৫ আগস্ট ’১৯ মধ্যরাতে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সংবিধানের সত্তর বছরের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা সম্বলিত এক রাজ্যের স্বাধিকার, সেই দগদগে ক্ষতভূমিকে তারপর দু-টুকরো করা হল, কায়েম হল দুটি কেন্দ্রীয় শাসনাধীন অঞ্চল —একদিকে জম্মু-কাশ্মীর, অন্যদিকে লাদাখ। এভাবে শাসনক্ষমতার এক নজীরবিহীন বলদর্পী প্রয়োগের অভিযান শুরু করা হল। কিন্তু এই ‘পরিবর্তনে’র পরিঘটনা উপত্যকার পরিস্থিতিকে আরও প্রতিকূল করে তুলবে। কাশ্মীরী জনমনের নাগাল পাওয়া আরও দূরূহ হবে।
প্যাটেলের জন্মদিবসে তাঁর সর্বোচ্চ বিশালাকার মূর্তির পাদদেশে দাঁড়িয়ে মোদী বললেন, পাকিস্তান ভারতের সাথে যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারে না, তাই ভারতে সীমান্ত সন্ত্রাসবাদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ঐক্য ও সংহতির বিনাশ ঘটাচ্ছে। মোদী-শাহ’রা মুখে সেই একই জাবর কেটে চলছেন। কাশ্মীর সমস্যা সৃষ্টির জন্য একমাত্র দায়ী পাকিস্তান! আরেকটি কারণ ছিল আস্কারা পাওয়ার দুর্বলতা হিসেবে, সেটা হল বলবৎ থাকা সংবিধানের ৩৭০ ধারা, যা ইতিমধ্যে খারিজ করে দিয়ে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করার অধিকার শুধুমাত্র নয়, এতকাল রাজ্য হিসাবে গণ্য থাকার মর্যাদাও কেড়ে নেওয়া হল। ভারত রাষ্ট্রের আচরণ যেন কত সদাশয় চরিত্রের! তবে কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতার আজকের ঠিকেদাররা প্রকৃত ইতিহাসের সত্য চেপে দিতে পারছেন না। তারা আজ প্যাটেলকে তাদের পূজ্য প্রতীক বা আইকন বলে আত্মসাৎ করতে চাইছেন। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে ৩৭০-এর প্রবর্তন শুরুর সময়ে প্যাটেল ছিলেন নেহরু মন্ত্রীসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর প্যাটেলের তাতে সায় ছিল। এখন ঠ্যালায় পড়ে ধ্রুব সত্য চেপে যাওয়া অসম্ভব বুঝেই ওরা ইতিহাসের প্রকৃত তথ্যের বিকৃত প্রচার করে চলছেন। ওরা বলছেন, প্যাটেল ৩৭০-এর সংযুক্তি স্বেচ্ছায় মানেননি, নেহরু লবির চাপে মানতে বাধ্য হয়েছিলেন! আর ধারাটি সংযুক্তির মধ্যে নিহিত নির্যাস ছিল নাকি ‘সাময়িক’! ধরা যাক হয়ত তাইই ছিল। যা ছিল ‘সাময়িক’, সময়ের প্রবাহে তার আরও সমৃদ্ধ স্থিতিশীল অনুশীলন ও উত্তরণ ঘটিয়ে চলাই তো ছিল যুগ-ধর্ম পালনের অব্যাহত দাবি। তার বদলে ক্ষমতার দাদাগিরির সুযোগ পেয়ে গিয়ে এক বিশেষ মর্যাদার সাংবিধানিক স্বাধিকারের পরম্পরা কেড়ে নেওয়া হল। এর প্রতিক্রিয়া কাশ্মীরী চেতনায় মননে কেবলই মানতে না পারার প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে। সেটা বুঝতে কেন্দ্রের ধুরন্ধর শাসকরা ভুল করেনি। তাই উপত্যকাকে কেন্দ্রের শাসনাধীন দু-টুকরো করার আগে গোটা কাশ্মীরকে করল বন্দী।
পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ও ভারত-প্রাসঙ্গিক কূটনৈতিক রাজনীতিতে ইসলামিক ‘কাশ্মীর তাস’ বরাবর রয়েছে ভীষণভাবেই। পক্ষান্তরে, ভারতরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিজেপিও কাশ্মীরকে বানাতে চাইছে হিন্দুত্বের জাতীয়তাবাদের ‘তুরুপের তাস’।
প্রহসনের বৈপরীত্যগুলো লক্ষণীয়। কাশ্মীর সমস্যাটি মূলত রাজনৈতিক, গণতন্ত্রের প্রশ্ন সেখানে আজও সবচেয়ে আকাঙ্খার, যত উন্নত মাত্রায় হোক স্বায়ত্ততার দাবি জানায়। কাশ্মীরীরা কোনো বৈষয়িক লাভলোভ বশত কাশ্মীরী সংবেদনা বিসর্জন দিতে পারে না, বরং কাশ্মীরী স্বাভিমানের মর্যাদা রক্ষার জন্য হেলায় সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। কিন্তু ভারত সরকার সমস্যাটার ‘সমাধান’ সওয়াল করছে মূলত সামরিকভাবে, কাশ্মীর পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে ‘আইন শৃঙ্খলা’র নামে, পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নামে, আর আচরণ করছে এক যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রশক্তির মতো। গোয়েবেলসীয় ঢঙে জলমেশানো পরিসংখ্যান ফেরী করছে, গত তিন দশকে ওই সন্ত্রাসবাদীদের হাতে ভারতীয়দের জীবন গেছে নাকি চল্লিশ হাজার! কিন্তু কিছুতেই কখনও স্বীকার করে না কত হাজার হাজার কাশ্মীরী যুবশক্তি শেষ হয়ে গেছে, লাশ হয়ে গেছে, ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেছে, পঙ্গু হয়ে গেছে। যৌন হিংসার শিকার হয়েছে কত সহস্র নারী, নির্যাতনের বলি কত কত শিশু। আর সেখানে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের ওপর সান্ত্রীবাহিনী সংগঠিত ভয়ঙ্কর অত্যাচার, গণধর্ষণের বিচার ও শাস্তির হাত থেকে ধর্ষকদের পরিত্রাণের দাবিতে বের হওয়া মিছিলে বিজেপি মন্ত্রী-বিধায়কদের অংশগ্রহণ! মোদী ভাষ্য কেবল ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের হাতে সেনাদের প্রতি ‘পাথর ছোঁড়া’র গল্প শোনায়, সেনাদের দ্বারা পেলেট বুলেট বৃষ্টির কথা চেপে যায়। অবরুদ্ধ বন্দী কাশ্মীর যেখানে প্রতিনিয়ত যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, সেখানে মোদী সরকার বহির্জগতকে মিথ্যা স্তোকবাক্য দিয়ে, ভূয়ো আলোকচিত্র দেখিয়ে বিশ্বাস করাতে চাইছে কাশ্মীরে ‘শান্তি-সুস্থিতি ফিরে এসেছে’।
কিন্তু এতো ছলনার আশ্রয় নিয়েও যখন বিশ্বাস করানো সম্ভব হচ্ছে না, তখন মরীয়া হল সুপরিকল্পিত এক সাজানো পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের সূচীরূপ দিতে। তবে সেটা করতে গিয়ে যত শঠতার পরিচয় দিয়েছে ততই নিজেকে আরও নীচে নামিয়েছে। নিজেদের স্বরূপ নিজেরাই উন্মোচিত করল। মোদী-শাহ-ভাগবত জমানা কাশ্মীর সমস্যা ভারতের আভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে খুব গলাবাজি করে। ভারত সরকার কখনই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষা সনদে স্বাক্ষরকারী থাকেনি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মঞ্চ থেকে বারবার হুঁশিয়ারী দেওয়া হয়েছে। তবু কখনই ভারত সরকারের সেনাদের দ্বারা কাশ্মীরী মানবতা ক্ষতবিক্ষত হওয়ার কোনও রিপোর্ট যায়নি। অথচ ২০১৭ সালের মধ্যেই হতাহত কাশ্মীরীদের সংখ্যা পৌঁছে যায় হাজারে হাজারে। এইসমস্ত ঘটনার প্রেক্ষাপটে পুনরায় প্রহসনের পরিণাম বড় মারাত্মক। কাশ্মীরের ভেতর বা বাইরে থেকে দেশের কোনও সংস্থা বা ব্যক্তিবিশেষের কাশ্মীর ঘুরে দেখার অনুমতি নেই। এমনকি দেশের সাংসদ-বিধায়কদের স্বাধীনভাবে কাশ্মীর পরিদর্শনের অধিকার নিষিদ্ধ। অথচ ন্যায়নীতির মাথা খেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নিয়নের একদল পছন্দসই কট্টর দক্ষিণপন্থী সাংসদকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হল। তারা এলেন দেখলেন ফিরে গেলেন অনাহুত পরিব্রাজকের মতোই। তাদের কাছে কাশ্মীরী জনতা মনের ভাব খোলেনি, বরং রঙ্গ দেখতে আসার অভিযোগ তুলে করেছে বিদ্রূপ। জ্বলছে সেখানে গণক্ষোভ ও অসন্তোষের আগুন ধিকিধিকি। আর সেই পরিবেশ পরিস্থিতিতে কুলগামের মতো চূড়ান্ত অবাঞ্ছিত ঘটনাও ঘটে যাওয়ার জমি পেয়ে যায়। সবকিছু সবসময় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে না। এর জন্য দায়ী আর কিছু নয়, মোদী-শাহ সরকারের ধ্বংসাত্মক কাশ্মীর নীতি।
প্রকৃত জাতিয়তাবাদ কখনও এককেন্দ্রীকভাবে জবরদস্তি চাপিয়ে দেওয়া যায় না। প্রকৃত জাতিয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে হবে, আর সেটা কেবলমাত্র অর্জন করা সম্ভব বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতিসত্তাগুলির বৈশিষ্ঠ্যপূর্ণ স্বেচ্ছা সম্মিলন, স্বাধিকার, আবেগ ও মননের আত্তিকরণের প্রক্রিয়ায়। তাই ‘এক দেশ এক আইন’-এর শাসনব্যবস্থার নামে কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপের যে পদক্ষেপ করা হল তার মধ্যে প্রকৃত জাতীয়তাবাদের পুনরুদ্ধার বা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লেশমাত্র নেই। সেখানে প্রকৃত অর্থে কায়েম করা হল বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্বের জাতিয়তাবাদ ও কঠোর রাষ্ট্রবাদের মিশেল।