গত ৫ জুলাই ভারতের অর্থমন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সীতারামন তার বাজেট বক্তৃতায় আরেকবার ঘোষণা করেছেন যে ভারতে নতুন জাতীয় শিক্ষা নিতি (NEP) চালু করা হবে এবং এর জন্য “প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে চলেছে”। ২০১৯ এর মে মাসের শেষ নাগাদ মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী ‘খসড়া নয়া শিক্ষা নীতি’ প্রকাশ করার পরপরই এই ঘোষণা অর্থমন্ত্রী আবার করলেন। যদিও এখনও এই খসড়াটি সম্পর্কে বিভিন্ন পক্ষের মতামত চাওয়া হয়েছে। এবং সংসদে আইন হিসেবে লাগু হতে অনেক দেরী, তথাপি যে গবেষণা তহবিল সংস্থা গড়ার কথা সেই খসড়া শিক্ষা নীতিতেই প্রথম বলা হল তা গঠন করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন সীতারামন! এই ঘোষণা সংসদীয় প্রক্রিয়ার অবমাননা হিসেবে গণ্য করা হোক বা না হোক এই খসড়া শিক্ষানীতি শাসক-দলের সাংসদদের মনে যে খুব ধরেছে তা বলা যায়। কিন্তু এই নয়া শিক্ষানীতি শিক্ষার যে ভবিষ্যতের কথা বলছে তার সাথে কতটা সামঞ্জস্য রাখে ২০১৯-২০র পেশ করা এই বাজেট? নাকি অর্থমন্ত্রী শুধুই কথার খেলা দেখালেন? অর্থাৎ দ্বিতীয় মোদী সরকারের প্রথম বাজেট শিক্ষা ক্ষেত্রের জন্য বাস্তবে কী দিচ্ছে?
প্রাতিষ্ঠানিক শাসন ও শিক্ষণসংক্রান্ত লক্ষ্যউদ্দেশ্যে বৃহৎ কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য ‘খসড়া জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০১৯’ শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয় দ্বিগুণ করার কথা বলেছিল। কিন্তু সীতারামনের বাজেট শিক্ষা ক্ষেত্রের বরাদ্দে গত বছরের তুলনায় মাত্র ১১.৬% বৃদ্ধি দেখানোর প্রচেষ্টা হয়েছে, যেটাও বাস্তবে বিভ্রান্তিকর। একটু খতিয়ে দেখলেই অন্য একটি গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে। ২০১৮-১৯-এর কেন্দ্রের বাজেটের ২.০৫% ছিল স্কুল শিক্ষার জন্য নিযুক্ত, যা কমে হয়েছে এবার ২.০৩%। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ২০১৮-১৯ বাজেটের ক্রমসঞ্চিত আনুমানিক ব্যয় ছিল ১.৪৩% যা ২০১৯-২০-তে হয়েছে ১.৩৮%। অঙ্কগুলি থেকে বোঝা যায়ে যে ক্রমশই শিক্ষাক্ষেত্রের গুরুত্ব কেন্দ্রীয় বাজেটে কমে আসছে এবং তার জন্য বরাদ্দ প্রতি বছর হ্রাস পাচ্ছে।
স্কুলশিক্ষা ও সাক্ষরতার প্রতি কেন্দ্রীয় বরাদ্দে সরাসরি ২% হ্রাস, অর্থাৎ ২০১৮-১৯এ ৮৬২১ কোটি টাকা থেকে ২০১৯-২০-তে ৮৪৬৫ কোটি টাকা, এই প্রবণতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ৫.২৪% বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হারের নিরিখে দেখলে প্রায় ৭% হ্রাস পেয়েছে স্কুল শিক্ষার বরাদ্দ। নয়া শিক্ষানীতিতে ‘শিক্ষার অধিকার ২০০৯’-কে প্রসারিত করে ১২ ক্লাস অবধি সমস্ত ছাত্রছাত্রীর জন্য প্রযোজ্য করার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ হ্রাসের বিষয়টিকে যদি এই প্রতিশ্রুতির বৈপরিত্যে বিচার করা যায় তাহলে তাকে গভীর কপটতা ও উদ্দেশ্যমূলক কুকর্ম বলতেই হয়।
দেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণের দুর্দশা বিষয়ে নয়া শিক্ষানীতির খসড়াতে একটি গোটা অধ্যায় জুড়ে আলোচনা রয়েছে এবং তার প্রতিষেধক হিসেবে “৪ বছরের উচ্চমানের ইন্টিগ্রেটেড বিএড” চালু করার কথা বলা হয়েছে। সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে “উল্লেখজনক পরিমানে অনুদান এবং ধারণ ক্ষমতা” তৈরির। কিন্তু “শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও বয়স্ক শিক্ষা” খাতে ২০১৮-১৯-এর বাজেটেও যে ৮৭১ কোটি টাকা অনুদান ছিল তা এই বাজেটে কমিয়ে মাত্র ১২৫ কোটি টাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রের ব্যয় বরাদ্দে ৮৬% হ্রাস থেকে মোদী সরকারের ‘বিশ্বের সেরা শিক্ষাতন্ত্র’ তৈরির মিথ্যে প্রতিশ্রুতি প্রথমেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। সরকারী সমর্থনের এমন হতোদ্যম অবস্থায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলি যে ডিগ্রি বিক্রি করার দোকানে পরিণত হবে তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে!
ইউপিএ-২ আমলে চালু করা ‘মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়ে সন্তানদের অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার জাতীয় স্কিম’ যা প্রধানত মধ্যস্তরে মেয়েদের ড্রপ-আউট প্রবণতাকে আটকানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল, সেই স্কিমের খাতে এবার প্রায় ৬১% বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে। ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ শ্লোগানের ভণ্ডামি পরিষ্কার করে উঠে আসে যখন এক মহিলা অর্থমন্ত্রী ঠিক তার বিপরীত কাজ করেন সংসদে বসে। যে কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে মিড-ডে মিলের জন্য সহযোগিতা দেওয়া হয়ে তাতে ৩২% কাটছাঁট হয়েছে, এবং খেসারৎ হিসেবে প্রারম্ভিক শিক্ষা কোর্স থেকে অনুদানের কথা বলা হয়েছে যদিও সেই কোর্সের বাজেট বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা। মুদ্রাস্ফীতিকে হিসেবে নিলে বোঝা যাচ্ছে যে মিডডে মিলের খরচে টান পড়বে, যার ফলাফল হবে খাবারের মান, পুষ্টি, এবং পরিচ্ছন্নতার ওপর কোপ।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে দেখলে, ‘হাইয়ার এডুকেশন ফান্ডিং এজেন্সি’ (HEFA), যার পরিকল্পনা অনুযায়ি সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ‘অনুদান’-এর বদলে ‘ঋণ’ দেওয়া হবে, তার তহবিল থেকেও ৬৫০ কোটি টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। এর মানে HEFA ঋণ দেওয়ার জন্য এখন বাজার থেকেই পুঁজি সংগ্রহ করবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও বেশি বেশি বাধ্য করা হবে বাজার থেকে নেওয়া ঋণে নিজেদের জর্জরিত করতে। পড়ুয়াদের জন্য যে আর্থিক সাহায্যের ব্যাবস্থাপনা থাকে তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি কাটছাঁট করতে বাধ্য হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা উচিত যে “ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সহযোগিতা”- তে হাত দেওয়া চলবেনা। কিন্তু, ইতিমধেই এই আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ ২০১৮-১৯-এ ২৬০০ কোটি টাকা থেকে ২০১৯-২০তে ২৩০৬ কোটি টাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতিকে হিসেবে নিলে প্রায় ১৭% অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দুস্থ পড়ুয়াদের জন্য বরাদ্দ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর রিসার্চফেলোশিপ (PMRF) এর জন্য বরাদ্দ ৭৫ কোটি টাকা কমিয়ে ৫০ কোটি তে আনা হয়েছে যার ফলে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণার ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়বে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC)-কে এখনও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে পারিকাঠামো ও গবেষণার জন্য বরাদ্দ বিতরণের দায়িত্বভারে রাখা হয়েছে, কিন্তু তার কোষাগার থেকে ২.৬% কাটতি হয়েছে গত বছরের তুলনায়। প্রযুক্তি শিক্ষার সর্বভারতীয় পরিষদ (AICTE)-এর বাজেট বরাদ্দেও ৫.৬% ছাঁটাই হয়েছে। ৪৫টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ নামমাত্র বৃদ্ধি হলেও, HEFA থেকে পাওয়া ঋণ পরিশোধ এবং মুদ্রাস্ফীতি হিসেব করলে দেখা যাবে যে সামগ্রিকভাবে তাদের ব্যয় প্রকৃতপক্ষে কমেছে।
যদি ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ নির্মলা সীতারামনের বাজেটের ওপর নির্ভরশীল হয় তবে ২০১৯-এর খসড়া শিক্ষানীতি শিক্ষাব্যবস্থাকে এক মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে।