সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই সেদিন জানাল যে, সারা ভারতে এনআরসি চালু করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। এই বক্তব্য ও ২০১৯-এর নভেম্বর মাসে সংসদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দেওয়া বিবৃতি পরস্পর বিরোধী। সেই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছিলেন, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই আসামে উদ্যোগটাকে নামানো হয়েছিল। সারা দেশেই এনআরসি চালু করা হবে, সে সময়ে আসামে আবার তা করা হবে, কোন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত কোন মানুষেরই উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই।” সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরআইসি-এনপিআর-এর বিরুদ্ধে সারা দেশে অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সংসদ এবং জনগণকে ভুল বোঝাচ্ছে যে এনআরআইসি এবং এনপিআর-এর সঙ্গে সিএএ-র কোনো সম্পর্ক নেই এবং এইভাবে তারা মরিয়া হয়ে সিএএ-কে রক্ষা করতে চাইছে।
২০১৯-এর ডিসেম্বরের শেষের দিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা জাতীয় জনগণনা পঞ্জিকে (এনপিআর) হালনাগাদ করার জন্য ৩৯৪১.৩৫ কোটি টাকা অনুমোদন করে। এনপিআর-এনআরআইসি-সিএএ-র গোটা প্রকল্পটার মধ্যে এনপিআরই হল সবচেয়ে বিপজ্জনক পদক্ষেপ, এর মধ্যে দিয়ে সরকার যে কোন নাগরিককেই ‘সন্দেহজনক’ বলে ছাপ মেরে দিয়ে নাগরিকদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে পারে। আসামে ‘সন্দেহজনক’ ভোটার বলে ছাপ মারা ব্যক্তিদের আটক শিবিরে পচতে পাঠানো হয়েছে।
বাজপেয়ী সরকার নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন ২০০৩ (২০০৩ সালের সিএএ) পাশ করেছিল এবং তাতে এনপিআর ও এনআরআইসি-কে উত্থাপন করা হয়েছিল। সিএএ ২০০৩-এর ৪ নং রুলের সাব-রুল (৪)এ বলা আছে, “জনগণনা পঞ্জির (অথবা এনপিআর-এর) সত্যতা নিরূপণের সময়—যা হল এনআরআইসি প্রস্তুত করার আগে এক পদক্ষেপ—একজন তহশিলদার অথবা “উপ-জেলা বা তালুক রেজিস্ট্রার”-এর কোনো ব্যক্তি বা পরিবারকে “সন্দেহজনক” নাগরিক বলে চিহ্নিত করার ক্ষমতা থাকবে, এবং তা করার জন্য কোনো কারণ বা ভিত্তির উল্লেখের দরকার হবে না। এটা বিশাল আকারের দুর্নীতির দরজা খুলে দেবে। এটা শাসক দলের প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ভোটার তালিকা তৈরির এবং বিরোধীদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুযোগ সরকারকে দেবে। এটা সর্বোপরি সমগ্ৰ জনগণকে নিয়ন্ত্রিত করা ও ভয় দেখানোর সুযোগ করে দেবে: কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন গড়তে চাইলে বা কোন নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন করলে তাদের “সন্দেহজনক” নাগরিক বলে ছাপ মারার ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হবে।
২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইনে যে সংশোধন করা হয়েছিল এবং তার জন্য যে রুল বানানো হয়েছিল, সংসদ যদি সেগুলো থেকে এনপিআর ও এনআরআইসি-র সংস্থানগুলোকে বাদ দেয় এবং বর্তমানে যে এনপিআর প্রক্রিয়া চলছে তাকে অবিলম্বে বন্ধ করা এবং এর আগে এনপিআর-এর জন্য সংগৃহীত তথ্যগুলোকে যদি নষ্ট করে দেওয়া হয়, তবেই এনআরসি-কে থামানো সম্ভব।
সরকার সংসদে বলেছে যে, “কেবলমাত্র এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের রাখার জন্য’’ আসামে কোনো আটক শিবির তৈরি করা হচ্ছে না এবং এই কথা বলে সরকার সংসদকে বিভ্রান্ত করেছে। আসল তথ্য হল সরকার আসামের গোয়ালপাড়ায় এক নতুন আটক শিবির গড়ার জন্য ৪৭ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে, এছাড়া, আসামে ইতিমধ্যেই ৬টি আটক শিবির চলছে যেগুলিতে আটক থাকা ৩০ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। পুরনো আটক শিবিরগুলোতে বিদেশী ট্রাইবুনাল আইনের অধীনে “ডি-ভোটার” (সন্দেহজনক ভোটার) রূপে চিহ্নিত ব্যক্তিদের রাখা হয়। এনআরসি তালিকা থেকে যারা বাদ পড়বে তাদেরও বিদেশী ট্রাইবুনাল-এর মুখোমুখি হতে হবে। ট্রাইবুনাল তাদের যদি নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দেয় তবে তাদের আটক শিবিরগুলোতে পাঠানো হবে—যার মধ্যে গোয়ালপাড়ায় যে নতুন আটক শিবির তৈরি হচ্ছে সেটিও রয়েছে।
সরকার এখন ‘আটক শিবির’-এর (ডিটেনশন সেন্টার) বদলে অন্য একটা শব্দবন্ধ ‘অবস্থান শিবির’ (হোল্ডিং সেন্টার) ব্যবহার করছে এবং এইভাবেও সংসদ ও জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। অভিধা যাই হোক না কেন, এই শিবিরগুলো মূলগতভাবে বন্দী শিবির (নাজিদের শিবিরের মতো) যেখানে কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত না হয়েও বিচার ছাড়াই জনগণকে অনির্দিষ্টকাল ধরে আটক রাখা যাবে।
সিপিআই(এমএল) দৃঢ়ভাবে দাবি জানাচ্ছে যে, সরকারকে এনপিআর এবং এনআরআইসি বাস্তবায়িত করার সমস্ত উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে এবং বিদ্যমান ও নতুন হতে চলা সমস্ত আটক শিবির তুলে দিতে হবে। এনপিআর, এনআরআইসি এবং আটক শিবিরগুলোতে কর দাতাদের লক্ষ-লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় না করে—যেগুলোর মধ্যে দিয়ে অসংখ্য ভারতীয়র ভোটাধিকার ও মানবাধিকার হরণ হবে—প্রতিটি ভারতবাসীর উৎকৃষ্ট স্কুল শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি সুনিশ্চিত করতে ঐ টাকা ব্যয় করা হোক।