সম্পাদকীয়
এনআরসি : এবার কি বাংলায়!

অসমের পর এবার তাক করা হচ্ছে বাংলাকে। এরাজ্যেও এনআরসি হওয়া দরকার! তার জন্য় বিজেপিকে এখানে ক্ষমতায় আনা দরকার। হাওয়া তুলছে বিজেপি। দুবছর বাদে বিধানসভা নির্বাচন। ইস্যু করছে সেই লক্ষ্যেই। স্বাভাবিকভাবেই নাগরিক জীবনে জমবে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। এতদিন জানা ছিল ভূমিহীন, গৃহহীন, অঘোষিত নিজভূমে পরধীন-পরবাসী হয়ে থাকার নির্মমতা। এনআরসি-র পরিণামে ঘনাইছে রাষ্ট্রহীন অনাথ হয়ে পড়ার অভূতপূর্ব বিপদ। এক থেকে নিষ্কৃতি মিলতে কি করে? তাড়া করছে সেই দুঃস্বপ্ন। এনআরসি – একই মুদ্রার দুই পিঠ। একদিকে নাগরিকের জাতীয় তথ্য পঞ্জিকরণ, অন্যদিকে বে-নাগরিককরণ। প্রস্থানবিন্দু প্রথমটা নয়, দ্বিতীয়টাই। দ্বিতীয়টার উদ্দেশ্যেই প্রথমোক্তটা নামানো। অসমের জনসংখ্যার বিন্যাসে বিদেশী চিহ্নিতকরণ ও বিতাড়ন অভিযান ছিল বকেয়া, যা ধার্য হয়েছিল গত শতকের আশির দশকে অসম আন্দোলন সঞ্জাত চুক্তি মোতাবেক। চুক্তি হয়েছিল তদানীন্তন আসু-অগপ-র অসম রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের মধ্যে। কিন্তু আসু-অগপ বা কংগ্রেস, কোনো পক্ষই এই লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। ক্ষমতায় থাকলেও অনুকূল ছিল না মান্যতা পাওয়ার পরিবেশ, আইন-আদালতের জট-জটিলতাও ছিল বিস্তর। রাস্তা পরিষ্কার হতে সময় লেগেছে প্রচুর, প্রায় চার দশক। তার চেয়েও বড় ঘটনা ও প্রবণতা হল, দরকার ছিল কেন্দ্রে-রাজ্যে সবচেয়ে ধ্বংসসাত্মক দক্ষিণপন্থী শাসকদের ক্ষমতায় চলে আসা, বিশেষত কেন্দ্রে উপর্যুপরি উপস্থিতি, বিজেপি সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য থেকে হাইজাক করলো ইস্যুটা। উচ্ছেদ অভিযানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যটা যেমন নির্মমতম, তেমনি মজুদ হয়েছে নিষ্ঠুরতম শাসকরাও। এখন অনেক রাজ্যেই ক্ষমতায় ফ্যাসিস্ট বিজেপি। বিশেষত লোকসভায় ৩০৩ আসন পাওয়া, দলের অন্যতম শীর্ষ পাণ্ডা রাজনাথ সিং-এর ভাষায় বিজেপি এখন ‘থ্রি নট থ্রি’ চালানোর ক্ষমতায় বলীয়ান। তাই ‘অপরদের’ বেইজ্জতিকরণ-বিনাশকরণে প্রতিপন্ন হচ্ছে। এক কথায় দানবিক। লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ-র বক্তব্য ছিল বাংলায়ও এনআরসি নামানোর কথা। এখানেই থেমে থাকা হবে না, যেমন যেমন মওকা মিলবে তেমন তেমন চালানো শুরু হবে।

অসমের অভিজ্ঞতার বিভৎসতা কল্পানাতীত। প্রথম তালিকায় ছিল প্রায় ৪০ লক্ষ, চূড়ান্ত তালিকায় সেটা দাঁড়াল ১৯ লক্ষাধিকে। লক্ষ লক্ষ পরিবারের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে ফালা ফালা করে দেওয়ার সমার্থক এই এনআরসি। সংবিধানের ২১ ধারায় উল্লেখ আছে, নাগরিক জীবনের সবকিছুর সুরক্ষার দায় রাষ্ট্রের। অথচ রাষ্ট্রীয় আচরণ সংগঠিত হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে। আবালবৃদ্ধিবনিতাদের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে সন্দেহপূর্ণ অন্তরীণ শিবিরে। বাকিদের হয়রান হতে হবে নিজেদের দেশবাসী নাকরিকের প্রমাণ দিতে। সরকার বাহাদুর ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়াবে বলছে পাঁচ-দশ গুণ। কর্মসংস্থান কেন্দ্র বাড়ে না, কাজের সুযোগ বাড়ে না, বাড়ে শুধু ‘বিদেশী বিতাড়নের’ ঝাড়াই বাছাইয়ের কেন্দ্র। আবেদনের সময়সীমা চার মাস। তারপরে কি হবে! ভেবে শিউরে উঠতে হয়। ঢুকতে হবে বন্দিশালায়! নয়তো বেয়নেটের ডগায় পুশব্যাক! শঙ্কা জাগে তবে কি স্বাধীন ভারতে দেখতে হবে হিটলারী মডেলের “কনসেনট্রেশন ক্যাম্প!” ইজরায়েলির মডেলে “প্যালেস্তাইনী ঘেটো”! কিংবা ট্রাম্পের জাতিবিদ্বেষী অভিবাসন নীতির আদলে বিতাড়ন। অসম সরকার বলছে বন্দিশিবিরগুলিতে যথাসম্ভব ‘মানবিক’ রসদের কোনো অভাব রাখা হবে না! উচ্ছেদ সাধনের পর উপহার প্রদানের গল্প শোনানো হচ্ছে। প্রথম উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার পর ঝোলা থেকে বের করা হবে ঘর গুছানোর দ্বিতীয় প্রকল্প। সময়ে নামানোর জন্য তৈরি রাখা আছে নাগরিকত্ব প্রদানের সংশোধনী বিল। যে বিলের মূল কথা হল, হিন্দুত্ববাদী এবং মুসলিম বিরোধিতাবাদ। যার দৌলতে হিন্দুদের জন্য অবাধ ছাড়, মুসলিমদের জন্য কোনো দরজা নয়। বোঝাই যায়, এনআরসি এবং প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব সংশোধনী প্রকল্প – দুটিই একই উদ্দেশ্যে পরিপূরক প্রকল্প। বর্তমান সংবিধানগত কাঠামোর মধ্যেই এমন আইনগত সংশোধনী নিয়ে আসা শুধু সময়ের অপেক্ষায়, যা কেবল হিন্দু ধর্মীয় পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই। এই কারণে পদক্ষেপ দুটি কিছুতেই মানা যায় না, আদ্যন্ত বিরোধিতার বিষয়।

অসমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাপকমাত্রায় এনআরসি অভিযান নামানোর পেছনে তবু এক অজুহাতের প্রেক্ষাপট রয়েছে। সেটা হল গত শতকের ৭০-৮০ দশকের স্বতঃস্ফূর্ত অসম আন্দোলন। কিন্তু এ বাংলায় তেমন অজুহাত দেখানোর উপায় নেই। নীচেরতলা থেকে সেরকম কোনো স্বতঃস্ফূর্ত চাপ কখনও ওঠেনি। প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে যাইই মানুষজন এসে থাকুক তা এ বঙ্গে কখনও কোনো আর্থ-সামাজিক বৈর সম্পর্ক সৃষ্টি করেনি। যে বিষয়টির এখানে ইস্যু হওয়ার পটভূমি নেই সেটা কৃত্রিমভাবে চাপিয়ে ইস্যু করছে বিজেপি-আরএসএস। আর সেটা করছে তাদের বিদ্বেষ-বিভাজনের মেরুকরণের রাজনীতির স্বার্থে। এর স্বরূপটা বুঝে নিয়ে প্রত্যাখ্যান করতে হবে চিত্ত যেথা ভয় শূন্য হয়ে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-27