দ্যা ওয়্যার-এ এক বিস্তারিত সাক্ষাৎকারে করণ থাপারকে এমনটাই জানিয়েছেন অধ্যাপক ফৈজান মুস্তাফা। তিনি বলেছেন, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হয়নি, নিষ্ক্রিয় হয়েছে। তিনি খোলাখুলি জানালেন কীভাবে সাংবিধানিক চাতুর্যে এটা করা হয়েছে এবং কীভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরকে দু’টুকরো করা ও তার মর্যাদার অবনমন ঘটানোর জন্য রাজ্য বিধানসভার ‘সম্মতি’ আদায় করা হয়েছে। করণ থাপারের সঙ্গে আলাপচারিতায়, কয়েকটি বিশেষ প্রশ্ন উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় সরকার এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মধ্যে নতুন সম্পর্ককে তিনি তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, আপাত স্ববিরোধিতার এক প্রহেলিকায়, জম্মু ও কাশ্মীরের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্য বাড়বে না, বরং কমবে। অন্য কয়েকটি প্রশ্নের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জম্মু ও কাশ্মীরের পূর্ববর্তী যে আইনগুলোকে প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে সেগুলো অধিকতর ভালো ছিল (শিক্ষা, নারীর অধিকার, তথ্য জানার অধিকার, সংরক্ষণ ইত্যাদি প্রশ্নে কাশ্মীরের আইন যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল)।
সাক্ষাৎকারটিতে ভারতীয় সংবিধানের দুর্বোধ্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মতাকে তুলে ধরে কীভাবে সাংবিধানিক চাতুরির আশ্রয় নিয়ে ৩৭০ অনুচ্ছেদকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে এবং জম্মু ও কাশ্মীরকে দু’টুকরো করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পরিণত করার মাধ্যমে মর্যাদাহানি ঘটানো হয়েছে তা উন্মোচিত হয়েছে।
পাঁচ আগস্টের সিদ্ধান্তের পর এই প্রথম একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ জম্মু ও কাশ্মীরে কী ঘটেছে, আর ভারত রাষ্ট্রের জন্য, আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে, ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য তা কী তাৎপর্য বহন করে, তা বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে কতটা সাড়া দেবে সে বিষয়ে তিনি যে খুব আশাবাদী নন — তাও তিনি জানালেন।
‘৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ হয়নি’ - অধ্যাপক ফৈজান মুস্তাফা এখান থেকে শুরু করেছেন। এটি এখনও সংবিধানে আছে। এটিকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। ৩৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনে ৩৭০ অনুচ্ছেদকেই ব্যবহার করা হয়েছে। এটা একটা দ্বি-স্তরীয় প্রক্রিয়া। প্রথমত ৩৬৭ অনুচ্ছেদকে সংশোধন করতে ৩৭০ অনুচ্ছেদকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং সংশোধিত ৩৬৭ অনুচ্ছেদকে আবার ফিরে পড়া হয়েছে (রিড ব্যাক) ৩৭০ অনুচ্ছেদ হিসেবে, এবং শেষে তা ব্যবহার করা হয়েছে ৩৭০ ধারাকে সংশোধনের জন্য।
ফৈজান বিভিন্ন সাংবিধানিক চাতুরির কথা আলোচনা করেছেন যেগুলির দ্বারা কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করছে যে জম্মু ও কাশ্মীরকে দু’টুকরো করা এবং তাদের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে মর্যাদার অবনমন ঘটানোর আগে তারা কাশ্মীরের রাজ্য বিধানসভার সঙ্গে আলোচনা করেছে। দ্বিতীয় নজিরটিতে, তিনি বলেছেন, যখন রাষ্ট্রপতির শাসন রাজ্য বিধানসভার হাত থেকে ক্ষমতা সংসদের হাতে তুলে দেয় তখন রাজ্যের অবস্থান তথা মর্যাদা পরিবর্তনের জন্য রাজ্য বিধানসভার মতামত প্রকাশ জরুরি। রাষ্ট্রপতির শাসনের অধীনে ঐগুলি (রাজ্য বিধানসভার মতামতের প্রকাশ) সংসদে স্থানান্তরিত হয়নি।
সুতরাং জম্মু ও কাশ্মীরের অবস্থান পরিবর্তন তথা মর্যাদার অবনমন ঘটানো হয়েছে রাজ্য বিধানসভার নিশ্চিত মতামত না জেনেই। কারণ সংসদ ঐ মতামত প্রকাশ করতে পারে না। সুতরাং এটা ভুলভাবেই ঘটেছে।
তিনি আরও বলেন, তাঁর ঘোর সন্দেহ আছে সুপ্রিম কোর্ট এই আইনী কারসাজি তথা দুর্বলতাগুলো স্বীকার করবে কিনা কারণ:
(ক) কোনো সংখ্যাগুরু সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষেত্রে শীর্ষ আদালতের অনীহা থাকে।
(খ) এটি (শীর্ষ আদালত) এ ব্যাপারে কোনোভাবেই কোনো গরজ দেখায়নি এবং খুব বেশি হলে এই বিষয়টিকে কোনো সাংবিধানিক বেঞ্চে ঠেলবে। আর সেখানে ফয়সালা হতে তিন থেকে চার বছর গড়িয়ে যেতে পারে যখন সব কিছু মিটে যাবে, বিতর্কও শেষ হয়ে যাবে।
৩৭০ অনুচ্ছেদকে ‘সাময়িক, উত্তরণমূলক (ট্রানজিশনাল) এবং বিশেষ সংস্থান’ — এই শিরোনামের অধীনে এনে ভারতীয় সংবিধান কী বোঝাতে চেয়েছে — সেটাও অধ্যাপক মুস্তাফা তুলে ধরেছেন। এই অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীয় সরকারকে কাশ্মীর রাজ্য বিধানসভার ঐকমত্য সাপেক্ষে সেখানে ভারতীয় সংবিধানের অন্য অনুচ্ছেদগুলি সম্প্রসারণের যে ক্ষমতা দিয়েছে তা ততক্ষণই বলবৎ ছিল যতক্ষণ রাজ্য বিধানসভার অস্তিত্ব ছিল। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের রাজ্য বিধানসভার ঐকমত্যের প্রয়োজন ছিল।
যেহেতু ভারতীয় সংবিধান ১৯৫০-এর জানুয়ারিতে বলবৎ হয়েছে এবং কাশ্মীর বিধানসভা তার এক বছর পর গঠিত হয়েছে, তাই এই সাময়িক সংস্থানের প্রয়োজন ছিল যার দ্বারা রাজ্য সরকারের সম্মতি যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এটা ততক্ষণের জন্যই কার্যকর ছিল, যতক্ষণ রাজ্য বিধানসভা চালু ছিল। কেবল এই অর্থেই অনুচ্ছেদটি সাময়িক।
সংবিধানের সংরক্ষণ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলি (শুধু ১০ বছরের জন্য) অথবা ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের জন্য অনুচ্ছেদটি (কেবল মাত্র ১৫ বছরের জন্য) যে অর্থে সাময়িক এটা সেই অর্থে সাময়িক নয়। ৩৭০ অনুচ্ছেদের জন্য সংবিধানে কোনো সময়সীমা নির্দিষ্ট নেই।
তিনি বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন ভুলগুলি বা অন্তত কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের দাবির বিভ্রান্তিকর চরিত্রের উপর — যে নির্দিষ্ট কিছু আইন যেগুলি আগে কাশ্মীরে প্রযোজ্য ছিল না, তার সবগুলিই এখন প্রযোজ্য হবে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে অধ্যাপক মুস্তাফা দেখিয়েছেন, কাশ্মীরে ইতিপূর্বেই এগুলির আরও ভাল সংস্করণ চালু ছিল। সুতরাং এই নির্দিষ্ট কয়েকটি নজির সাপেক্ষে, এতে (কাশ্মীরের নিজস্ব আইনগুলির পরিবর্তে ভারতীয় আইনগুলি চালু করায়) কাশ্মীরের লাভের বদলে ক্ষতিই হবে, অর্জনের বদলে হরণই হবে।
এই আলোচনার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং চমক লাগানো অংশটি হল — জম্মু এবং কাশ্মীরের উপর কেন্দ্রের যে আধিপত্য ছিল তা অন্য রাজ্যেগুলির উপর নেই। দিল্লি এখন এটা হারিয়েছে।
সুতারাং এই বিশেষ নজিরগুলি সাপেক্ষে, ৩৭০ অনুচ্ছেদের যে নিষ্ক্রিয়তা ঘটানো হয়েছে, তার ফলে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ততটা রদ হয়নি, যতটা রহিত হয়েছে দিল্লির বিশেষ মর্যাদা।
অধ্যাপক মুস্তাফার মতে, সমান গুরুত্বপূর্ণ হল — যদিও ৩৭০ অনুচ্ছেদ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, ৩৭১ অনুচ্ছেদ চালু আছে এবং এটা নাগাল্যাণ্ডের বিধানসভাকে যে ক্ষমতা প্রদান করেছে তা কাশ্মীরের যে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার প্রায় সমতুল্য। যেমন, ভারতীয় সংসদের অনেক আইন শুধু নাগাল্যাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, রাজ্য বিধানসভার সম্মতি সাপেক্ষে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রযুক্ত হওয়ার পর কাশ্মীরে এটাই ঘটেছিল। এটি এখন আর চালু নেই কিন্তু নাগাল্যান্ডের ক্ষেত্রে এখনও এটি চালু আছে।
পরিশেষে অধ্যাপক মুস্তাফা জোর দিয়ে বলেন, যেহেতু ৩৭০অনুচ্ছেদ খারিজ হয়নি, এখনও সংবিধানের অংশ হিসেবে রয়েছে এবং নিষ্ক্রিয় আছে — ভবিষ্যতের কোনো সরকারের পক্ষে, যদি তার প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে এবং মোদী সরকার যা করেছে তার উল্টোটা করার প্রয়োজনীয় ইচ্ছা থাকে, ৩৭০ অনুচ্ছেদটি নতুন করে কার্যকর করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, তিনি এটিকে একটি তাত্ত্বিক সম্ভাবনা বলেই মনে করেন। কারণ তার ধারণা, কোনো ভবিষ্যৎ সরকার এটা করতে আগ্রহী হবে না।
(ভাষান্তর : জয়ন্তী দাশগুপ্ত)