ভারতের সংবিধান গ্ৰহণের ৭০তম বার্ষিকীতে সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সুপ্রীম কোর্টের দিকে। এর আগের দুটো দিন সুপ্রীম কোর্ট একটা মামলার শুনানি গ্ৰহণ করছিল। ঐ মামলাটা রুজু হয়ছিল একেবারে চক্রান্তমূলকভাবে দেবেন্দ্র ফডণবীসকে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ গ্ৰহণ করানোর মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালের ন্যক্কারজনক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। এবং ঐ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে এনসিপি, শিবসেনা এবং কংগ্রেস জোট গঠন করার পরপরই, যে জোটের কাছে সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। ২৪ নভেম্বর আদালত সমর্থনের সপক্ষে চিঠিগুলো জমা দেওয়ার জন্য সরকারপক্ষকে এক দিনের সময় দেয় আর পরদিন আদালত তার রায় দান স্থগিত রাখে। এইভাবে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা জোগাড়ের জন্য পুরো দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিনের সময় পেয়ে যায়। তৃতীয় দিনে সুপ্রীম কোর্ট অবশেষে কিছুটা তৎপরতা ও কঠোরতা দেখিয়ে সরকারকে ২৭ নভেম্বরের বিকাল ৫টার মধ্যে সর্বসমক্ষে বিধানসভার অভ্যন্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে বলে। এবং বিধানসভায় চলা কার্যাবলী সরাসরি সম্প্রচারের নির্দেশও দেয়। বিধানসভায় অচিরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ দেওয়ার এই নির্দেশ বিজেপির ধাপ্পাবাজির উন্মোচনের পক্ষে যথেষ্ট ছিল এবং পদত্যাগ করা ছাড়া ফডণবীসের কাছে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।
সুপ্রীম কোর্টের রায় এইভাবে সরকার গড়ার প্রতিষ্ঠিত নিয়মনীতির সম্পূর্ণ প্রহসনে পর্যবসিত হওয়ার হাত থেকে সংবিধানকে রক্ষা করে। রাজ্যপাল যে সম্পূর্ণ লুকিয়ে চুরিয়ে এবং চক্রান্তমূলক ভাবে মুখ্যমন্ত্রী ও উপমুখ্যমন্ত্রীকে শপথ গ্ৰহণ করানোর পথে গেলেন তার নির্লজ্জতা সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্ট অবশ্য সুস্পষ্টভাবে কিছু বলেনি। গোটা কাণ্ডটাই রাতের অন্ধকারে চালানো এক অভ্যুত্থান ছাড়া অন্যকিছু ছিল না। সূর্য ওঠার আগেই রাষ্ট্রপতি শাসন তুলে নেওয়া হয়েছিল, আর সেটা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োজনীয় মন্ত্রীসভার সুপারিশ এড়াতে আপৎকালীন ক্ষমতার আশ্রয়ও নিলেন। ঐ শপথ গ্ৰহণ অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য সরকারি সম্প্রচারকের কোন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল না, নতুন সরকার গঠনের ঘোষণা টুইটারের মাধ্যমে হয় যখন মোদী নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানান আর নতুন সরকার মোদীকে ধন্যবাদ জানায়। সাংবিধানিক রীতিকে কলঙ্কজনকভাবে জলাঞ্জলি দেওয়ার এই উদ্যোগকে সমালোচনা না করে বড়বড় মিডিয়া অমিত শাহর নির্লজ্জ ছলচাতুরিকে প্রবাদপ্রতিম চাণক্যর বুদ্ধিমত্তা বলে গুণকীর্তন করতে থাকে। পরিস্থিতির পরিহাসে ঐ চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় এখন গোটা দায়টাই চাপানো হচ্ছে একমাত্র ফডণবীসের ঘাড়ে, এবং যে মোদী-শাহ জুটি এই ব্যর্থ অভিযানের ছক তৈরি করেছিলেন তাদের দিকে কোনো আঙ্গুলই তোলা হচ্ছে না।
সে যাই হোক, ক্ষমতা কব্জা করার মোদী জমানার সবচেয়ে নির্লজ্জ অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে—তা সে যত অল্প সময়ের জন্যই হোক। এর তাৎপর্য হল, ভারতের অবরুদ্ধ গণতন্ত্র সংঘ-বিজেপি বাহিনীর ফ্যাসিবাদী আগ্ৰাসনের মোকাবিলায় যে লড়াই চালাচ্ছে তাতে সে নিঃশ্বাস ফেলার একটু অবসর পেল। ফডণবীস সরকার মহারাষ্ট্রে পেশোয়াদের পৈশাচিক এবং পশ্চাৎমুখী শাসনের স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছিল। মাহার সেনারা পেশোয়াদের আধিপত্য এবং সামাজিক উৎপীড়নের শাসনকালের অবসানের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর অধীনে লড়াই করে। দলিতরা যখন ভীমা- কোরেগাঁওয়েই যুদ্ধে পেশোয়া বাহিনীর পরাজয়ের দ্বিশত বার্ষিকী উদযাপন করছিল, তাদের উপর যে নির্মম হিংসা নামিয়ে আনা হয় এবং তারপর দলিত আন্দোলনের কর্মী এবং মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার অভিযোগ এনে যে ডাইনি খোঁজ অভিযান চালানো হয় তা ফডণবীস সরকারের বিরুদ্ধে সামাজিক ক্ষোভকে তীব্রতর করে তোলে। তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকা কৃষি সংকটের সমাধানে সরকারের চরম অনাগ্ৰহ ও অনীহা আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় এবং গ্ৰামীণ মহারাষ্ট্রের ব্যাপক অংশে বিজেপি-শিবসেনা জোট এবারের বিধানসভা নির্বাচনে গোহারান হারে। ফডণবীস সরকারের বিরুদ্ধে গণরোষের এই প্রেক্ষাপটই মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা কবজা করার মোদী-শাহর অভিযানকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছে।
মিডিয়া অমিত শাহকে যে বিজেপির চাণক্য রূপে তুলে ধরছে, মহারাষ্ট্রে ভরাডুবির ফলে তা চুরমার হয়ে গেছে। মোদী-শাহ জুটির অধীনে বিজেপির অপরাজেয়তার বাতাবরণ লোপ পেতে শুরু করেছে। নির্বাচনমুখী ঝাড়খণ্ডে এই বার্তাকে আরো জোরের সাথে অনুরণিত হতে হবে, যে রাজ্যে নির্বাচন-পূর্ববর্তী পর্যায়ে বিজেপি এবং এজেএসইউ-র মধ্যে গড়ে তোলা গাঁটছড়া ভেঙ্গে গেছে, এবং এর চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল বিদায়ী সরকারের মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস তাঁর নিজের কেন্দ্রেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন বিজেপিরই বিদ্রোহী মন্ত্রী সরজু রাই-এর কাছ থেকে। রঘুবর দাস সরকার ব্যাপকতর স্তরে “ভয়, ভুখা ও ভ্রষ্টাচারের” সরকার রূপে প্রতিপন্ন হয়েছে (ভয়, ক্ষুধা ও দুর্নীতির এই তিনটি অশুভ বিষয়কে বাজপেয়ীর সময়ের বিজেপি উল্লেখযোগ্যভাবে দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল) এবং মহারাষ্ট্রে বিজেপির বিপর্যয় ঝাড়খণ্ডের নির্বাচকমণ্ডলীকে বিজেপির বিরুদ্ধে আরো জোরালো রায় দিতে অনুপ্রাণিত করবে।
ঝাড়খণ্ডের আশু নির্বাচনী পরিপ্রেক্ষিতের প্রসঙ্গ বাদ দিলেও মহারাষ্ট্রে ঘটনাবলীর বিকাশকে সেই সমস্ত নাগরিকের কাছে হুঁশিয়ারীর এক বার্তা হয়ে উঠতে হবে, যাঁদের ভারতের সাংবিধানিক কাঠামো সম্পর্কে আগ্ৰহ আছে। পরিস্থিতির এমনই পরিহাস, মোদী সরকারই ২০১৫ সাল থেকে ২৬ নভেম্বরকে সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করা সরকারিভাবে শুরু করে। যে সরকারটা শূন্যগর্ভ এবং কপট বাগাড়ম্বরের জন্য কুখ্যাত, সে এখন বড় গলায় সংবিধানের প্রতি মেকি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সংবিধানের মৌলিক মূল্যবোধ এবং কাঠামোর উপর প্রবল প্রণালীবদ্ধ আক্রমণকে আড়াল করতে চাইছে; এই কাজটা সে আরো করছে ডঃ আম্বেদকরের প্রতি অন্তঃসারশূন্য শ্রদ্ধা দেখিয়ে যিনি সেই সংবিধান সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন যা সংবিধানের খসড়া তৈরি এবং তাকে গ্ৰহণ করে। আম্বেদকর চেয়েছিলেন, ভারতীয় নাগরিকরা সংবিধানকে সমাজ পরিবর্তনের অস্ত্র হিসেবে গণ্য করবে। তিনি সতর্ক করে আরো বলেছিলেন যে, সংবিধানে যত মহৎ লক্ষ্য এবং পবিত্র প্রতিশ্রুতিই লিপিবদ্ধ থাক না কেন, যাদের হাতে সংবিধান বলবৎ করার দায়িত্ব সংবিধানের হাল কার্যত তাদের মতনই হবে।
আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতি পদক্ষেপে সংবিধানকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। জম্মু ও কাশ্মীরকে তার রাজ্যের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা এবং উপত্যকার জনগণের বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করাটা সংবিধানের প্রাণসত্তার উপর এক প্রবল আঘাত হয়ে দেখা দিয়েছে, যেমন আঘাত রূপে প্রকট হয়েছে অযোধ্যা জমি মালিকানা মামলায় সুপ্রীম কোর্টের রায়। আসামে এনআরসি রাজ্যের অধিবাসীদের উপর অভূতপূর্ব নিরাপত্তাহীনতা ও দুর্দশা চাপিয়ে দিয়েছে আর আটক শিবিরগুলো ন্যায় ও মানবাধিকারের বধ্যভূমি হয়ে উঠেছে, যে শিবিরগুলো থেকে ২৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু এই বিপর্যয়ের মোকাবিলা করা দূরে থাক, মোদী সরকার সারা দেশেই এটাকে চালু করতে বদ্ধপরিকর, এরই সাথে ওরা ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের বুনিয়াদি কাঠামোকে সংশোধন করতে চাইছে যা চূড়ান্ত রূপে সাম্প্রদায়িকতা প্রসূত এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে বৃহত্তম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঝোঁকা। পরিচালক নীতিগুলো ভারতের এক কল্যাণ রাষ্ট্র হওয়ার ধারণাকেই মূর্ত করেছিল, মোদী সরকার কিন্তু প্রণালীবদ্ধভাবে সমস্ত শিল্প ও পরিষেবার বেসরকারিকরণ ঘটাচ্ছে, যার মধ্যে দিয়ে জনগণকে কর্পোরেট লুটেরাদের আধিপত্য ও কারচুপি চালিত বাজারের কব্জায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
ভারতের সংবিধান গ্ৰহণের সাত দশক পর তা আজ এইভাবে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখে, কেননা, ক্ষমতার কুর্সিতে বসা লোকজন প্রণালীবদ্ধ ভাবে তার ধ্বংসসাধন করে চলেছে, নাগরিকদের অধিকার হরণ করছে এবং তাদের কার্যত পর্যবসিত করছে স্বৈরাচারী একনায়ক শাসিত প্রজার মর্যাদায়। ভবিষ্যতে ঘটতে পারে বলে যে হুঁশিয়ারি আম্বেদকর দিয়েছিলেন, তা এত সত্যি হয়ে আগে আর কখনও দেখা দেয়নি। আমাদের, ভারতের জনগণকে সমস্ত শক্তি দিয়ে সংবিধানের বুনিয়াদি মূল্যবোধ এবং অভীষ্টকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ২৬ নভেম্বর ২০১৯)