স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়া থেকে শুরু করে অমিত শাহের হামলা-হুমকির প্ল্যান পলিসিতে কোনো বিরাম নেই। ৩৭০ ধারা খারিজ পরবর্তী কাশ্মীরকে আধা সেনায় মুড়ে দিয়ে পরিণত করা হয়েছে এক কারাগারে। উপত্যকায় ‘গণতন্ত্র’ চলছে বেয়নেটের ডগায় আর নেট-দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে। বন্ধ ন্যায় বিচারের দাবি করার আইন-আদালতের সমস্ত দরজা। স্তব্ধ স্বাভাবিক জনজীবনের সবকিছুই। বিধ্বস্ত ফলের বাগিচা থেকে পর্যটন গোটা অর্থনীতি। কাশ্মীরী জনতার বুকে জ্বলছে ধিকিধিকি তুষের আগুন। কখনও কখনও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে আনাচে-কানাচে। অন্যদিকে কাশ্মীরের বাইরের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। যদিও এখনও ঝড় ওঠার মতো নয়, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠছে প্রতিবাদ। এই পরিস্থিতিতে অমিত শাহরা নিচ্ছেন ‘দুই কৌশল’। একদিকে কাশ্মীর প্রশ্নে অবস্থান এতটুকু নরম না করে কাশ্মীরের পরিস্থিতি সম্পর্কে দৃষ্টি ঘোরাতে, তার জন্য চলছে ‘শান্তি-স্বস্তি-উন্নতি’র সরকারি মিথ্যা প্রচার, কিন্তু ব্যর্থই হচ্ছে এই রঙীন প্রচার, কোথাও বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে না, তাই অন্যদিকে দৃষ্টি ঘোরাতে প্রচারে সামনে আনছে ‘মাওবাদী কাঁটা’ উচ্ছেদের প্রসঙ্গ, ফের শুরু করা হচ্ছে ‘মাওবাদী’ নাম করে গ্রেপ্তারী অভিযান, নিশানায় আসলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকামী মানবাধিকার কর্মীরা, পাশাপাশি সিবিআই হানা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার অফিসে।
অতিসম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গিয়েছিলেন সিআরপিএফ-এর দিল্লীস্থ হেড কোয়ার্টারে, দীর্ঘ বৈঠক করেন আধা সেনার শীর্ষস্থানীয় অফিসারদের সঙ্গে। বৈঠকের মূল বিষয় ছিল ‘শহুরে মাওবাদী’ থেকে শুরু করে কাশ্মীর পরিস্থিতিকে মোকাবিলার সাজ সাজ রব।
ক’দিন আগেই কেন্দ্রের গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে যোগসাজশ করে মহারাষ্ট্র পুলিশকে দিয়ে কয়েকজন মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হল। এদের মধ্যে আছেন গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানী সক্রিয় কর্মীরাও। এই গ্রেপ্তারি নাকি অন্ধ্র, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, বিহার, মহারাষ্ট্র, এমনকি পশ্চিমবাংলায় ‘মাওবাদী তৎপরতা’র সুলুক সন্ধান পেতে! গ্রেপ্তার করা হল কোথায়? কৃষি সংকটে জর্জরিত ও কৃষকের আত্মহত্যায় সবচেয়ে কলঙ্কিত এবং সদ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জোর ধাক্কা খাওয়া মহারাষ্ট্রে। এ থেকে দুটি বিষয় খুব পরিষ্কার ধরা পড়ছে। নির্বাচনে সুবিধা করে উঠতে না পারার সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতে বিজেপি ফের ‘শহুরে মাওবাদী’ গ্রেপ্তারির বাজার জমাতে চাইছে। আর তার হাতে রয়েছে কেন্দ্রের গোয়েন্দা বাহিনী এবং মহারাষ্ট্র পুলিশের ওপর প্রতাপ খাটানো প্রভাব।
ইতিপূর্বে একাধিক রাজ্য থেকে একযোগে ‘শহুরে নকশাল’ তকমা দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের একাংশকে গ্রেপ্তারের গল্প আমরা জানি। তারা পেশাগত অধ্যবসায় ও সক্রিয়তায় স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে রয়েছেন সমাজবিজ্ঞানী ও আইন বিশারদজন। তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সরকারকে উৎখাত করার ‘সহযোগী ষড়যন্ত্রকারী’ অভিযোগে। রাজনীতির বাজারে চলেনি সেই ‘গল্প’। মোদী জমানা ফিরবে কিনা সেই অনিশ্চয়তা সৃষ্টির পেছনে কোনো ‘চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র’ ছিল না। কারণ হয়ে উঠেছিল জনবিরোধী-দেশবিরোধী মোদী নীতি এবং তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী মোদী হঠাও রণধ্বনি। তবে এতো প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও বিজেপি যে রেকর্ডভোটে ক্ষমতায় ফিরতে পেরেছে, তার কারণ নিশ্চিতভাবে অনেকাংশেই ছিল মোদীরাজ সৃষ্ট ‘পুলুওয়ামা-বালাকোট ঘটানোর মধ্যে। উপরোক্ত ধৃতদের সর্বোপরি পরিচয় হল তারা মানবাধিকার রক্ষার চিন্তাশীল সক্রিয় কর্মী। বিশেষত দলিত, আদিবাদী, সংখ্যালঘু, নিম্নবর্ণের হয়ে লড়াই চালানোই তাদের লক্ষ্য। সরকার তাদের বন্দী করে ফেলে রেখেছে বিনাবিচারে একের পর এক কেস কানেকশন দিয়ে। এই অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বুদ্ধিজীবীরা সরব হয়েছেন, বন্দী মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। মোদী সরকার এদের বিরুদ্ধেও ‘শহুরে নকশাল’দের সহযোগী তকমা দিয়ে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে।
১৫ নভেম্বর সিবিআই হানা সংঘটিত হল অ্যামনেষ্টি ইন্ডিয়ার দিল্লী ও ব্যাঙ্গালোর অফিসে। বিদেশী অর্থ সাহায্য নিয়ন্ত্রণের আইন ভাঙ্গার সন্দেহের কারণ দেখিয়ে। গত কয়েক বছর ধরেই বিজেপির বিষ নজরে পড়েছে অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল ও ভারতে ক্রিয়াশীল তার বিভিন্ন শাখা সংস্থাগুলি। বিশেষত মানবাধিকার কর্মীদের ওপর লাগাতার চালানো পুলিশী সন্ত্রাস, কাশ্মীরে কায়েম পুলিশী-আধা সেনা সন্ত্রাস, আর এখন তা অবর্ণনীয় চরমে ওঠা, এনআরসি-র উচ্ছেদের মৃগয়াভূমিতে পরিণত করা অসম ইত্যাদি নিয়ে বারেবারে সরব হয়েছে, রিপোর্ট দাবি করে আসছে অ্যামনেষ্টি সংস্থা। মোদী সরকার আর বিজেপি সেই চাপের সামনে সত্য গোপনের দায়ে পড়েছে প্রবল অস্বস্তিতে। তাই সন্দেহ নেই পাল্টা ‘বেআইনী অর্থপুষ্টি’র তকমা সেঁটে দিয়ে মানবাধিকারের সপক্ষে খোলা মুখ বন্ধ করতেই চলল সিবিআই হানা। অ্যামনেষ্টির বক্তব্য হল, মোদী শাসনাধীন ভারতে গত ছয় বছর ধরে এই সংস্থা কাজ করছে, ‘জন নিরাপত্তা আইনে’র নামে চালানো গণ নির্যাতন থেকে মানবাধিকার রক্ষাই ব্রত, এই কাজের সুবাদে জায়গা করে নিয়েছে চার লক্ষাধিক ভারতীয়র মনে, সংস্থাকে আর্থিক সাহায্যকারী ভারতীয়র সংখ্যা লক্ষাধিক। এহেন সংস্থার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া স্রেফ সন্দেহের হাওয়া তুলতে নিশানা বানানো বোঝার অপেক্ষা রাখেনা যে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ।