নভেম্বর ২০১৯-এর ৫ থেকে ১০ তারিখ ‘উইমেন্স এগেইনস্ট সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স অ্যাণ্ড স্টেট রিপ্রেশন’-এর নয় জনের এক দল আসামে তথ্যানুসন্ধান চালায়। বাঙালি (হিন্দু ও মুসলমান) সংখ্যাধিক্যের বরাক উপত্যকা, ‘মিঞা’ বা মুসলিম চাষি অধ্যুষিত চর চাপরি গ্রামগুলি (নদীর চর ও ব্রহ্মপুত্রপাড়ের বসতি), জোরহাট, শিবসাগর ও হোজাই জেলা যেখানে ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা অনেক মানুষের বাস এবং ঝাড়খন্ড তথা ছোট নাগপুর এলাকা থেকে আসা পরিযায়ি শ্রমিকদের আবাসস্থল চা বাগিচাগুলিতে এই টিমটি শ্রমিক কৃষক এক্টিভিস্ট বুদ্ধিজীবী সহ বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে এনআরসি-র ফলাফল সম্পর্কে জানাবোঝার চেষ্টা করে। প্রাপ্ত তথ্য ও সত্য তুলে ধরে এই টিমের পক্ষ থেকে গত ২৬ নভেম্বর ২০১৯ কলকাতা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। তাঁদের অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে —
এনআরসি প্রকৃতপক্ষে বহু মানুষকে নাগরিকত্ব অধিকার বাদ দেওয়ার সচেতন প্রক্রিয়া। জমির দলিল বা বার্থ সার্টিফিকেট ইত্যাদি ডকুমেন্ট দিয়ে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করা বেশিরভাগ মানুষ বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত প্রান্তিক নিপীড়িত জনগোষ্ঠির মহিলারা বিশেষ ভুক্তভোগী। ডকুমেন্টের পেছনে প্রচুর খরচ করতে হয়েছে। সম্পূর্ণ এলোপাথাড়ি প্রক্রিয়া। একই পরিবারের কারও নাম আছে তো কারও নাই। “বহিরাগত” বা “ইল্লিগাল মাইগ্রান্ট”-এর বয়ানই প্রাধান্যকারী চিন্তা হিসেবে থাকায় বাদ পড়ার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে ইচ্ছা করেই। একবার লিগাসি ডেটা দেওয়ার পর তা সংশোধনের আর সুযোগ দেওয়া হয়নি। শিশুদের অধিকারকে চরমভাবে অবমাননা করা হয়েছে। বর্তমান নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ি ১৯৮৭ সালের আগে জন্মানো ব্যক্তিদের জন্মের প্রমাণপত্রই যথেষ্ট হওয়ার কথা, কিন্তু সেরকম মানুষদের ক্ষেত্রেও লিগাসি ডেটা চাওয়া হয়েছে। জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট ২০১৫-কে কোথাও মানা হয়নি। কেবলমাত্র নামের বানান ভুল থাকার কারণে বাদ গেছে অনেকে। বিভিন্ন সরকারি নথিতে বিভিন্ন বানান থাকার বিষয়টি তো সরকারের গাফিলতি। অন্যদিকে ‘খাতুন’ ও ‘বেগম’ যে অবস্থাভেদে একই ব্যক্তির নামে যুক্ত থাকতে পারে সেটুকু বোধও সরকারী কর্মীরা দেখায়নি। এমনকি এনআরসি সেবাকেন্দ্রে (NSK)-র কর্মী অভিযোগ দায়ের করেছে যে ‘আলি’ কী করে ‘হোসেন’-এর বংশের হতে পারে! মেয়েদের আরও বিপদ। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে এনআরসি-তে। পিতৃধারার প্রমাণ দিতে হবে মেয়েদের। অর্থাৎ মায়ের প্রমাণপত্রে চলবে না। বাবা, তার বাবা – এই লাইনে বংশধারা প্রমাণ করতে হবে। এমনকি হিয়ারিং-এর সময় মেয়েদের কথা না শুনে তাঁদের পুরুষ অভিভাবকদের আনতে বলা হয়েছে। ব্যাপক আতঙ্ক, ঋণগ্রস্ততা, প্রাণহানি ও অনাস্থা জন্ম দিয়েছে এনআরসি। গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে সমাজে। শারিরীক, মানসিক ও দেহমানসিক বিভিন্ন রোগ দেখা দিচ্ছে মানুষের। ৫০ জনের ওপর আত্মহত্যা করেছে। হিয়ারিং-এ দ্রুত পৌঁছানোর চেষ্টায় গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটেছে কয়েকটি, মৃত্যু হয়েছে। পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। কে কার বিরুদ্ধে “সন্দেহ জনক” বলে অভিযোগ আনছে তা জানেনা কেউ, কেবল সমন আসছে। কাকে কেন ফরেনার বলে ডি-ভোটার করে দেওয়া হচ্ছে তা কারও কাছে পরিষ্কার নয়। কাকে কেন ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে তাও বুঝতে পারছে না কেউ। ফরেনার্স ট্রাইবুনালগুলি কোনও বিচারবিভাগীয় প্রতিষ্ঠানই নয়। অনেক ক্ষেত্রেই “সন্দেহজনক” চিহ্নিত ব্যক্তিটির অনুপস্থিতিতেই একপাক্ষিক রায় ঘোষণা হয়ে গেছে। মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের বিভিন্নভাবে হেনস্থা, নজরদারি চালানো হয়েছে। যারা এনআরসির-র বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে তাদের বিভিন্নভাবে টার্গেট করা হয়েছে। মিথ্যা মামলা, পড়াশোনার জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, ব্যক্তিগত কুৎসা চালিয়ে কোণঠাসা করা হয়েছে।
প্রেস ক্লাবের সংবাদ সম্মেলনকে সম্বোধিত করেন নিশা, সোহিনী, স্বপ্না, শ্রেয়া ও কৃষ্ণা। এনআরসি প্রক্রিয়াকে একটি সমান্তরাল শোষণ অর্থনীতি বলে অভিহিত করেন নিশা বিশ্বাস। তিনি বলে যে সাম্প্রতিক এক সার্ভেতে দেখা গেছে যে কাগজ বা উকিলের পেছনে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের। বহু গরিব মানুষ তাঁদের ভিটেমাটি শেষ সম্বল বিক্রি করে সর্বশান্ত হয়ে গেছেন। বন্যাকবলিত মানুষের কোন কাগজপত্র থাকবে? -- এই প্রশ্ন তোলেন শ্রেয়া। তিনি রাজমিনা নামে এক অঙ্গনওয়ারি কর্মীর পরিবারের গল্প বলেন। নব্বই বছর বয়স পেরনো দম্পতি সাজ্জাদ বেগম ও আশরাফ আলি, মরিয়ম ও ফিরোজা খাতুনদের দুর্বিসহ হয়ে ওঠা জীবনের গল্প বলেন। এনআরসি প্রক্রিয়াকে তিনি শ্রম শোষণের নয়া তরিকা তথা নতুন রূপে দাস প্রথা ফিরিয়ে আনা বলে উল্লেখ করেন। সোহিনী বলেন যে এনআরসি যেন এক অনন্ত দেশভাগ। দেশ ভাগ ইতিহাসে হয়েছিল, কিন্তু এনআরসি প্রতিনিয়ত দেশকে ভাগ করতে থাকবে। তিনি হোজাই জেলায় ১৯৬৪ সালে আসা শরণার্থীদের মাঝে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। একটা অঞ্চলে ৬০০০ অধিবাসীর মধ্যে অর্ধেকের বেশিই বাদ পড়েছে তালিকা থেকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই হাজং আদিবাসীরা মানসিক ধাক্কার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্না বলেনল যে আমরা বাংলার শ্যামলিমার কথা জানি, আসামের হাইলাকান্দি ঘুরে আরও সবুজ মনে হয়েছে, কিন্তু জীবন যেন আরও ছেঁড়াখোড়া বিবর্ণ হয়ে গেছে। সবশেষ বক্তা হিসেবে কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় অমানবিক এই এনআরসি অভিযানকে রুখে দেওয়ার আহ্বান জানান।