সবাই যখন মোটর গাড়ি আর পার্লেজি বিস্কুটের উৎপাদন হ্রাসের ভিতরে দেশের অর্থনীতির বন্ধ্যাত্ব খুঁজছে, সেই সময়ে, সপ্তাহ তিনেক আগে উত্তর ভারতের বস্ত্রশিল্পের (টেক্সটাইল) মালিকদের এ্যাসোসিয়েশন সূতা বয়ন শিল্পের দুরবস্থা নিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। ভারতের টেক্সটাইল শিল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১০ কোটি শ্রমিকের কাজের বন্দোবস্ত করে, যে হিসেবে তা কৃষির পরে সর্বোচ্চ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাপক। কেবল তাই নয়, দেশের রফতানির ছয় ভাগের এক ভাগ আসে ওই শিল্প থেকে। সেই শিল্প সম্পর্কেযে বিজ্ঞাপন ওই মালিক সংস্থা দিয়েছে তার থেকে জানা যাচ্ছে যে, ২০১৮ সালের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের তুলনায় এ বছরে অনুরূপ ত্রৈমাসিকে সূতা রফতানি কমেছে ৩৫%। কেবল তাই নয়, এপ্রিল মাসে, গত এপ্রিলের তুলনায় কমেছিল ২১%, মে মাসে ৩১%, আর জুন মাসে সেই হ্রাসের মাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১%। ফলে শ্রম নির্ভর শিল্পটির হার শোচনীয়, মোট সূতা বয়ন শিল্পের এক-তৃতীয়াংশ বন্ধ হয়ে গেছে। বাজার থেকে তুলো কেনা বন্ধ হতে বসেছে। মালিকরা বলছে যে, আগামী মরশুমে ৮০ হাজার কোটি টাকার তুলো বিক্রির বাজার তুলো উৎপাদকরা পাবে না কারণ, “সরকার এখনো তুলো চাষিদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদান করে থাকে বলে ভারত এখনো তুলোর বাজার চালিত মূল্যের বিশ্বজোড়া পদ্ধতি অনুসরণ করে না।”। অর্থাৎ মালিকরা তাদের স্বার্থে এবং ‘শিল্প ও শ্রমিকদের স্বার্থে’ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তুলে দেওয়ার কথা বলছে। সব মিলিয়ে টেক্সটাইল শিল্পের সমস্যা বা সঙ্কট কেবল শিল্পের সমস্যা হিসেবেই থাকছে না, তা শ্রমিক, কৃষক, তদুপরি, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নীতিটিকেও টেনে আনছে।
গত আগস্ট মাসেই চা শিল্পের মালিক সংগঠন, ইন্ডিয়ান টি এ্যাসোসিয়েসন সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চা শিল্পের দুর্গতির কথা জানিয়েছেন। বিজ্ঞপ্তি অনুসারে প্রতি কিলোগ্রাম উৎপাদিত চা থেকে গড়ে ৩৫ টাকার বেশি লোকসান হচ্ছে। সেই হিসেবে ২০১৮ সালে উৎপাদিত ১৩৪ কোটি কিলোগ্রাম চা শিল্পে মোট লোকসানের পরিমাণ ৪,৬৯০ কোটি টাকা। যদি মালিকদের কথা সত্যি হয় তাহলে চা শিল্পও ধুঁকছে। মনে রাখা দরকার ওই শিল্পে প্রায় ১২ লক্ষ শ্রমিক যুক্ত আছে।
ভারতের মোটর গাড়ি শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩ কোটির বেশি মানুষ নিযুক্ত আছে। ২০১৮-১৯ সাল থেকেই মোটর গাড়ির বিক্রি কমছে। সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ান অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স জানাচ্ছে যে, ২০১৭-১৮ সালে যেখানে ১৮.২ লক্ষ গাড়ি বিক্রি হয়েছিল সেখানে ২০১৮-১৯ সালে ৮% কম, ১৬.৮ লক্ষ গাড়ি বিক্রি হয়। দু-চাকার গাড়ির বিক্রিও ২০১৭-১৮র তুলনায় ২০১৮-১৯ এ ১৭% কমেছে। এবছর জুনে নূতন গাড়ির নিবন্ধীকরণের সংখ্যা ৩লক্ষ ২০ হাজার কমেছে গত জুন, ২০১৮র তুলনায়। কোম্পানির ডিলারদের কাছে ৩৫ হাজার কোটি টাকার গাড়ি ও ৩০ লক্ষ (১৭ হাজার কোটি টাকা) অবিক্রিত দু- চাকার গাড়ি পড়ে থেকেছে। ২০১৯-২০ অর্থ বর্ষে গাড়ি বিক্রির অবনতি বজায় থেকেছে এপ্রিল, মে, জুন, ও আগস্টে; বিক্রি কমেছে যথাক্রমে ১৬%, ৯%, ১২%, ও ১৬%। যাত্রী গাড়ির বিক্রি জুলাই ও আগস্টে কমেছে যথাক্রমে ৩১% ও ৩২%। দু চাকার গাড়ি বিক্রি কমেছে আগস্টে ২৩%। সব মিলিয়ে ভারতে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের অন্যতম সর্বোচ্চ উৎপাদক, যা ওই ক্ষেত্রে প্রায় এক-চতুর্থাংশের ভার গ্রহণ করে তার অবস্থা অত্যন্ত সমস্যাসঙ্কুল। দেশের সব থেকে বৃহৎ মোটরগাড়ি উৎপাদক মারুতি ৬% অস্থায়ী কর্মী ছাটাই করেছে। জাপানি মোটরগাড়ি উৎপাদক নিশান মোটর ভারতে ১৭০০ কর্মী ছাটাই করেছে। রয়টারের প্রতিবেদন অনুসারে প্রাথমিক স্তরেই গাড়ি উৎপাদক, গাড়ি বিক্রেতা, যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক ইত্যাদি প্রায় সাড়ে তিন লাখ কর্মী ছাটাই করছে। এই সংখ্যা ১০ লাখে পৌছানোর আশঙ্কা আছে। মারুতি সুজুকি সেপ্টেম্বরের ৭ ও ৯ তারিখ দুদিন গুরুগ্রাম ও মানেসারে কারখানা বন্ধ রেখেছিল। অশোক লেল্যান্ড সেপ্টেম্বর মাসে সাতটি কারখানা মিলিয়ে মোট ৫৯ দিন বন্ধ রাখবে।
গত এপ্রিল-জুন সময়কালে,অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ২০১৮-১৯ সালে ওই সময়কালের তুলনায় জিডিপি বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫%, যা গত ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মনে রাখা দরকার গত ২০১৮-১৯ সালের শেষ ত্রৈমাসিকেও তা যথেষ্ট কম ছিল, ৫.৮%। কেবল তাই নয়, এই নিয়ে গত ৫টি ত্রৈমাসিকে জিডিপি বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমছে। বিশ্বের সব থেকে দ্রুত বৃদ্ধির তকমা হারিয়ে ফেলেছে ভারত। এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার ভারতকে টপকে গিয়েছে। বর্তমান আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে কৃষি ক্ষেত্রে বৃদ্ধি শ্লথ হয়ে ২% এ নেমে এসেছে, গত বছরের অনুরূপ ত্রৈমাসিকের ৫.১% এর তুলনায়। শিল্প ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির হার কমে ২.৭% হয়েছে যা গত বছরে অনুরূপ সময়কালে ছিল ৯.৮%। দ্রব্য উৎপাদন বা ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের বৃদ্ধি ঘটেছে মাত্র ০.৬%, যে বৃদ্ধির হার গত বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ছিল ১২.১%। এছাড়া, নির্মাণ ক্ষেত্র ও পরিষেবা ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির হার কমেছে। জুন মাসে ভারতের আটটি মূল শিল্প ক্ষেত্র ৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হারে বেড়েছে, ০.২% গত বছরের জুনের তুলনায়; গত বছরের জুনে তা ৭.৮% বেড়েছিল। ফলে যে সমস্ত ক্ষেত্রগুলি শ্রম নিবিড়, যথা কৃষি, নির্মাণ, ম্যানুফ্যাকচারিং সর্বত্রই বৃদ্ধির হার কমায় কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি বলেই ধারণা করা যেতে পারে। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়েলসেন ভারতের দ্রুত গতিশীল ভোগ্য পণ্য দ্রব্যের (এফএমসিজি) বাজারের অনুমিত বৃদ্ধির হার ২০১৮ সালে তুলনায় ২০১৯ সালে কমিয়েছে।
সুতরাং ভারতীয় অর্থনীতি সঙ্কটে না পড়লেও সমস্যায় নিশ্চিতভাবে পড়েছে। যার অভিঘাত সাধারণ মানুষকেই সইতে হবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বা সরকারের অর্থ দফতরের আমলারা সাধারণ মানুষের তুলনায় শিল্পপতিদের চাহিদা মেটাতেই আগ্রহী হয়ে পড়েছে। অর্থমন্ত্রী দফায় দফায় শিল্পপতিদের আবদার মেটানোর জন্য ছাড়ের ঘোষণা করেছেন। যেমন, অর্থমন্ত্রী শেয়ার বাজারে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের উপর থেকে, ও স্বল্পকালিন ও দীর্ঘকালিন মূলধনী লাভের উপর থেকে বর্ধিত সারচার্জ উঠিয়ে দিলেন। এ্যাঞ্জেল কর তুলে দিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলিতে ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। কর্পোরেট সামাজিক দায়ের খাতে ঠিকঠাক টাকা খরচা না করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে ধরা হবে না বলেও ঘোষণা করলেন। করদাতাদের অযথা নাকাল করা হবে না। সম্পদ সৃষ্টিকারীদের মর্যাদা সহকারে দেখা হবে। অতি ধনীদের উপরে আরোপিত কর সারচার্জকে খতিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
ওদিকে কিন্তু, রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের জন্য সমস্ত উদ্যোগ নেওয়া চলছে। এদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের মোট ব্যয় জিডিপির অনুপাত হিসেবে ক্রমাগত কমছে। ২০১৩-১৪ সালের ১৩.৯% থেকে কমে ২০১৮-১৯ এ ১২.২% হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের ২০১৮-১৯ এর বাজেটের সময়ে অনুমান করেছিল যে, ওই অনুপাত ১৩% হবে। কিন্তু ওই অনুপাত কমেছে। কেবল তাই নয় মোট ব্যয় বাজেট অনুমানের থেকে ১ লক্ষ ৩১ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের কর রাজস্বেও জিডিপির অনুপাতে কমেছে। ২০১৩-১৪ সালে তা ছিল ৭.৩%, ২০১৮-১৯-এ কমে হয়েছে ৬.৯%। ২০১৮-১৯ এ অনুমান ছিল তা বেড়ে ৭.৯% হবে, কিন্তু তা তো বাড়েইনি এমনকি অনুমানের তুলনায় কর রাজস্ব কমেছে ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা। মনে রাখা দরকার এই পার্থক্য ভারতীয় কর রাজস্বের ইতিহাসে সর্বাধিক। এই বাজেট বরাদ্দ হ্রাস কিংবা মোট ব্যয় হ্রাসের চাপ সামাজিক ক্ষেত্রগুলির উপর পড়ছে। শিক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট বরাদ্দকে ধরা যাক। মোট বাজেটের ৩.৪%। আগের বছরে ছিল ৩.৭৪%, ২০১৩-১৪ তে মোদি সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময়ে ৪.৩%। মূলধনী ব্যয় কমেছে। ৯.২ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ৮.৭ লক্ষ কোটি টাকা। ভর্তুকি বেড়েছে, কৃষকদের সরাসরি নগদ দেওয়ার জন্য। কৃষকদের সুবিধে অবশ্যই দিতে হবে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে যথাবিহিত স্তরে নিয়ে গিয়ে তাদের উৎপাদনকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে। বদলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃত চাষি কোন সুবিধে পাচ্ছে না কারণ জমির মালিকানা চাষির নয়, তাই ওই নগদ টাকা তার বদলে জমির মালিকের ঘরে ঢুকছে।
কৃষি ক্ষেত্রের বৃদ্ধি যেখানে অত্যন্ত কম সেখানে সরকারের তরফে কৃষিকে উজ্জীবিত করার জন্য তেমন অতিরিক্ত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বরং কৃষি ক্ষেত্রে বা গ্রামীণ অর্থনীতিতে মজুরি বৃদ্ধির হার প্রায় শূন্যে ঠেকেছে। গ্রামীণ অর্থনীতির ধারাবাহিক দুরবস্থা সামগ্রিক অর্থনীতির ক্রয় ক্ষমতা বাড়তে দিচ্ছে না। ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত প্রকৃত গ্রামীণ মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক ৬%, মে, ২০১৪ থেকে ডিসেম্বর, ২০১৮ পর্যন্ত কৃষি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সেই হার কমে হয়েছে বার্ষিক ০.৮৭% ও অকৃষি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ০.২৩% বার্ষিক। নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরির অবস্থা আরো খারাপ, কমেছে বার্ষিক ০.০২% হারে।
অর্থনীতির সমস্যা কেবল বৃদ্ধির সমস্যা নয়। এই সমস্যা রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রকে বেসরকারি হাতে তুলে দিলে বা ব্যাঙ্কগুলিকে জুড়ে বড় ব্যাঙ্ক তৈরি করলে মিটতে পারে না। কৃষক যদি তার পণ্যের ন্যায্য দাম না পায়, আর সেই অবদমিত মূল্যের উপরে দাঁড়িয়ে যদি মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসের কৃতিত্ব জাহির করা হয়, তাহলে ক্রয় ক্ষমতাহীন কৃষক চাহিদা তৈরি করতে পারে না। ফলে উৎপাদন বাড়ে না, কর্মসংস্থান হয় না। পরের পর্যায়ে শিল্পপণ্যের চাহিদা বাড়ে না। শিল্প বিনিয়োগ হয় না। ঋণের চাহিদা বাড়ে না। ব্যাঙ্কগুলি নিজেদের ব্যবসায়ের স্বার্থেঝুঁকিপূর্ণ ঋণ দেয়। সেই ঋণ শোধ হয় না। সেই ফিকিরে নীরবেরা কারসাজি করে ঋণ খেলাপি হয়। চক্রটা চলতে থাকে। তাই অর্থনীতিকে সমস্যা থেকে দূর করতে গেলে ন্যায্য মূল্যের বন্দোবস্তের মাধ্যমে কৃষকের হাতে অর্থের বন্দোবস্ত করতে হবে, শ্রম আইনকে লঘু করে চাকুরি থেকে ছাটাই-এর ক্ষেত্রে মালিকদের সুবিধে না করে দিয়ে শ্রমিকদের স্থায়ী চাকুরির বন্দোবস্ত করতে হবে, বেকারদের কাজ দিতে হবে। অর্থনীতির ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তার জন্য শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের পক্ষে থাকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। এ সরকারের তা নেই। যতদিন উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অন্ধ সাম্প্রদায়িকতার সম্মোহন থেকে বেরিয়ে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি জনতা রুখে দাঁড়িয়ে নিজেদের কাজের, খাদ্যের, উচিৎ মূল্যের অধিকার আদায়ে সোচ্চার না হচ্ছে ততদিন ভারতীয় অর্থনীতির এই বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি নেই।