মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভার নির্বাচন বিজেপি অনায়াসে জিতে নেবে বলেই ব্যাপকতর স্তরে মনে করা হয়েছিল। বুথ ফেরত সমীক্ষাগুলোতেও মোটের উপর কর্পোরেট মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে তুলে ধরা এই অভিমতেরই প্রতিফলন ঘটেছিল। বিজেপি হরিয়ানায় বিপুলভাবে জয়ী হবে বলেই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, এক বুথ ফেরত সমীক্ষা তো হরিয়ানার ৯০ সদস্যের বিধানসভায় বিজেপির পাওয়া সম্ভাব্য আসন সংখ্যা একেবারে ৮৩টি হবে বলে বলেছিল। মহারাষ্ট্রে পূর্বাভাস ছিল যে বিজেপি নিজেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে। চূড়ান্ত ফলাফল কিন্তু বাস্তব অবস্থা যাচাইয়ের এক মধুর বিস্ময়কর ব্যাপার হয়েই দেখা দিল। হরিয়ানায় বিজেপিকে নির্বাচন-পরবর্তী পর্যায়ে এক নতুন সহযোগীকে খুঁজে পেতে হয়েছে, আর মহারাষ্ট্রে তাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে যেখানে শিব সেনার বাড়তি দাবি এবং প্রবলতর করে তোলা চাহিদার সঙ্গে বোঝাপড়া করা ছাড়া তার গতি নেই।
এই বিস্ময় যে শুধু শেষ পর্যন্ত প্রাপ্ত আসনের মধ্যেই রয়েছে তা কিন্তু নয়, বিস্ময়টা আরো বেশি করে রয়েছে বিরোধী দলগুলোর প্রার্থীদের জয়ের ব্যবধানের মধ্যে। গ্ৰামীণ মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানা কি প্রবলভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে, এই ব্যবধানের মধ্যে তার প্রতিফলন ঘটেছে। গ্ৰামীণ মহারাষ্ট্রের কিছু-কিছু অংশে বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান যথার্থই নির্বাচনী বিপ্লবের মাত্রা পেয়েছে। লাতুর গ্ৰামীণ ক্ষেত্রটির কথাই ধরা যাক। ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথমবার বিজেপি-শিব সেনা জোটের প্রার্থীকে অনেক পিছনে তৃতীয় স্থানে ঠেলে দিয়ে নোটা লাভ করেছে দ্বিতীয় স্থান, আর কংগ্রেস-এনসিপি জোটের প্রার্থী অনায়াসে এক লক্ষেরও বেশি ভোটে জয় হাসিল করেছে। আর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলেন গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি প্রার্থী পঙ্কজা মুণ্ডে, যিনি হলেন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত এক মন্ত্রী এবং মহারাষ্ট্রে বিজেপির প্রয়াত বরিষ্ঠ নেতা গোপিনাথ মুণ্ডের কন্যা। মোদী এবং শাহ দুজনেই তাঁর হয়ে প্রচার করা সত্ত্বেও তিনি ৬০০০০ ভোটে পরাজিত হয়েছেন।
বিজেপি আশা করেছিল, তার ‘কাশ্মীর বিজয়’, তিন তালাককে শাস্তি যোগ্য অপরাধ করে তোলার আইন প্রণয়ন এবং এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনীর মিলিত কার্যকারিতা দিয়ে তথাকথিত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নির্বাসিত করার প্রতিশ্রুতি তাদের প্রভূত নির্বাচনী ফায়দা এনে দেবে। আর মহারাষ্ট্রের জন্য অতিরিক্ত একটা বিষয় ছিল এবং তা হল সাভারকারকে ভারত রত্ন দেওয়ার ঘোষণা। ভোটাররা স্পষ্টতই খুশিতে ডগমগ হননি এবং তাদের পুরোদস্তুর অপদার্থতা এবং জনগণের দুর্দশার প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ অনীহার জন্য বিজেপি সরকারগুলোর যে শাস্তি প্রাপ্য ছিল তা তাদের দিয়েছেন। মহারাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই তীব্র কৃষি সংকটে টলমল করছে। ব্যাঙ্ক ক্ষেত্রে সংকট — পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে জমা টাকা তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে যা মূর্ত রূপ পেয়েছে এবং অর্থনীতিতে প্রবল মন্থরতা ও বন্যা জনিত ক্ষয়ক্ষতি লক্ষ-লক্ষ মানুষের দুর্দশাকে তীব্রতর করে তুলেছে। বিজেপি যে উগ্ৰ-জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়েছে তা ভোটারদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছে এবং এবারের নির্বাচনে জনগণ সুস্পষ্ট রূপেই তাঁদের ক্রোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
বিজেপির কাশ্মীর কার্যক্রম লক্ষণীয়ভাবে ব্যর্থ বলে প্রতিপন্ন হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরে অনুষ্ঠিত বিডিসি নির্বাচনে। মোদী সরকার বন্দীশালা কাশ্মীরে যেটাকে ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ এবং ‘গণতন্ত্র’ বলে বর্ণনা করে সেটাকে জাহির করার জন্যই এই নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। বিজেপি ছাড়া রাজ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো যে নির্বাচন বয়কট করে, কেবলমাত্র নির্বাচিত পঞ্চ ও সরপঞ্চদের নিয়ে গঠিত ইলেক্টোরাল কলেজের অংশ নেওয়া সেই নির্বাচনে প্রায় সমস্ত ভোট পড়েছে বলে প্রশাসন দাবি করে। বিজেপির সন্ত্রাস কৌশল তাকে কয়েকটি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে সক্ষম করলেও — বিশেষভাবে উপত্যকার সোপিয়ান জেলায় — সামগ্ৰিক ফলাফল দেখিয়েছে যে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, আর প্রায় সারা রাজ্যেই নির্দলীয়রা আধিপত্য করেছে। তিনটি অঞ্চলের ৩০৭টি ব্লকের মধ্যে বিজেপি জেতে মাত্র ৮১টি আসন আর নির্দলীয়রা জেতে ২১৭টিতে। বিজেপি শুধু যে উপত্যকাতেই গোহারান হেরেছে তাই নয়, তার শক্তিশালী জায়গা জম্মুতেও সে নাস্তানাবুদ হয়েছে (জম্মুতে ১৪৮টি আসনের মধ্যে নির্দলীয়রা জয়ী হয়েছে ১৪৮টি আসনে, আর বিজেপি ও প্যান্থার্স পার্টি পায় যথাক্রমে ৫২ ও ৮টি আসন)। এমনকি লাদাখেও ৩১টি আসনের মধ্যে নির্দলীয়রা জয়ী হয় ২০টি আসনে আর বিজেপি পায় মাত্র ১১টি আসন।
নির্বাচন থেকে উঠে আসা বার্তায় কান দেওয়ার কোনো আগ্ৰহই অবশ্য বিজেপির নেই, তার একমাত্র উৎসাহ রয়েছে অর্থনীতির বেসরকারিকরণ, মূল্যবান সম্পদের লুন্ঠন এবং সমাজের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপর্যয়কর এজেণ্ডাকে মরিয়াভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে। তার স্বৈরাচারী কাশ্মীর নীতির জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন এবং ধিকৃত হয়ে পড়ে মোদী সরকার এখন বিশ্বের কলঙ্কিত ও ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলোর কাছ থেকে সার্টিফিকেট পেতে চাইছে। কলঙ্কজনক এক পদক্ষেপ নিয়ে মোদী সরকার সদ্য-সদ্য ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বাছাই করা অতি-দক্ষিণপন্থী একদল সাংসদকে এদেশে এনে আপ্যায়ন করে। এই সাংসদরা তাদের কট্টর ইসলাম-বিরোধিতা প্রসূত অভিবাসন-বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য কুখ্যাত; এক সন্দেহজনক এনজিও এবং স্বঘোষিত আন্তর্জাতিক মধ্যস্থাকারীর সহায়তায় এদের বেসরকারিভাবে আমন্ত্রণ জানানো এবং সঙ্গে করে কাশ্মীর পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং এমন সময় তা করা হয় যখন কাশ্মীরের নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ জনগণকে গ্ৰেপ্তার করে রাখা হয়েছে এবং বিরোধী দলগুলোর সাংসদ এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের ঐ রাজ্যে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা মামলার রায় দিতে চলেছে এবং সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে পাশ করানোর পরিকল্পনাও সক্রিয় রয়েছে।
নির্বাচনের বার্তা স্পষ্টতই জনগণ এবং বিরোধী পক্ষের শক্তিগুলোর কাছেই জরুরী। হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্র সংশয়হীন ভাবে দেখিয়ে দিয়েছ, বিরোধী পক্ষের দৃঢ় ও উদ্দীপিত প্রচার এবং জোরালো ও লাগাতার সক্রিয়তা কি ফলাফল এনে দিতে পারে। চৌতালা পরিবার থেকে সদ্য জন্ম নেওয়া দলটির ডিগবাজির কল্যাণে বিজেপি হরিয়ানায় কোনক্রমে ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে (অজয় চৌতালার ছেলে হরিয়ানায় বিজেপি-জেজেপি জোট সরকারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরপরই তাঁকে দিল্লীর তিহার জেল থেকে দু-সপ্তাহের জন্য ছুটি মঞ্জুর করা হয়)। হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রে বিজেপি কোনোমতে পার পেয়ে যাওয়ার পর দিল্লী ও ঝাড়খণ্ডকে এবার মোদী-শাহ সরকারের স্বৈরাচারী ঔদ্ধত্যকে এক মোক্ষম ধাক্কা দিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হল, রাস্তায় নেমে লড়াই করা জনগণের ঐক্য ও অঙ্গীকারকে আগামী দিনে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে। এনআরসি-নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের দুরভিসন্ধিমূলক অভিপ্রায়, কাশ্মীর বা অযোধ্যাকে ধরে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি অথবা দরিদ্র-বিরোধী কর্পোরেটপন্থী নীতিমালা সৃষ্ট সর্বনাশ — যাই ঘটুক না কেন, জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্ৰাম বিপর্যয়কর মোদী-শাহ সরকারকে মুখের মতো জবাব দেবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ২৯ অক্টোবর ২০১৯)