আসামে নাগরিকপঞ্জী নবায়ন ( এনার্সি) একটি বৃহৎ অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে। কোনও কোনও মহল এটিকে বিজেপির পরাজয় হিসেবে দেখাতে চাইছেন। বিশেষ করে এমন একটা প্রেক্ষাপটে, যখন সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক গোষ্ঠী, ব্যক্তি, সরকার, নাগরিক ও অ-নাগরিক, ভারতীয়, বিদেশী, ভূমিপুত্র, বহিরাগত, প্রত্যেকে এনআরসি তালিকাকে প্রত্যাখ্যান করছেন। যখন সব দল গোষ্ঠী প্রভৃতি প্রত্যাশা বা আশঙ্কা করছিল যে তালিকাচ্যুত মানুষের সংখ্যা পঞ্চাশ বা ষাট লক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে, তখন চূড়ান্ত তালিকায় দেখা গেল তালিকাছুটের সংখ্যা উনিশ লক্ষের মতো। এতে কেউ উল্লসিত, কেউ হতাশাগ্রস্থ, কেউ আতঙ্কিত, কেউ আশ্বস্ত। একথা এখন সর্বজনবিদিত যে এই তালিকায় প্রচুর পরিমাণে প্রকৃত ভারতীয় মানুষের নাম বাদ গেছে এবং অসংখ্য প্রকৃত বিদেশির সংখ্যা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। বিজেপি এবং এজিপি, যাদের উপর (অর্থাৎ কিনা আসাম সরকার) এই নবায়নের কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল, তারাও এখন সুপ্রিমকোর্টের কাছে সীমান্তবর্তী জেলা গুলিতে কুড়ি শতাংশ এবং অন্যত্রে দশ শতাংশ রিভিউয়ের দাবি তুলেছেন। এতদিন পর্যন্ত যে ঢাকঢাক-গুড়গুড় চলছিল, তার থেকে বেরিয়ে এসে খোলাখুলি প্রকাশ্যে নির্লজ্জভাবে তারা ঘোষণা করছেন যে এই তালিকায় উনিশ লক্ষ ছয় হাজার তালিকাচ্যূত চিহ্নিত বিদেশীর মধ্যে বারো লক্ষ হিন্দু, চার লক্ষের সামান্য বেশি মুসলমান এবং বাকি অসমীয়া, গোর্খা (যাদের মধ্যে আবার বেশীর ভাগই হিন্দু)। যদিও এনার্সি অ্যাপ্লিকেশানে ধর্ম বা ভাষার জন্য কোনও কলাম ছিল না (ফলে এত দ্রুত এত বিশাল সংখ্যক আবেদনপত্রের স্ক্রুটিনি করা সম্ভব নয় কোনভাবেই) তবুও সবাই বলতে শুরু করেছে যে বিজেপির কাছে এনআরসি বুমেরাং হয়ে গেছে। ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান ট্রেন্ড হচ্ছে একই দলের কয়েকজন নেতা, তারা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে একই ইস্যুতে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য রেখে দিয়ে সাধারণ নাগরিকের কাছে কাছে গোটা ব্যাপারটা গুলিয়ে দিতে চেষ্টা করে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। রাজ্যের বিজেপি প্রচুর হিন্দুর নাম বাদ যাওয়ার ধুয়ো তুলে এনআরসি-কে প্রত্যাখ্যান করছেন, কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি বলছেন যে এনআরসি প্রক্রিয়া আসামের ক্ষেত্রে সফল, তাই এবার ভারতের অন্যত্রও সেটির প্রয়োগ হবে। নাগরিকেরা বুঝতে পারছেন না যে কোন বিজেপি আসল। এনআরসি-কে ব্যর্থ দেখিয়ে ক্যাব প্রয়োগকে লেজিটিমেট করে তোলাই বিজেপির কৌশলী অবস্থান। অসমীয়ারা আতঙ্কিত, কারণ প্রচুর তথাকথিত বাংলাদেশী বাঙালির নাম তালিকাভুক্ত হয়ে যাবার ফলে কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি রক্ষার নামে তাদের দশকের পর দশক চলে আসা আন্দোলন, মিথভাঙা তত্বের মতো মুখ থুবড়ে পড়বে। অন্যদিকে হিন্দুরা ক্ষিপ্ত, তালিকা থেকে বাদ যাওয়া হিন্দুর সংখ্যা নাকি বাদ যাওয়া মুসলমানের সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি। হিন্দুর স্বার্থ রক্ষার্থে অবিলম্বে এনার্সি বাতিলের প্রচেষ্টা চালানো, আর পাশাপাশি ক্যাব পাশ করানোর প্রয়াস জারী রাখতে হবে, এ বিষয়ে এটাই বিজেপির আপাত স্ট্র্যাটেজি। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখনও অমীমাংসীত। এই ট্রাইবুনাল, আদালত এবং সরকার চিহ্নিত অনাগরিকদের রাখা হবে কোথায়। প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত এ নিয়ে কারও কোনও মাথা ব্যথা নেই। যে ছয়টি ডিটেনশন ক্যাম্প আছে সেখানে অত্যন্ত অমানবিক পরিবেশে, গাদাগাদি করে, সন্দেহভাজন নয়-শো আটত্রিশ জন অনাগরিককে বন্দী রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে আটশো তেইশ জনই বিদেশি হিসাবে চিহ্নিত বন্দী। অর্থাৎ ক্যাম্প প্রতি গড়ে একশো ছাপ্পান্ন জন বন্দী। এবার ট্রাইব্যুনালে এবং উচ্চতর কোর্টগুলিতে বিচারের পরও যদি প্রায় দশ লক্ষের কিছু মানুষ এর আবেদন রিজেক্টেড হয়, তাদের কোথায় রাখা হবে? শোনা যাচ্ছে সরকার আরও এক হাজার ক্যাম্প খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গড়ে ক্যাম্প প্রতি একশো ছাপ্পান্ন বন্দী থাকলে মোট স্থান সংকুলান হয় দেড় লক্ষের কিছু বেশি মানুষের। প্রমাণপত্রের অভাবে ও নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হওয়া প্রায় দশ লক্ষ থেকে মাত্র দেড় লক্ষ বাদ গেলে বাকি সাড়ে আট লক্ষ মানুষ যাবে কোথায়? তার কোনও উত্তর নেই কারও কাছে। সংশ্লিষ্ট যে সব দেশের নাগরিক বলে তাদের সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের কাছেই ফেরত পাঠানোর দাবি উঠছে। যেন তারা দাবি করলেই সে দেশ এদের সাদরে ফিরিয়ে নেবে। তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পেও স্থান সংকুলান হবে না। জমি অধিগ্রহণ করে নতুন এলাকা পত্তন করে তাদের বন্দি করে বসিয়ে রাখা মানে দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ পড়া এবং একটি নতুন অ-নাগরিক শ্রেণীর সৃষ্টি হওয়া। সারা ভারতবর্ষে যদি এনআরসি প্রক্রিয়া চালু হয় তবে ভারতবর্ষ জুড়ে নতুন অনাগরিক শ্রেণীর সৃষ্টি হবে। তাদের সস্তা শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হবে, ধনবান এন্টারপ্রেনিওরদের জন্য। কিন্তু এনআরসি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এবং বছরের পর বছর চলেছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা এবং তার প্রত্যক্ষ নজরদারিতে। ফলে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল না করলে এনআরসি তালিকা বাতিল হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের দেশে একটি মিথ চালু আছে যে আদালতের রায়ের অথবা আদালতের কার্যক্রমের, বিধানের সমালোচনা বা বিরোধিতা করা যায় না। করলে তা আদালত অবমাননা দায়ে পড়ে। প্রশ্ন হল আদালতের রায় বা প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে যদি আপত্তি জানানো না যায়, তাহলে কোনো আদালতের রায় ভুল মনে হলে উচ্চতর আদালতে বা বেঞ্চে মানুষ অ্যাপিল করে কী করে? অ্যাপিল মানেই তো অধস্তন কোর্টের রায় পছন্দ না হলে উর্ধতন আদালতের বিচারপতির কাছে পুনর্বিচারের আবেদন জানানো। আজ যদি সুপ্রিম কোর্টকোন জনবিরোধী রায় দেয়, বা কোন রায়কে জনবিরোধিতা মনে হয়, তবে তার বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না, ভারতীয় গণতন্ত্র এত নিষ্ঠুর নয়। এনআরসির ক্ষেত্রে দেখা গেছে যেসব পক্ষই তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডাটুকু সফল হলেই গোটা বিষয়টাকে কোর্ট চত্বরে ঢুকিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত বোধ করেন। কারণ সাধারণ মানুষ যাদের আইনের জ্ঞান নেই, যাদের আইনের ব্যাখ্যা জানা নেই, যাদের এমনকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা করারও কোনো অভিজ্ঞতা নেই, ফলে তাদের নির্ভর করতে হয় তার গোষ্ঠীর ওপর, তাকে নির্ভর করতে হয় উকিলের উপর, তাকে নির্ভর করতে হয় রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছার ওপর। অতএব আদালত চত্বরে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই গোটা বিষয়টা দুর্বোধ্য হয়ে যায়, গোলমেলে হয়ে যায়। এনআরসি আসামের যে সরকারি ওয়েবসাইট, তাতে ইংরেজিতে পাতার পর পাতা শুধু সুপ্রিম কোর্টের রুল এবং জাজমেন্ট লেখা রয়েছে, তা একটা সাধারণ মানুষের পক্ষে পড়ে ওঠাই সম্ভব না, বোধগম্যতার প্রশ্ন তো অনেক দূর।
এনআরসি নিয়ে কোনো আন্দোলন দানা বাঁধেনি, কোনো দল আন্দোলনে নামেনি। শুধুমাত্র চেষ্টা করে গেছে এবং যাচ্ছে, গোটা বিষয়টাকে আদালত চত্বরে ঢুকিয়ে দিতে, যাতে বিষয়টি সাধারণ মানুষের হাতের বাইরে চলে যায়। এমনকি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল, যেখানে এখন চিহ্নিত অনাগরিকেরা যেতে বাধ্য, কেননা সেখানেই তাকে অ্যাপিল করতে হবে, তাকে উকিল ধরতে হবে এবং যদি সে সেটা না করে তাহলে জেলা উপায়ুক্ত প্রত্যেক তালিকাচ্যূত মানুষের ফাইল ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেবে চূড়ান্ত বিচারের জন্য। যদি যে মানুষটির সঙ্গতি না থাকে কেস করার, তবে আদালত বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে দেবে, নিজেই উকিল ঠিক করে দেবে এবং আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে কোন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ উকিল, যাদের ফিজ অনেক বেশি, তাঁরা এই কোর্টের নিয়োগ তালিকায় থাকেন না। আনকোরা, অনভিজ্ঞ উকিল নিয়ে লড়ে এই তালিকাচ্যূত উনিশ লক্ষকে প্রমাণ করতে হবে তারা এদেশের নাগরিক। যে বিচারকেরা বিচার করবেন তাঁরা কারা? তাঁদের অধিকাংশ সদ্যই ট্রাইবুনালের বিচারক হিসাবে নিয়োজিত, সামান্য অভিজ্ঞতা সম্পন্ন উকিল মাত্র। অভিযোগ, এদের একটা অংশের যোগ্যতামান হচ্ছে শাসকদলের সমর্থক হওয়া। দুদিন ট্রেনিং দিয়ে এদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হবে উনিশ লক্ষ মানুষের ভাগ্য। অতএব এ বিষয়ে যাবতীয় আলোচনা শুধুমাত্র কোর্ট, বিচারপতি, অ্যাডভোকেট আর আইনী ব্যাখ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সে অবশ্য গণতন্ত্রে সব প্রক্রিয়াই আইনি প্রক্রিয়া। আইন না মেনে গণতন্ত্রে কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। আইন ভাঙা সম্ভব নয়, এবং আইন না জানা কোন অজুহাত হতে পারে না। অথচ জানে না বলেই আইনের ব্যাখ্যা করতে পারবে না বলেই, তাকে উকিল নিয়োগ করতে হয়। বলা হয় আইন অন্ধ। আইন অন্ধ, বিচার অন্ধ, অথচ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে অনন্ত চক্ষুষ্মান হতে হবে।
এনআরসি বিষয়ক যে কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ কে যতক্ষণ না আদালত চত্বর থেকে টেনে বার করা যাবে, ততক্ষণ কোন আন্দোলন গড়ে উঠবে না। ততক্ষণ নিরীহ মানুষ নিষ্পেষিত হতেই থাকবে। জগৎ জুড়ে দুটি মাত্র বিভাজন, যাদের আছে (বা হবে) আর যাদের নেই (হবেও না)। হ্যাভস আর হ্যাভ নটস। বিশ্বজনীনতা, মানবাধিকার, উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব সব আসলে প্রসাধনী! রাজনৈতিক ধান্ধাবাজির উপাদান! বেচারা হিন্দু বা আক্রান্ত অসমীয়া, নির্যাতিত বাঙালী বা আতংকিত মুসলমান, সব আসলে ক্ষমতা দখলের অস্ত্র! আইনের ইন্টারপ্রিটেশন কখনোই একটা মানুষের জীবনের থেকে বড় হতে পারেনা। লক্ষ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব, তার বাকি জীবনের গতিপথ, সব নির্ধারণ করে দেবে একজন বা দুজন বিচারক, এটি কখনোই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচায়ক হতে পারে না। এনআরসি বিষয়ে আর একটি কথাই বলা বাকি। আইনের কাজ আইন করে দিয়েছে, সরকারের কাজ সরকার করেছে, দেখা গেছে গোটা প্রক্রিয়ায় আপাতভাবে কেউ খুশী হয়নি। ফলে এখন গোটা ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের উপর ছেড়ে দেওয়া হোক। আইনের ইন্টারপ্রিটেশন, ইতিহাসের ইন্টারপ্রিটেশন, সবসময়ই শাসকের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রাধান্য পায়। শাসকের ইচ্ছা ব্যতিরেকেও শোষিতের জীবনের একটি গতিপথ আছে। সে পথে হাঁটতে হলে পরবর্তী পদক্ষেপগুলিতে নিজেদের দায়িত্ব নিজেদেরই নির্ধারণ করতে হবে।