেন অনেক কম। গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ রাজৌরিতে সেনা শিবিরের বাইরে নিহত হলেন দুই দলিত যুবক সুরেন্দ্র কুমার ও কমল কিশোর, যারা সেনা ক্যান্টিনে মাল বাহকের কাজ করত। ঐ দুই দলিত যুবক জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হয়েছে বলে সেনারা চালাতে চাইলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন ঐ দুই দলিত যুবক নিহত হয়েছে প্রহরারত সেনার গুলিতেই। এমনকি বিজেপির নেতৃবৃন্দও দুই যুবকের হত্যায় সেনা সদস্যকেই দায়ী করেছেন। দুই যুবক নিহত হওয়ার পর ডেপুটি কমিশনার বিকাশ কুন্দল ঘোষণা করেন, নিহতদের পরিবারের সদস্যদের এক লক্ষ টাকা করে অনুদান ও সরকারি চাকরি দেওয়া হবে। পরদিন লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা আরও পাঁচ লক্ষ টাকা করে অনুদান প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু নিহতদের পরিবারের সদস্যরা কি কাজ পাবে? প্রশাসনের চালিয়ে যাওয়া বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে সন্দিহান নিহত দলিত যুবক সুরেন্দ্র কুমারের ভাই কোশল বিশ্ব। তিনি জানিয়েছেন, “আমরা টাকা পেয়েছি, কিন্তু কাজ পাইনি। কাজ পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ডাংরির ঘটনায় এলজি সাহাব নিজে অর্থ ও কাজের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।” অর্থাৎ, ডাংরির হত্যাকাণ্ডে (যার প্রসঙ্গে একটু পরে আসা হবে) লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা নিজে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আর তাঁদের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি যেহেতু এসেছে ডেপুটি কমিশনারের কাছ থেকে, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের সম্ভাবনা তাই ক্ষীণ বলে মনে হয়েছে সেনার গুলিতে নিহত দলিত যুবকের ভাইয়ের কাছে।

জঙ্গিদের আক্রমণে কাশ্মীরের বহু মুসলিম নিহত হলেও প্রশাসনের সদাশয়তা তাদের প্রতি তেমন বর্ষিত হয়না। জঙ্গিদের হাতে নিহত কাশ্মীরী পণ্ডিত অজয় পণ্ডিতিয়ার পরিবার পেয়েছে ২০ লক্ষ টাকার অনুদান। নিহত ব্যক্তি কাশ্মীরী পণ্ডিত হওয়ায় প্রশাসন টাকার থলি উজাড় করতে একটুও দ্বিধা করেনি। জঙ্গিদের হাতে নিহত বিজেপির কিষাণ মোর্চার কুলগাম সভাপতি গুলাম রসুল দরের পরিবার প্রশাসনের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু পায়নি। তার ছেলে আরশাদ আহমেদ দরের কাছে বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে এবং তাদের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক বঞ্চনার যে প্রকাশ সে ঘটিয়েছে তাকে অন্যায্য বলে মনে করার কোনো কারণ থাকতে পারেনা — “ওরা (অজয় পণ্ডিতিয়ার পরিবার) পণ্ডিত বলে পেয়েছে আর আমরা পাইনি। আমার বাবা অনেক বছর বিজেপির সঙ্গে ছিলেন, কিন্তু সেটা কোনো কাজে দেয়নি। আমরা শুধু প্রতিশ্রুতিই পেয়েছি।” আরশাদ আরো জানিয়েছেন, তারা রেডক্রসের কাছ থেকে এক লাখ টাকা পেলেও সরকার তাদের কোনো অনুদান দেয়নি। জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন সব সম্প্রদায়ের নাগরিককে সমান চোখে দেখে না, সেই বোধ বৈষম্যের শিকার মুসলিমদের মধ্যে যথেষ্ট মাত্রায় রয়েছে এবং সর্ব জম্মু ও কাশ্মীর পঞ্চায়েত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান শফিক মিরের মুসলিমদের ক্ষেত্রে বঞ্চনার অভিযোগ তাই অত্যন্ত সঙ্গত হয়েই দেখা দেয় — “কেউ কেউ এক লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছে, অন্যরা কিছুই পায়নি। ওদের ধর্মের জন্যই সম্ভবত ওদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হয়েছে।”

এবার আসা যাক জম্মুর রাজৌরির ডাংরিতে ঘটা জঙ্গি আক্রমণের ঘটনায়। নতুন বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি জঙ্গিরা ডাংরি এলাকায় একটা বাড়ি লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় যাতে পাঁচজন নিহত হন। পরদিন জঙ্গিদের রাখা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় এক শিশু ও এক কিশোর। এই নিহতরা সবাই ছিল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের এবং লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা নিহত প্রতিটি পরিবারের জন্য দশ লক্ষ টাকা অনুদান ও সরকারি কাজের লিখিত প্রতিশ্রুতি দেন। নিহতদের ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোর এই প্রাপ্তির প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ না হয়েও প্রশাসনের অসম আচরণ দৃষ্টির বাইরে থাকে না। এসসি, এসটি এবং ওবিসি সংগঠনগুলোর সারা ভারত কনফেডারেশনের জম্মু ও কাশ্মীরের সভাপতি আর কে কালসোত্রা তাই বলতে বাধ্য হন, “তোমরা জীবিতকালে জনগণকে সমান চোখে দেখোনি, অন্ততপক্ষে মৃত্যুতে সমান বলে গণ্য করো। ডাংরিতে নিহতদের জন্য ১০ লক্ষ টাকা ও কাজ, কিন্তু রাজৌরিতে নিহতদের জন্য মাত্র ৫ লক্ষ টাকা।” রাজৌরিতে সেনার গুলিতে নিহতরা দলিত সম্প্রদায়ের যুবক ছিল। অতএব, জঙ্গিদের গুলিতে মুসলিম ও দলিতরা নিহত হলেও তাদের বিষম চোখে দেখতে প্রশাসনের ভুল হয় না।

জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা এবং ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বিলোপের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল জঙ্গি দমন, কিন্তু সরকার তাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জঙ্গিরা কাশ্মীরী পণ্ডিতদের সঙ্গে অন্যান্য হিন্দু, শিখ ও মুসলিমদের হত্যা করে চলেছে এবং নাগরিক জীবন রক্ষায় নিজেদের অক্ষমতাকে আড়াল করার সরকারের কোনো যুক্তিই আর বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। তবে, জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা হরণের সঙ্গে একটা অঘোষিত লক্ষ্যও ছিল, আর সেটা হলো বিজেপির নিজের মার্কামারা চিন্তাধারার, ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন ও বিদ্বেষের ভিত্তিতে জম্মু ও কাশ্মীরকে শাসন করা। ওপরে অনুদানের ক্ষেত্রে যে বৈষম্যকে আমরা দেখলাম তা এই ভাবধারারই অনুসারী। ‘কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্র নিয়ে নরেন্দ্র মোদী থেকে গোটা বিজেপি নেতৃত্ব যে উন্মাদনার সৃষ্টি করলেন, তার পিছনেও কাজ করেছে বিদ্বেষ ও বিভাজনের এই মানসিক প্রবণতা। ঐ চলচ্চিত্রে পণ্ডিত-বিরোধী হিংসায় মুসলিমদের জঙ্গি সহযোগী বলে দেখানোটা শুধু প্রকৃত তথ্যের বিকৃতি সাধনই নয়, হিন্দুত্ববাদী মুসলিম বিদ্বেষের ছাঁচে ঢেলেই তার নির্মাণ হয়েছে। তবে, ঐ চলচ্চিত্রকে বিজেপি তাদের মুসলিম বৈরিতার প্রচারের অবলম্বন করলেও তা কাশ্মীরী পণ্ডিতদের বিপন্নতাকেই বাড়িয়েছে। আর কাশ্মীরের জনগণ নিজভূমিতে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা, বঞ্চনা ও অবমাননার শিকার হচ্ছেন, প্রশাসনের দলনে ও জঙ্গিদের জুলুমে। রাজ্যপালই জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধি বলে ৩৭০ ধারার যে বিলোপ ঘটানো হয়েছিল তা সংবিধানসম্মত ও ন্যায়সংগত ছিল কিনা, সেই মামলা আজ পর্যন্ত শোনার সময় করে উঠতে পারলনা সুপ্রিম কোর্ট। এবং বিচার অমীমাংসিত রেখে মোদী সরকারেরই সুবিধা করে চলেছে সর্বোচ্চ আদালত। জম্মু ও কাশ্মীরে এই মুহূর্তে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের হাতেই চলছে তার শাসন। কাজেই, জঙ্গি সক্রিয়তায় রাশ টানতে না পারা, নাগরিক জীবনে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া, জনগণের ওপর সামরিক পীড়ন চাপিয়ে দেওয়া ও তাদের অধিকার হরণের দায়ও মোদী সরকারের ওপরই বর্তায়, হাজারো যুক্তিতেও তা খণ্ডনীয় নয়। এই দায়ের যুক্তিসংগত পরিণাম যা হওয়া উচিৎ, বিজেপিকে তার মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে ভারতের জনগণকেই।

খণ্ড-30
সংখ্যা-2