ওয়েজ কোড আইন : কর্তৃপক্ষের করুণার উপর ছেড়ে দেওয়া হলো শ্রমিকদের
(কেন্দ্রীয় সরকার ৪৪টি কেন্দ্রীয় শ্রম আইনকে ৪টি শ্রম কোড-এর ছাতার তলায় নিয়ে এলো। ইতিমধ্যে, চারটি শ্রম আইন, পেমেন্ট অফ ওয়েজেস অ্যাক্ট, ১৯৩৬, মিনিমাম ওয়েজেস অ্যাক্ট, ১৯৪৮, পেমেন্ট অফ বোনাস অ্যাক্ট, ১৯৬৫, এবং ইক্যুয়াল রেমুনারেশন অ্যাক্ট ১৯৭৬-কে একটি শ্রম কোড, মজুরি কোড-এ আনা হয়েছে। সেটা সংসদ পাশ করে ফেলেছে। বাকি গুলো প্রস্তাব আকারে পেশ হয়েছে। অনুদিত এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় সিপিআই(এমএল)-এর কেন্দ্রীয় মুখপত্র ‘‘লিবারেশন’’-এর সেপ্টেম্বর ২০১৯ সংখ্যায়। লিখেছেন পলিটব্যুরো সদস্য, কেন্দ্রীয় শ্রমিক দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভি শংকর।)

এবার কর্পোরেটরা আইন তৈরি করছে :

মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ওয়েজ কোড বা মজুরি বিধি সংসদে পেশ করে পাশ করিয়ে নিল মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে, ২০১৮-তে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির একাধিক সুপারিশকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে। বর্তমানে যে আইনটা রয়েছে, তার সঙ্গে নতুনটার সবচেয়ে বড় তফাৎ হলো, এই কোড নানা সংজ্ঞাগুলোকে বড্ড বেশি দুর্বোধ্য, অস্পষ্ট ও অসংগতির মোড়কে হাজির করেছে। পরিচালিত করেছে আরও বেশি কর্পোরেটমুখী দিশায়। ফলে, প্রশাসন ও সরকারের নাক গলানোর অনেক বেশি অবকাশ থাকছে, আইনকে সুকৌশলে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর বিরাট সুযোগ কর্পোরেটরা পেয়ে গেল এই কোডের মাধ্যমে। আগে যা ছিল ‘বিচারপতির তৈরি করা আইন,’ এখন তা হয়ে দাঁড়ালো ‘সরকার-কর্পোরেট-আমলাতন্ত্রের তৈরি’ করা কানুন। এটাই হলো ওয়েজ কোড-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এতদিন যে সমস্ত ‘শ্রম’ কানুন শ্রমকে সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হতো, তা এখন পাল্টে হয়ে উঠল ‘পুঁজির স্বার্থে আইন’। বিগত দিনে সমস্ত শ্রম কানুনের লক্ষ্য ছিল, বাজারের যথেচ্ছাচার এবং অতি মুনাফার জন্য অন্ধভাবে ছুটে চলা পুঁজির নির্মম আক্রমণ ও লুন্ঠন থেকে শ্রমিকদের সুরক্ষিত করা। আর, এখন তা পুরোপুরি উল্টে দেওয়া হলো। বর্তমানে মজুরি কোডের লক্ষ্যই হলো শ্রমিকদের রক্ত চুষে বাধাহীনভাবে শোষণ করতে পুঁজি ও কর্পোরেটকে সমস্ত ধরনের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা। কোটি কোটি শ্রমিকদের সঁপে দেওয়া হলো কর্পোরেট ও বহুজাতিক সংস্থার করুণার উপর।

সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার বুজরুকি :

কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করছে, সংগঠিত ক্ষেত্রের ক’য়েক কোটি শ্রমিকদের মধ্যে আটকে না থেকে মজুরি কোড সমগ্র ৫০ কোটি শ্রমজীবী মানুষকেই নিয়ে এলো আইনের আওতায়। জনগণ ও শ্রমজীবীদের কাছে এটা হলো এক ডাহা মিথ্যাচার। বস্তুত, সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি সুপারিশ করেছিল, যে সমস্ত সংস্থায় দশ বা তার অধিক কর্মী কাজ করছেন, সেই সমস্ত সংস্থাকে বোনাস আইনের আওতায় আনতে হবে। মজুরি কোড সেই সুপারিশকে খারিজ করে জানিয়েছে যে, কুড়ি বা তার বেশি কর্মী যেখানে কাজ করেন, সেগুলোই আসবে বোনাস আইনের আওতায়। এর ফলে কোটি কোটি শ্রমিক বোনাসের সু্যোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। যে ইনফর্মাল সেক্টরের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ১০-এর কম শ্রমিক রয়েছেন, অগুনতি এই শ্রমিকেরা থেকে যাবেন বোনাস আইনের বাইরে। ম্যানেজমেন্টের বৃত্তে থাকা ম্যানেজেরিয়াল, প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা, টেকনিক্যাল বা ক্লারিক্যাল কাজে নিয়োজিত মধ্যবর্তী স্তর, যারা সাধারণত ম্যানেজমেন্টেরই অংশ, তাদের আনা হয়েছে মজুরি কোডের আওতায়। বিজেপি ম্যানেজমেন্ট পদমর্যাদার ব্যক্তিদের ভাল-মন্দের প্রতি যত্নশীল হলেও শ্রমিকদের ঠেলে দিল নিঃসীম অন্ধকারে।

“শ্রমিক ও কর্মচারীর’’ দুর্বোধ্য সংজ্ঞা : বিপুল সংখ্যক আউটসোর্স কন্ট্রাক্ট শ্রমিকরা থেকে গেলেন আইনী রক্ষাকবচের বাইরে :

শ্রমিক ও কর্মচারিদের মধ্যে ঠিক কী ফারাক টানা হয়েছে? যতক্ষণ না সংশ্লিষ্ঠ আইনের রুলস্ বা বিধিনিয়ম তৈরি হয়, ততদিন পর্যন্ত এই রহস্যের সমাধান হবে না। পার্থক্য না টানার এই ধূর্তামির বিরুদ্ধে স্ট্যান্ডিং কমিটি নির্দিষ্টভাবে তার আপত্তিকে নথিভুক্ত করে। তারা জানায়, শ্রমিক ও কর্মচারি সংজ্ঞার মধ্যে রীতিমতো অসংগতি রয়েছে। কিন্তু, সরকার এই সব আপত্তিকে পাত্তাই দিল না। অ্যাপ্রেন্টিসদের পুরোপুরি শ্রমিক সংজ্ঞার বাইরেই রেখে দেওয়া হলো। ফলে, কর্পোরেটরা এর পর অ্যাপ্রেন্টিসদের শোষণকে নিয়ে যাবে চরম পর্যায়ে। নতুন সংশোধনীর দৌলতে তাঁরা এমনকি ন্যুনতম মজুরির আওতায় ও আসবেন না। একজন, সুপারভাইজারের বেতন সীমা মাত্র ১৫,০০০ টাকা। এদিকে, বহু রাজ্যে ন্যুনতম মজুরি এখন ১৫,০০০ টাকার আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে।

স্থায়ী কাজের ধারণাটাকেই একেবারে বাতিল করে দেওয়া হলো। এমনকি কেড়ে নেওয়া হলো স্থায়ী কর্মীর অধিকার ও সুযোগ সুবিধাগুলো। যে কোনো সংস্থায় কন্ট্রাক্ট ও অন্যান্য ইনফর্মাল শ্রমিকদেরকে স্থায়ী শ্রমিকদের সমহারে নিয়ে আসার বদলে এদের (অর্থাৎ স্থায়ী কর্মীদের) অবনমন ঘটিয়ে তাঁদের অধিকার-মজুরি-কাজের শর্তাবলী এবং কর্মজগতের পরিবেশকে আনা হচ্ছে ইনফর্মাল কর্মীদের সমকক্ষে।

স্ট্যান্ডিং অর্ডার আইনের নিয়মবিধিকে সংশোধন করে খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো “ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট”। বর্তমানে এটাকেই কর্মজগতে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বর্গ হিসাবে সামনে আনা হচ্ছে। মজুরি কোডের পেছন পেছন অনুসরণ করে আর যা কিছু সামনে আসছে তাতে নিয়োগ কর-ছাঁটাই কর, এটাই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংগঠিত ক্ষেত্র বা অসংগঠিত, যাই হোক না কেন, ইনফর্মাল প্রথায় কাজ করানোটাই এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। শোষণ-উৎপীড়নকে আরো তীব্রতর করতে ফিক্সড টার্ম, কন্ট্রাক্ট, অ্যাপ্রেন্টিস, ট্রেণি এবং অন্যান্য শোষণমূলক ধরনগুলোকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

সংজ্ঞা অনুযায়ী, তারাই হলেন ‘কন্ট্রাক্ট শ্রমিক’ ঠিকাদার যাদের সরবরাহ করে থাকে। অন্যভাবে বললে এরা হলেন লেবার সাপ্লাই কন্ট্রাক্টর। এরা মূল নিয়োগকর্তার চত্বরেই কাজ করেন। কিন্তু, যে শ্রমিকেরা ওই একই চত্বরে বা তার বাইরে আউটসোর্স হয়ে যাওয়া কাজগুলো করেন, তারা কিন্তু থেকে যাচ্ছেন আইনের ত্রিসীমানার বাইরে। কোড স্পষ্ট করে জানিয়েছে, ঠিকাদারের সংস্থায় কর্মরত শ্রমিকরা আইনের আওতায় আসছেন না। টিম লিজ-এর মতো এমন অনেক সংস্থা রয়েছে যারা কর্পোরেটদের মানব সম্পদ সরবরাহ করে থাকে। টিম লিজের মতো সংস্থাগুলো দাবি করে থাকে যে, তারা যে সমস্ত শ্রমিকদের সরবরাহ করে থাকে তারা তাদেরই সংস্থার, মুল নিয়োগকর্তার নয়। এইভাবে কোড ওই সমস্ত সংস্থাগুলোকে আইনি রক্ষাকবচ দিচ্ছে। আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোটাই এখন আইন হয়ে দাঁড়ালো।

যে সমস্ত শ্রমিকেরা পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন, বা, সমঝোতার মাধ্যমে আইন মোতাবেক নিয়মিত ব্যবধানে মজুরি বৃদ্ধি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু কন্ট্রাক্ট শ্রমিক হিসাবে বিবেচিত হবে না, তাঁদের কর্মস্থল যা-ই হোক না কেন। লেবার কোড বলছে, “তার কাজকর্ম পরিচালিত হবে পারস্পরিক ভাবে গ্রহণযোগ্য কাজের শর্তাবলীর দ্বারা (স্থায়ীভাবে নিযুক্ত হলেও), আর তাঁরা কন্ট্রাক্ট শ্রমিক হিসাবে গণ্য হবে না। কোড আরো বলছে,’’ (যদি কোনো শ্রমিকের) নিয়মিত ব্যবধানে মজুরি বাড়ে, আইন অনুযায়ী সামাজিক সুরক্ষা ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করে থাকেন, যা কিনা ওই পেশার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত” তবে তাঁরাও কন্ট্রাক্ট শ্রমিক হিসাবে গণ্য হবেন না।

এই সংজ্ঞাটা এমনভাবেই তৈরি হয়েছে যাতে ব্যাপক শ্রমিকেরা থেকে যায় আইনের বাইরে। শিল্পপতিরা এবার থেকে আইন ফাঁকি দিতে তাদের মতো করে শ্রমিকদের হরেক বর্গ তৈরি করবে আর শ্রম কোড ওই সমস্ত ‘বে-আইনি’ কার্যকলাপকে আরো বেশি মদত দিচ্ছে। এবার থেকে কোনো সংস্থার/রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র/কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারি সংস্থার সাথে কোনো না কোনো কাজের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের উপর প্রধান নিয়োগকর্তার কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা থাকবে না, মূল নিয়োগকর্তাকে ও কোনোভাবে চিহ্নিত করা যাবে না।

এতদিন ধরে যে সমস্ত ক্ষেত্র গুলোতে কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের নিয়োগ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সেগুলো হল — স্থায়ী ও সারা বছর ধরে নিয়মিত কাজ, মূল উৎপাদনের আনুসাঙ্গিক কাজ, আর এটাও দেখা হতো কে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করতো। এসব এখন ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো। ‘কোর’, ‘নন কোর’, স্থায়ী চরিত্রসম্পন্ন ও মরশুমী বা প্রান্তিক ধরনের কাজের ক্ষেত্রে পার্থক্য টানার ফলে সংস্থাগুলো প্রধান বা মূল উৎপাদনের জায়গাগুলোতে কন্ট্রাক্ট শ্রমিক নিয়োগে আইনি বাধার সম্মুখীন হতো। এখন সেগুলোকে জলাঞ্জলি দেওয়া হলো। এই কোড নিয়োগকর্তাকে আইন লঙ্ঘনের ঢালাও সুযোগ দিচ্ছে, যাকে কাজে লাগিয়ে নিয়োগকর্তা এক একজন শ্রমিকের সঙ্গে পারস্পরিক চুক্তি করবে, নিয়মিত ইনক্রিমেন্টের বদলে নাম কা ওয়াস্তে মহার্ঘ ভাতা দিয়ে নিজের হাত ধুয়ে ফেলবে। মূল ভাবনাটাই হলো, পুঁজি ও উৎপীড়কের দয়ার উপর শ্রমিকদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। মজুরি কোডের মাধ্যমে রচিত হলো দাসত্বের নতুন এক ধরন।

অতি মুনাফার লোভে মজুরিকে বেঁধে রাখা হচ্ছে নিচু স্তরে :

কোডের ব্যাখ্যা হলো, অ্যালাউন্স বা ভাতাকে মজুরি হিসাবে গণ্য করতে হবে। যদি তা ৫০ শতাংশের বেশি হয়, বা কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নির্দ্ধারিত শতকরার একটা নির্দিষ্ট হার হয়, তবে তা মজুরির মূল বা বেসিক, মহার্ঘ্য ভাতা ও অন্যান্য ভাতার সমতূল্য হবে। মজুরি ও ভাতার সংজ্ঞা নিরুপণ ও সরকারের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেওয়া হলো। দ্বিতীয়ত, কোড এটাও বলেছে, মহিলাদের সম হারে মজুরি নিরুপণে ঘর ভাড়া- ওভারটাইম-এর ভাতা ও অন্যান্য ভাতাকেও মজুরি বলে গণ্য করা হবে। মহিলাদের মজুরি কমানোর জন্যই কি এ সব করা হচ্ছে, নাকি মহিলা শ্রমিকরা যাতে সম মজুরি পায়, তার জন্য এ সব বলা হচ্ছে — সে প্রশ্ন থেকেই যায়। মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সমমজুরির প্রশ্নে, দক্ষতা-প্রচেষ্টা-দায়িত্ববোধ-অভিজ্ঞতা এসব কিছুকে যুক্ত করা হচ্ছে। এখন, ‘প্রচেষ্টার’ প্রকৃত সংজ্ঞা নিরুপণ নিছক একটা তামাশা হয়ে উঠবে। নিয়ম বিধি যতক্ষণ না পর্যন্ত লাগু হয়, ততদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আর, ন্যুনতম মজুরি নির্দ্ধারণের সময় নির্দিষ্ট কোম্পানিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও পরিষেবা দেওয়াটা ধর্তব্যের মধ্যে আনা হবে না। নতুন কাজে যোগ দেওয়া একজন শ্রমিকের সমকাজে সম মজুরি পাওয়ার বিষয়টা বা বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন এমন শ্রমিকের মজুরির হার নির্দ্ধারণ করাটা ও নিয়োগ কর্তার মর্জ্জির উপর নির্ভর করবে। মজুরি প্রদানে বৈষম্য নিহিত রয়েছে কোডের মধ্যেই। শ্রমিক শ্রেণির বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রকটভাবে বেড়ে চলা বৈষম্য ও দারিদ্র কোডের কাছে যুক্তিযুক্ত হয়ে উঠেছে। এ প্রশ্নে স্ট্যান্ডিং কমিটি জোরালো আপত্তি জানানো সত্ত্বেও সরকার নির্দিষ্ট সুপারিশগুলোকে খারিজ করে দিয়েছে।

এই কোড সবচেয়ে বড় আক্রমণ নামিয়েছে মজুরির প্রশ্নে। কোড মজুরি নির্দ্ধারণের কোনো বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা বা পদ্ধতি নির্দিষ্ট করেনি। ভারতীয় শ্রম সম্মেলন, Raptacs Bret-এর ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায়, প্রভৃতিতে চার সদস্য বিশিষ্ট পারিবারিক ইউনিটে মাথা পিছু ২৭০০ ক্যালোরি খাদ্য ও অন্যান্য আরো কিছু মানদন্ডের উপর ন্যুনতম মজুরি নির্দ্ধারণের উপর জোর পড়ে। পরবর্তীতে, সরকার বয়স্ক অভিভাবকদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আইন প্রণয়ন করে। তাই, যুক্তির খাতিরে, একটি পরিবার ৬ জন সদস্যর হবে। কিন্তু এসবগুলোকে হিসাবের মধ্যে ধরাই হচ্ছে না। উল্টে বলা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ঠ সরকার গণনার পদ্ধতি নিরূপণ করবে। আর, এইভাবে, কর্পোরেটদের স্বার্থে আমলাতান্ত্রিক গোঁজামিল ও নানা কারসাজির রাস্তা খোলা রেখে দেওয়া হলো।

এবার থেকে, দেশে দু’ ধরনের মজুরি প্রথা চালু হলো। “ফ্লোর মজুরি” এবং “ন্যুনতম মজুরি’’। রীতিমতো মস্করা করে, ২০১৯-র মোদী সরকার ফ্লোর মজুরি বাড়ালো মাত্র দু’ টাকা। প্রকৃত মজুরির ক্ষয়কে রোধ করতে ভোগ্যপণ্য মূল্য সূচকের বৃদ্ধির সঙ্গেও যা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রকৃত ইনক্রিমেন্টের কথা না হয় বাদই দেওয়া হলো। এই মুহূর্তে ফ্লোর মজুরি দৈনিক মাত্র ১৭৮.০০ টাকা। অর্থাৎ, মাসে ৪৬২৮.০০ টাকা। ন্যুনতম মজুরি আইন, ১৯৪৮-কে বাতিল করার পর মজুরি কোডে সরকারকে স্পষ্টভাবে জানানো উচিত ছিল যে ন্যুনতম মজুরি প্রদান বাধ্যতামূলক। এখন, বেশ কিছু রাজ্যে ন্যুনতম মজুরি ১৫,০০০ টাকার আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। অন্যান্য আরো কিছু রাজ্য সেদিকেই এগোচ্ছে। কিন্তু এ প্রশ্নে মজুরি কোড ধোঁয়াশাই রেখে দিল।

তাই, এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, মোদী সরকার শিল্পপতি ও কর্পোরেটদের স্বার্থে মজুরিকে নীচের দিকে বেঁধে রাখতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন থেকে বাজার আর মজুরির হার নির্দ্ধারণ করবে না। এমনকি, প্রয়োজনীয় ক্যালোরির বর্তমান বৈজ্ঞানিক মানদন্ডের ভিত্তিতেও তা নিরূপিত হবে না। বরং তা হবে কর্পোরেট-ঘেষা কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক পথে। উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে মুনাফা অর্জনের বিপরীতে শ্রমিকদের মজুরি লুঠ করে মালিকপক্ষ তার মুনাফা বাড়াবে। দক্ষতার স্তর ও অন্যান্য শর্তাবলীর পাশাপাশি, মজুরি নির্দ্ধারণের ক্ষেত্রে “শিল্প সহ অঞ্চল’’ ফর্মুলাটা বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু মজুরি কোড এটাকে বদলে ‘অঞ্চলের’ ফর্মুলা সামনে আনছে, যা ফ্লোর মজুরির সাপেক্ষে যথেষ্টই বিস্তৃত।

(পরবর্তী সংখ্যায় সমাপ্ত)

খণ্ড-26
সংখ্যা-34