ভারতীয় অর্থনীতির সংকট গভীরতর হয়ে ওঠা এবং প্রশাসনের সার্বিকভাবে ভেঙে পড়াটা এখন এক নিত্যদিনের প্রশ্নাতীত বাস্তবতা। প্রতিটি ফ্রন্টেই এর ভুরিভুরি নিদর্শন দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর লক্ষণগুলো বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক সংকট এখন আর বৌদ্ধিক সমাজের মধ্যে বিতর্কের কোনো বিষয় নয় সরকার যাকে পরিসংখ্যানগত কারচুপি দিয়ে অস্বীকার করতে পারবে। আরবিআই থেকে আইএমএফ, প্রতিটি আন্তর্জাতিক অথবা ভারতীয় প্রতিষ্ঠানই প্রতিদিন ভারতের অর্থনীতির বৃদ্ধির সামগ্ৰিক হার হ্রাসের দিকে ইঙ্গিত করছে। তবে, সব থেকে ধিক্কারজনক ধাক্কাটা এসেছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ক্রমান্বয়ে নেমে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে। নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে, ২০০০ সালে ১১৩টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ৮৩ নম্বরে। এর দু-দশক পর ২০১৯-এর বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ১০২ নম্বরে। আমাদের সমস্ত প্রতিবেশী দেশই — চীন (২৫), শ্রীলঙ্কা (৬৬), মায়ানমার (৬৯), নেপাল (৭৩), বাংলাদেশ (৮৮) এবং পাকিস্তান (৯৪) — ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়টা হল পাঁচ বছরের নীচের শিশুদের মধ্যে উচ্চতার তুলনায় ওজন কম হওয়ার হার ভয়াবহ রূপে অত্যন্ত বেশি হওয়া। বিশ্ব ক্ষুধার ২০১৯-এর রিপোর্টে উচ্চতার তুলনায় ওজন কম হওয়ার হার ভারতীয় শিশুদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা হল ২০.৮ শতাংশ। ভারতীয় শিশুদের মধ্যে বৃদ্ধি ব্যাহত (বয়সের তুলনায় উচ্চতা) হওয়ার হারও (৩৭.৯ শতাংশ) যথেষ্ট। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়স্ক শিশুদের মধ্যে কেবলমাত্র ৯.৬ শতাংশ শিশুকেই (যা ১০ জনের মধ্যে ১ জনও নয়) ন্যূনতম গ্ৰহণযোগ্য খাবার খাওয়ানো হয়। এটা এখন একেবারেই সুস্পষ্ট যে, ভারতে ক্ষুধা অত্যন্ত ব্যাপক এবং গভীরে শিকড় চারানো। এ সত্ত্বেও সরকার এই বিষয়ে কিছু করছে না তাই নয় , জনগণের দিক থেকে বিষয়টিকে তোলার যে কোনো প্রচেষ্টাকেই থামিয়ে দিতে সে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ঝাড়খণ্ডে আন্দোলনের যে কর্মীরা অনাহারে মৃত্যুর ঘটনাকে উন্মোচিত ও নথিবদ্ধ করছেন তাদের পুলিশি নির্যাতনের মুখে পড়তে হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে সাংবাদিকরা ভিডিও তুলেছেন যাতে দেখা যাচ্ছে স্কুলে শিশুদের মিড ডে মিল-এ রুটির সঙ্গে নুন অথবা ভাতের সঙ্গে হলুদ জল দেওয়া হচ্ছে, আর এই অপকীর্তির উন্মোচনের জন্য বিদ্বেষপরায়ণ সরকার তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা রুজু করছে।
এই ব্যাপারটাকে অনুধাবন করতে হবে যে, ছেদহীন ক্ষুধা শুধু গ্ৰামীণ ভারতের সুদূর গণ্ডগ্ৰামগুলির কয়েকটি পশ্চাদপদ পকেটেই সীমাবদ্ধ নয়। এটা জনগণের খাদ্য গ্ৰহণ কমে যাওয়ার বিস্তৃততর এবং গভীরতর ব্যাধির ভীতিজনক প্রকাশ মাত্র। অধিকাংশ শিল্প ও ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা অর্থনৈতিক মন্থরতার খবরে যদি বিক্রি পড়ে যাওয়ার কথা থাকে, তবে এর উল্টো দিকে রয়েছে উপভোগের সংকোচন। আর এটা যখন খাদ্যসহ দৈনন্দিন অপরিহার্য দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে ঘটে, তখন আমরা নিরবচ্ছিন্ন ক্ষুধা এবং দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির মধ্যে পড়ি। আর কোনো সরকার যখন ক্রয় ক্ষমতার হ্রাস এবং জনগণের উপভোগের সংকোচন সমস্যার সমাধানে প্রয়াসী না হয়ে সমস্ত সম্পদ বড়-বড় কর্পোরেট সংস্থা ও অতি-ধনীদের দিকে চালিত করে, সেই সরকার তখন শুধু যে এক অক্ষম অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকেই অনুসরণ করে না, দেশের ওপর এক বিপর্যয়কেই চাপিয়ে দেয়। সে জনগণের বিরুদ্ধে এক অর্থনৈতিক যুদ্ধই চালায়। জনগণের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসাবে দ্রুত আত্মপ্রকাশ করছে ব্যাঙ্ক ক্ষেত্র। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদী যে বিষয়গুলো নিয়ে জিগির তুলতেন তার অন্যতম হল জনধন যোজনা বা গণ ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমাদের বলা হয়েছিল, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ ব্যাঙ্ককে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, ভারতে ব্যাঙ্ক প্রধানত মধ্যবিত্তের এক্তিয়ারেই ছিল এবং ব্যাঙ্কের কোনো নাগালই দরিদ্ররা পায়নি। এই কথা বলার পরবর্তী কয়েক মাস ও বছরে ভারতে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বৃদ্ধির চমকপ্রদ আখ্যান আমাদের কাছে তুলে ধরা হয়েছিল। তবে এর অর্থ এই ছিল না যে, সংকট-জর্জরিত কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী অথবা কারিগর এবং ক্ষুদ্র উৎপাদকের জন্য সস্তায় ঋণের ব্যবস্থা হবে। এই ‘ব্যাঙ্ক বিপ্লবের’ প্রকৃত অর্থটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যখন নরেন্দ্র মোদী সহসাই বড় অঙ্কের নোট বাতিলের কথা ঘোষণা করে জনগণকে তাদের সব বড় অঙ্কের নোট জমা করতে বাধ্য করলেন। অন্যভাবে বললে, জনগণের কাছে থাকা নগদ অর্থের প্রায় পুরোটাই রাতারাতি ব্যাঙ্ক নেটওয়ার্কের মধ্যে টেনে আনা হল।
ব্যাঙ্কগুলো এইভাবে তাদের নগদ যোগানের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলেও কর্পোরেটদের শোধ না করা বিশাল পরিমাণ ঋণ থেকে উদ্ভূত প্রকৃত সংকটে তারা জর্জরিত হতেই থাকল। আমরা এখন আবার ব্যাঙ্ক সংকটের পরবর্তী পর্যায়কে প্রত্যক্ষ করছি — তথাকথিত দুর্বল ব্যাঙ্কগুলোকে আপাতভাবে শক্তিশালী ব্যাঙ্কগুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এরই সাথে আবার তাদের জমা টাকা তুলতে আমানতকারীদের নানা উপায়ে নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে। পাঞ্জাব মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের (পিএমসি) ক্ষেত্রে আরবিআই টাকা তোলার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারি করেছে — ছ-মাস সময়কালের মধ্যে মাত্র ৪০০০০ টাকা তোলা যাবে এবং একবারে ১০০০০ টাকার বেশি তোলা যাবে না। পিএমসি ১৯৮৪ সালে স্থাপিত হয়, শহরাঞ্চলে সবচেয়ে বড় পাঁচটি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের অন্যতম এবং ৭টি রাজ্যে তার ১৩৭টি শাখা রয়েছে। আমানতকারীদের কষ্টার্জিত অর্থ তোলার ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আমানতকারীদের চূড়ান্ত দুর্দশার মধ্যে ফেলেছে। কোনো ব্যাঙ্কের পতনের ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ নিয়ম হল আমানতকারীদের জমা টাকার মাত্র ১ লক্ষ টাকা বীমার দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে। ঐ নিয়ম এখন সমস্ত সাধারণ আমানতকারীদের কাছেই এক ভয়াবহ আসন্ন বিপদ হয়েই দেখা দিচ্ছে।
বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান ধ্বংস হওয়া, আয়ের হ্রাস পাওয়া, উপভোগের সংকোচন ঘটা এবং এখন আবার পতনশীল অ-নির্ভরযোগ্য ব্যাঙ্ক গুলোতে জমা করা টাকা তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়া — এই পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ছে। এই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে নভেম্বরের মাঝামাঝি শুরু হবে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। সংসদের বাদল অধিবেশনে মোদী সরকার অত্যন্ত জরুরী হয়ে ওঠা অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডা নিয়ে কোনো আলোচনাই করেনি। ২০১৯-এর নির্বাচনে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনে উজ্জীবিত হয়ে উঠে মোদী সরকার তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে কোনো ধরনের বিতর্ক বা বিচার-বিশ্লেষণকে এড়িয়ে গিয়ে সংসদে জোরজবরদস্তি একের পর এক অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ পাশ করিয়েছে। হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রর নির্বাচনী প্রচারে শাসক দল শুধু কাশ্মীর আর পাকিস্তান নিয়েই কথা বলেছে; আর তুলে ধরেছে সাভারকারকে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ভারতরত্ন দেওয়ার ন্যক্কারজনক প্রস্তাব, যে সাভারকার ব্রিটিশ শাসকদের কাছে মার্জনা ভিক্ষা করে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন এবং হিন্দুত্ব বা হিন্দু জাতীয়তাবাদের থিসিস আমদানি করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সঞ্চার ঘটান। ঝাড়খণ্ড ও দিল্লী বিধানসভার নির্বাচন সামনে, আর তাই মোদী-শাহ সরকার শীতকালীন অধিবেশনে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল(সিএবি) তাড়াহুড়ো করে পাশ করিয়ে সারা দেশের ওপর দুরভিসন্ধিমূলক এনআরসি-র অভিসন্ধিকে চাপিয়ে দিতে মরিয়া। ভারতের জনগণকে এই কৌশল ব্যর্থ করে দিতে হবে, বিভেদ সৃষ্টিকারী এনআরসি- সিএবি অ্যাজেন্ডাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং আপামর ভারতবাসী প্রতিদিনই যে অর্থনৈতিক উদ্বেগের মুখোমুখি হচ্ছেন তার জবাবদিহিতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ২২ অক্টোবর ২০১৯)