হেমন্তের শিশির নিশ্চুপে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের। প্রকৃতির কান্না হয়ে? জানি না। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির বাহালনগর আর তার পাশের গ্রামের পাঁচটি ভূমিপুত্র পাশাপাশি চিরঘুমে শায়িত। বাংলার পাঁচটি দরিদ্র সন্তান।
কেউ তাদের জন্য মোমবাতি মিছিল করেনি। কেন? তারা পেটের তাগিদে ভিন্ রাজ্যে গিয়ে মরেছে বলে? তারা গরিব বলে? মুসলমান বলে? জানি না। কিন্তু তাতে কীই বা আসে যায়! যে মাটিতে বড় হয়ে ওঠা, যাদের সঙ্গে একই বাতাসে শ্বাস নিয়ে সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়া, স্বপ্ন দেখা — তারা তো শহীদের সম্মান দিয়েছে! ভিন্ন গ্রামের হলেও একই কবরস্থানে সমাহিত করেছে! দশ গ্রামের হাজার মানুষ চোখের জলে শেষ বিদায় জানিয়েছে! ‘গান স্যালুট’ ছাড়াই ‘গার্ড অব অনার’ দিয়েছে!
আসলে তারা তো সহযোদ্ধা। হ্যাঁ, যুদ্ধ। নির্মম দারিদ্র্য, তীক্ষ্ম ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। তাই তারা এই মৃত্যুকে শহীদের সম্মান জানিয়েছে।
তাদের দেহ ফিরিয়ে আনা, হত দরিদ্র পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ানো,কাশ্মীরে আটকে থাকা বাংলার আরও তিন জেলার প্রায় দেড়শো শ্রমিককে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া — এসব ক্ষেত্রে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তথা প্রশাসনের এপর্যন্ত যথাযথ ভূমিকায় রাজ্যবাসী হিসেবে স্বস্তিবোধ করারই কথা। করেছিও।
কিন্তু কেন ওদের বছর বছর ভিন্ রাজ্যে যেতে হয়? চাহিদা তো বেশি কিছু নয়! মাটির ঘরের চালে খড় দেওয়া, রোগের চিকিৎসা, মেয়ের বিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। দৈনিক পাঁচশো থেকে সাতশো আটশো টাকা মজুরিতে মাস তিনেক কাশ্মীরে আপেলের মরশুমে গতরে খেটে দুটো বাড়তি পয়সা নিয়ে আসা। নিজের রাজ্যে কেন সেই মজুরি জোটে না? কাজ জোটে না? কাশ্মীরে বেশি মজুরি পাওয়া যায়। তাহলে কাশ্মীরের অর্থনীতি ‘পিছিয়ে থাকা’ হল কী করে, যেমনটা দাবি মোদী সরকারের? অন্তত সেখানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পিছনে অন্যতম অজুহাত তাদের।
একজন গিয়েছিলেন বিবাহিত মেয়ের পণের বকেয়া টাকা জোগাড় করতে। মেয়েকে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবারে এক লক্ষ টাকা পণ দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে হয়! এই বাংলায়! সাড়ে তিন দশকের বাম শাসন, এই সরকারের আমলে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজ সাথী, সবলা, আনন্দধারা — মেয়েদের স্কুল-মুখী করা, পণ রোখা, স্বাবলম্বী করার জন্য এত প্রকল্প — সেগুলোর কার্যকারিতা তবে কোথায়?
আজও সংবাদপত্রে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের এক সংখ্যালঘু শ্রমিকের রাজমিস্ত্রির কাজে গিয়ে ঝাড়খণ্ডে নৃশংসভাবে খুন হওয়ার খবর রয়েছে। পেটের জন্য ভিন্ রাজ্যে গিয়ে বাংলার আর কত প্রাণ বলি হবে জাতিদ্বেষের, হিংসার, সন্ত্রাসবাদের? মহিলাসহ গ্রাম-শহরের দরিদ্র মানুষের কল্যাণ ও ক্ষমতায়নের জন্য এই সরকারের আমলে ৫২টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেগুলো কি শুধুমাত্র খাতায় কলমেই!
অনেক দুঃসময় এসেছে, কিন্তু বাংলার মানুষ জানে, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ — এখানে তাই ভিন্ রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষ রাজ্যবাসীর সঙ্গে সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে বহুদিন থেকে পুরুষানুক্রমে নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে বসবাস করছেন, করবেন। আমরা আদৌ প্রাদেশিক নই, তবু বলছি ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’র নামে যাদের গাত্রদাহ হয় অথচ যারা বাংলার মসনদের স্বপ্নে মশগুল — বিজেপি’র সেই নেতারা শুনে রাখুন — আমরা এনআরসি মানছি না, মানবো না! সবাইকে নিয়ে চলাই বাংলার সংস্কৃতি!
এবার একটু ‘ভূস্বর্গে’ দৃষ্টি ফেরাই। সেখানে গত প্রায় তিন মাস ধরে সত্তর লক্ষ মানুষের জন্য সাত লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন রয়েছে। বহু অঞ্চলে এখনও কাঁটাতারের ঘেরাও। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত। মানুষের সামান্যতম প্রতিবাদ প্রতিরোধকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি পেলেট বৃষ্টি করছে। এমনকি ছোট্ট শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। পেলেট ছুঁড়ে তাদেরও অন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে! অথচ জঙ্গি হামলা অব্যাহত! শুধুমাত্র বাংলার শ্রমিকই নন, অন্য রাজ্যের শ্রমিক, ট্রাক ড্রাইভার, আপেল বাগানের মালিক — এই সব বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ খুন হয়েছেন পর পর এই ক’দিনে। এখন আপেলের মরশুম এবং আপেল রপ্তানি ও ফল-প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কাশ্মীরের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে সেনার উপস্থিতিতে এই হত্যাগুলো কীভাবে হল? কেন জঙ্গি হুমকি সত্ত্বেও প্রশাসন সতর্ক হয়নি?
কেন মোদী-অমিত শাহ, কেন্দ্রীয়ীয়-প্রশাসন এই মর্মন্তুদ ঘটনার জন্য একটি শব্দও খরচ করলেন না? অথচ ৩১ অক্টোবর ‘একতা দিবস’ পালন করা হল ঘটা করে! কীসের একতা, কাদের একতা?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের ‘বেসরকারি সফর’ দিব্যি সরকারি আতিথেয়তায় নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হল। আর একই দিনে ছ’ছটি দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ জঙ্গি হামলার শিকার হলেন, বলি হল পাঁচটি নিরীহ প্রাণ। প্রশাসন নির্বিকার, নিরুত্তাপ! আশ্চর্য এই নীরবতা!