গত ২৮ নভেম্বর, কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ কুমার গাঙ্গোয়ার লোকসভায় পেশ করলেন শিল্প-সম্পর্ক কোড বা লেবার কোড অন ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন্স, ২০১৯। ট্রেড ইউনিয়ন আইন, ১৯২৬, দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডারস্) অ্যাক্ট, ১৯৪৬ এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিস্পিউট অ্যাক্ট, ১৯৪৭—এই তিনটি আইনকে যুক্ত করে উল্লিখিত কোডটি পেশ করা হলো সংসদে। ইতিমধ্যে, আগস্ট মাসে সংসদে পেশ হওয়া বেতন বিধি বা কোড অন ওয়েজেস্ পাশ হয়ে গেছে। আর, পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের অবস্থা সংক্রান্ত শ্রম কোডটি (কোড অন ওকুপেশনাল সেফটি, হেলথ্ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন্স) শ্রম সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার তিন নম্বর কোডটি পেশ হলো।
‘শিল্পবিরোধে’র অমার্জিত শব্দবন্ধটি খুব সচেতন ভাবে বাদ দিয়ে ‘শিল্প সম্পর্ক’ শব্দটি ঢোকানো হয়েছে এবারের কোড-এ। শ্রম সম্পর্ককে আরও সরল করতে, সহজ শর্তে ব্যবসা করার সুযোগকে প্রসারিত করতে, (বা আরও নির্দিষ্ট অর্থে শ্রম আইন মেনে চলতে নিয়োগকর্তাদের যাতে কোনো অসুবিধে না হয়) শ্রম আইন যাতে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে আরও নতুন সংস্থা স্থাপনের সহায়ক হয়, সেই লক্ষ্য মাথায় রেখেই এই শ্রম কোড, এমনটাই জানিয়েছে সরকার। আর তাই নতুন প্রস্তাবিত এই আইন ‘শিল্প’র এক নতুন সংজ্ঞা হাজির করেছে। তাতে বলা হয়েছে,
“শিল্প” হল এমনই এক প্রণালীবদ্ধ কর্মকান্ড যা নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকের সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। ঐ শ্রমিক কোনো এক নিয়োগকর্তা মারফত সরাসরি বা কোনো এক এজেন্সি এমনকি ঠিকাদারের মাধ্যমে উৎপাদন, সাপ্লাই বা বিতরণের জন্য নিয়োজিত হয়ে থাকতে পারেন। “এই সংজ্ঞার অন্তর্নিহিত অর্থ স্পষ্ট করেই বলে দিল যে এখন থেকে এমনকি কোনো এজেন্সি বা ঠিকাদার মারফত নিয়োজিত শ্রমিকদের মূল উৎপাদনের সাথে যুক্ত থাকাটা আইন সম্মত, যা এতদিন ছিল ইন্সিডেন্টাল বা আনুসঙ্গিক, অর্থাৎ, নিয়মিত কাজের সাথে সারা বছর যুক্ত থাকাটা ঠিকা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আর বেআইনি নয়। ঠিকাদারকে পাশে সরিয়ে রেখেই এবার থেকে শিল্পপতিরা সরাসরি ঠিকা শ্রমিকদের নিয়োগ করতে পারবে। আগের পাশ হয়ে যাওয়া বেতন বিধি সেই রাস্তাই তৈরি করে রেখেছে। এবারের শিল্প-সম্পর্ক কোডটি স্থায়ী শ্রমিকের বর্গটাই পুরোপুরি লোপাট করে দিল। বদলে নিয়ে এলো সর্বনাশা ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট। নয়া ‘শিল্প-সম্পর্ক কোড ‘এর মাধ্যমে ভারতবর্ষে শুরু হলো নতুন এক শ্রম ব্যবস্থা, যেখানে স্থায়ী পদ, স্থায়ী কাজ, স্থায়ী শ্রমিক এবার থেকে হয়ে যাবে জাদুঘরের বিষয় সামগ্রি, আর সার্বিক ঠিকাকরণ, অস্থায়ীত্বই হবে নিয়ম, কানুন, বিধিব্যবস্থা।
এই কোডে ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্টকে পরানো হল আইনি জামা। সবচেয়ে মারাত্বক বিষয় হল, গোটা দেশে যে কোনো সেক্টরে এবার থেকে এই ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট এর মাধ্যমে নিয়োগকর্তারা যথেচ্ছভাবে কর্মী নিয়োগ করতে পারবেন। সংখ্যা বা নিয়োগের সময় সীমায় কোনো ধরনের বিধিনিষেধ নেই। নিয়োগকর্তা নির্দিষ্ট একটা সময় সীমা পর্যন্ত তাঁদের নিয়োগ করার অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছেন। আর সেই সময় সীমার শেষে তাঁদের কর্মচ্যুত করার অধিকার থাকবে নিয়োগকর্তার। এই কর্মচ্যুতিকে ছাঁটাই বলা হচ্ছে না। ফলে ছাঁটাই শ্রমিকদের যে ক্ষতিপূরণ আগেকার আইনে ছিল, এবার তাকেও ছুটি দেওয়া হল। নতুন শর্তের ভিত্তিতে নিয়োগকর্তা ফের সেই কর্মীকে নিয়োগ করতে পারবে। সেই শ্রমিক আবার নতুন শর্তের ভিত্তিতে কাজ করতে পারবেন, কিন্তু আগের ধারাবাহিকতায় (যাকে বলে কন্টিনিউইটি অফ সার্ভিস) নয়। এই ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট এর কর্মীরা নিয়মিত বা রেগুলার (খেয়াল রাখবেন, আইনে স্থায়ী শব্দটি ব্যবহার না করে রেগুলার বা নিয়মিত শব্দটি রাখা হয়েছে) শ্রমিকদের সমান সুযোগ সুবিধা, অর্থাৎ সমান মজুরি-সামাজিক সুরক্ষা পাবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৮-র মার্চে কেন্দ্রীয় সরকার ওই শ্রমিকদের জন্য নিয়ম বিধি তৈরি করে, কিন্তু তখন তা কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সংস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। কোনো রাজ্য সরকারই কেন্দ্রের ওই নিয়ম অনুযায়ী তাকে কার্যকর করেনি। শিল্প মহলও তখন মনে করে যে তাদের নতুন করে পাওয়ার আর কিছু নেই। কিন্তু, এবার ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট আইনি বৈধতা পাওয়ায় সর্বত্র, ঢালাও ভাবে তাকে কার্যকর করতে আর কোনো বাধাই থাকল না। নিয়োগ কর-ছাঁটাই কর (হায়ার অ্যান্ড ফায়ার) নীতিকে দেওয়া হল আইনি সবুজ সংকেত। এই ভাবে গোটা শ্রমব্যবস্থায় ক্যাজুয়ালকরণ, ঠিকাকরণকেই আইনি মোড়ক দেওয়া হল।
ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের পুনরায় প্রশিক্ষিত করতে শিল্প-সম্পর্ক কোড “রি-স্কিলিং ফান্ড’’ গঠন করার প্রস্তাব হাজির করেছে। ছাঁটাই হওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে তাঁকে ১৫ দিনের মজুরি দেওয়ার জন্য গড়ে তোলা হচ্ছে এই তহবিল। চাকুরির শেষদিন পর্যন্ত তিনি যে মজুরি পেয়েছিলেন, তার ভিত্তিতেই দিতে হবে ওই ১৫ দিনের মজুরি। যত জন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে তত জনের টাকা (১৫ দিনের মজুরির হিসাবে) জমা রাখতে হবে ওই তহবিলে।
এতদিন ধরে শ্রমিক সংগঠনগুলো ধর্মঘটের অধিকার ভোগ করে আসছিল। এবার কার্যত সেই অধিকারকেই কেড়ে নিল নতুন শিল্প-সম্পর্ক কোড। কোনো সংস্থায় পঞ্চাশ শতাংশ বা তার অধিক কর্মী যদি ‘গণ ক্যাজুয়াল লিভ নেয় তবে সেটাকে ধর্মঘট হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে এই বিলে। আর ধর্মঘটে যাওয়ার ১৪ দিন আগে আইনি নোটিশ দেওয়ার নিয়ম করা হল সমস্ত ধরনের শিল্পের ক্ষেত্রে, যা এতদিন জন পরিষেবামূলক সংস্থার জন্য প্রযোজ্য ছিল। viii অধ্যায়ের ৬২ (১) ধারায় বলে দেওয়া হয়েছে চুক্তি ভঙ্গ হলে (ব্রিচ অফ কন্ট্রাক্ট) সেই ধর্মঘট বে আইনি বলে বিবেচিত হবে। এখন যে কোনো ধর্মঘটকেই নিয়োগকর্তা চুক্তিভঙ্গ হিসাবে বর্ণনা করবে। বলা হয়েছে, ধর্মঘটের নোটিশ দেওয়ার পর আলাপ আলোচনা শুরু হবে বিরোধ মীমাংসার লক্ষ্যে। যতদিন আলোচনা চলবে ততদিন শ্রমিকেরা ধর্মঘটে যেতে পারবেন না। স্বভাবতই, ধর্মঘট এড়াতে মালিকপক্ষ একের পর এক বৈঠকের ফাঁদে শ্রমিক ইউনিয়নকে আটকে রাখবে। ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘটে গেলে নতুন আইন তাকে বে আইনি ঘোষণা করে দেবে।
ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আমলাদের হাতে বিপুল ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন না দেওয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে রেজিস্ট্রার অফ ট্রেড ইউনিয়ন্সের হাতে। রেজিস্ট্রেশনের সময় সেই ইউনিয়নের থাকতে হবে সেই সংস্থার দশ শতাংশ শ্রমিকদের বা ন্যুনতম ১০০ শ্রমিকের সমর্থন। পরে, যে কোনো সময়ে সেই ইউনিয়নকে বজায় রাখতে হবে ন্যুনতম দশ শতাংশের সদস্য সংখ্যার মানদন্ড। ৭(ই) ধারা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, বাইরের কেউ বা শ্রমিক নন এমন কেউ ইউনিয়নের অফিস বেয়ারার হতে পারবেন না। অর্থাৎ, ইউনিয়নের শ্রমিকদের নিজেদের অফিস বেয়ারার নির্বাচিত করার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার কে হরণ করা হল। ট্রেড ইউনিয়নের আধিক্য কমাতে নতুন আইন ঘোষণা করেছে, একটি কারখানায় একাধিক ইউনিয়ন থাকলে সেই ইউনিয়নটিকেই মান্যতা দেওয়া হবে যার সেই সংস্থায় রয়েছে ৭৫ শতাংশ বা তার অধিক জনসমর্থন। যদি কোন ইউনিয়নের তা না থাকে তবে গঠন করা হবে একাধিক ট্রেড ইউনিয়নকে নিয়ে এক কাউন্সিল। আর, দশ শতাংশের অধিক জনসমর্থন যাদের রয়েছে তারাই একমাত্র সেই কাউন্সিলের অংশীদার হবেন, যারা মালিকপক্ষের সাথে দর কষাকষি করতে পারবে।
যে সমস্ত কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা ১০০ বা তার বেশি, সেখানে ছাঁটাই, লে-অফ বা পুরোপুরি বন্ধ করার আগে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে, শ্রম যেহেতু সংবিধানের যুগ্ম তালিকায় রয়েছে, তাই তার সুবাদে বেশ কিছু রাজ্য, যেমন, অন্ধ্রপ্রদেশ, অসম, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরাখন্ড এবং উত্তরপ্রদেশ সেই সংখ্যাটাকে বাড়িয়ে ৩০০ পর্যন্ত নিয়ে গেছে। নতুন এই আইনটি শ্রমিক সংখ্যাকে ১০০-র মধ্যে রাখলেও ‘কর্মীর সংখ্যাটিকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পাল্টানোর ‘অধিকার রাজ্য সরকারগুলোর উপর ছেড়ে দিয়েছে’।
ট্রাইব্যুনালের ভার লাঘব করার নামে সেগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক করে সরকারি আমলাদের হাতে বিরোধ নিরসনে বিপুল ক্ষমতা হস্তান্তর করা হল। এক সদস্য বিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালের জায়গায় দুই সদস্য বিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর সমাধান যুক্তভাবে এই ট্রাইব্যুনালে হবে, আর বাকিগুলোকে পাঠানো হবে এক সদস্য বিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালে। সরকারি আধিকারিকদের হাতেই ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে বিরোধ নিরসনের, তাঁরাই জরিমানার পরিমাণ স্থির করে দেবেন।
বেতন বিধির ক্ষেত্রে ও আমলাকূলকে বিরাট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নকে একেবারেই গৌণ অবস্থানে রেখে মজুরি সহ বিভিন্ন বিষয় নির্দ্ধারণে সরকারি আধিকারিকদের যে ঢালাও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা শিল্প সম্পর্ককে মসৃণ করার বদলে ডেকে আনবে বিরাট অশান্তি, এবং কালক্রমে সরকারি আধিকারিকরাই শ্রমিকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে।
এ বছরটি আইএলও প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী। এই উপলক্ষ্যে আইএলও “লেবার গ্যারান্টিস্’’- এর শ্লোগান সামনে এনেছে। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, যৌথ দর কষাকষির ক্ষমতাকে বাড়ানো, শোভন কাজ সামাজিক সুরক্ষা এবং সর্বোপরি তাঁদের ন্যুনতম মজুরি বৃদ্ধির পক্ষে আইএলও তার স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর কাছে আবেদন রেখেছে। পরিহাস হল, পশ্চিমের নানা দেশ যখন এ নিয়ে কিছু অর্থবহ পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করল, তখন মোদীর ভারত সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হেঁটে হরণ করে নিচ্ছে শ্রমিকশ্রেণি ও ট্রেড ইউনিয়নের যাবতীয় অধিকার। এর বিরুদ্ধেই এগিয়ে চলেছে চিত্তরঞ্জন থেকে কলকাতা পর্যন্ত শ্রমিকদের লং মার্চ। এর বিরুদ্ধেই আগামী ৮ জানুয়ারি, ২০২০-তে পালিত হতে চলেছে সারা ভারতব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট।