মোদী সরকার আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত যে সব তথ্য আটকে রাখা হয়েছিল তা এখন সরকারীভাবে স্বীকৃত। আমরা এখন জানি আর্থিক বৃদ্ধির হার প্রকৃতই কতটা নেমে গিয়েছে, বেকারত্বের পরিসংখ্যান কীভাবে বিগত পাঁচ দশকের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আমরা এখন জানি বালাকোট অপারেশনের সময় বাডগামে ভারতীয় সৈন্যবিমান ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রেরই আক্রমণে ধ্বংস হয়েছে, যাতে প্রাণ হারিয়েছেন ভারতীয় বায়ুসেনার ছয় জন অফিসার ও একজন নিরস্ত্র নাগরিক। আমরা এও জানি ক্ষমতায় ফিরে আসার সাথে সাথে নতুন ঘোষণা শুরু হয়ে গিয়েছে। নীতি আয়োগ বলছে প্রায় পঞ্চাশটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বন্ধ করে দেওয়া হবে বা বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হবে। শ্রমআইনকে বাতিল করে শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার খর্ব করা হবে। নতুন শিক্ষা নীতির খসড়া বলছে অ-হিন্দী প্রতিটি রাজ্যে হিন্দী ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হবে।
এই অবস্থায় আমরা বামপন্থী কর্মীরা অবশ্যই কালবিলম্ব না করে আবার নতুন করে পথে নামব। আমাদের গণতন্ত্র, আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার আমরা মোদী সরকার বা অন্য যে কোনো সরকারের হাতে অবশ্যই তুলে দিতে পারি না, দেব না।
পশ্চিমবঙ্গে আজ আমাদের কাছে আরও একটা প্রশ্ন বিরাটভাবে সামনে চলে এসেছে। এ রাজ্যের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক চেহারা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। গোটা দেশজুড়ে যে বিজেপি জনগণের ঐক্য তথা শান্তিতে ও সসম্মানে বেঁচে থাকার অধিকারের উপর সবচেয়ে বড় আক্রমণ নামিয়ে এনেছে আজ পশ্চিমবঙ্গে তারাই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। চৈতন্য ও লালন ফকিরের বাংলা, রামমোহন-বিদ্যাসাগরের বাংলা, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলা, সূর্য সেন-বাঘা যতীন-সুভাষচন্দ্রের বাংলা আজ এক বিরাট সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আক্রমণের মুখে।
কলকাতার রাজপথ কাঁপিয়ে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙ্গে অমিত শাহ যখন রোডশো করে যান তখন সেই সংকটের ছবিটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও তাণ্ডবের নতুন চেহারা প্রতিদিন আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। আসাম ও ত্রিপুরাতে এ ছবি মানুষ বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছেন। এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জীর নাম করে যেভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের নাগরিকতা আসামে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বাংলার মাটিতেও এবারের নির্বাচনে তারই বীজ বপন করে গেলেন নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ। অথচ এই বিজেপিই এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসাবে উঠে এসেছে। এটা আমাদের কাছে গভীর উদ্বেগের বিষয়।
আমাদের কাছে আরও লজ্জার বিষয় হল বিজেপির ভোট যখন এ রাজ্যে প্রায় ২৪ শতাংশ বেড়ে গেল তখনই বামপন্থীদের ভোটের মাত্রা প্রায় ২৩ শতাংশ কমে গেল আর এই কমে যাওয়া ভোটের সিংহভাগ জমা পড়ল বিজেপির ঘরে। তেভাগা ও খাদ্য আন্দোলনের সময় থেকে অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগ ও কোটি কোটি মানুষের নিরলস প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিল তিল করে গড়ে ওঠা বামপন্থী গণভিত্তিতে আজ থাবা বসিয়েছে সবচেয়ে বড় দক্ষিণপন্থী ও গণতন্ত্র-বিরোধী শক্তি। সিদ্ধার্থ জমানার পুলিশ যে বামপন্থীদের দাবিয়ে রাখতে পারেনি, তৃণমূল জমানার দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে বামপন্থীরা বারবার রাস্তায় নেমে গর্জে উঠেছে, আজ বিজেপির মিথ্যা কথার ফুলঝুরি ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিষবাষ্পে সেই বামপন্থীদের এক বড় অংশ দিশাহারা। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বামপন্থী রাজনীতিতে এত বড় সংকট আগে আসেনি।
বামপন্থী বন্ধুদের কেউ কেউ বলছেন তৃণমূলের অপশাসনের মোকাবিলা করার আর কী-ই বা পথ আছে? বিজেপির বিরুদ্ধে পরে লড়ে নেওয়া যাবে, আগে বিজেপির হাত ধরে তৃণমূলের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাক। এ হল কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। কিন্তু একটু ঠাণ্ডা মাথায় খোলা চোখে তাকালেই আমরা দেখব আসলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কাজ তো বিজেপি করছে। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের পাণ্ডাদের বাছাই করে জড়ো করে তাদেরই মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের অভিযানে নেমেছে বিজেপি। এই ঢালাও দলবদল, অফিস দখল, ছাত্র ও শ্রমিক ইউনিয়ন দখলের অভিযানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা কোথা থেকে নজরে আসছে?
বাংলার বামপন্থী চেতনা ও বিবেক অবশ্যই এই সংকটের ভারে মুখ থুবড়ে পড়বে না, দক্ষিণপন্থার কাছে নিজেকে বন্ধক রাখবে না। যে বন্ধুরা বলছেন এভাবেই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয় তাদের বলব নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। এভাবে কাঁটা তোলার নামে আপনারা নিজেরা কীভাবে কন্টকিত হয়ে পড়েছেন। এটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার গল্প নয়, খাল কেটে কুমীর আনার জীবন্ত উদাহরণ। যে রাজ্য গোটা দেশের বাম ও গণতান্ত্রিক শিবিরের শক্তিবৃদ্ধি করত আজ সেই পশ্চিমবাংলা ভারতের বামপন্থী শিবিরের অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে বড় আত্মঘাতী উদাহরণ তুলে ধরল।
আমরা বামপন্থীরা ঋণগ্রস্ত কৃষককে বলি আত্মহত্যা করবেন না, আসুন আমরা লড়াই করি। বন্ধ কারখানার কাজ হারানো শ্রমিক ভাই-বোনদের, কর্মহীন যুবক ও নিরাপত্তাহীন মহিলাদের আমরা বলি ভেঙে পড়বেন না, আমরা আপনাদের পাশে আছি। আজ সেই একই কথা আমাদের নিজেদের স্মরণ করার ও উপলব্ধি করার সময় এসেছে। আদর্শকে পরিত্যাগ করা, আত্মসমর্পণ ও আত্মহত্যা করা বামপন্থীদের কাজ নয়। রুখে দাঁড়ানোটাই বামপন্থা। শেষপর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জেদের নামই বামপন্থা। আর ইতিহাস বলে যারা শেষপর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যায় তারাই বিজয়ী হয়।
যে বামপন্থী বন্ধুরা এবারের নির্বাচনে এই ভুলের শিকার হয়েছেন তাঁদের কাছে আবেদন ভুলকে উপলব্ধি করুন, শুধরে নিন। বামপন্থার রাস্তায় ফিরে আসুন। আর যে বামপন্থী বন্ধুরা এই সংকটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের বলব লাল পতাকাটাকে আরও শক্ত হাতে ধরে রাখুন কমরেড।
আমরা সিপিআই(এমএল) ধারার বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে অনেক লড়াই করে, লড়াইয়ের পথে অনেক ভুল করে, অনেক ধাক্কা খেয়ে টিকে থেকেছি। এই নির্বাচনের মাঝে আমাদের পার্টি পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করল। একই সাথে বছরটা আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রথম সাধারণ সম্পাদক কমরেড চারু মজুমদারের জন্ম শতবর্ষ। তাঁর শেষ লেখায় সিদ্ধার্থ জমানার সন্ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়ে কমরেড চারু মজুমদার সিপিআই(এমএল) কর্মীবাহিনীকে বৃহত্তর বামপন্থী গণতান্ত্রিক ঐক্য গঠনে মনোনিবেশ করতে বলেছিলেন। জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ এই গভীর উপলব্ধি থেকে জনগণকে আঁকড়ে ধরে ধাক্কা সামলে ওঠার পরামর্শ দিয়েছিলেন, আর শিখিয়েছিলেন অন্ধকারের মধ্যেও আলো খুঁজে নেওয়ার মন্ত্র।
আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের কাছে আবার এমনই এক সন্ধিক্ষণ। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মিথ্যে চালাকি এবং আত্মসমর্পণ ও আত্মহত্যার রাস্তা থেকে বেরিয়ে এসে আবার বামপন্থী বিকল্পকে তুলে ধরতে হবে। সে জন্য চাই অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার সাহস আর বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলা করার দৃঢ় সংকল্প। বাংলার সমস্ত বামপন্থী কর্মী ও গণতন্ত্রপ্রেমী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণের কাছে আমাদের আন্তরিক আবেদন বাংলার মাটিতে বিজেপির বিষবৃক্ষকে বাড়তে দেবেন না। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার আকাশ বাতাস যে মানবিক মননে ও প্রগতিশীল যুক্তিবাদী ধারায় সমৃদ্ধ হয়েছে তাকে বিপন্ন হতে দেবেন না। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই বাণী যে বাংলার বুকে আজ থেকে কয়েকশো বছর আগেই উত্সারিত হয়েছিল সেই মানব-জমিতে সোনা ফলান, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, বিদ্বেষ, হানাহানিকে প্রশ্রয় দেবেন না।
বিজেপির হাতে আজ গোটা দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন। বিপন্ন সংবিধান ও আইনের শাসন। স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে যারা সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও ব্রিটিশ শাসকের সঙ্গে আপোষের রাস্তাতেই ব্যস্ত থাকল, আজও যারা নারীসমাজ ও দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও সমস্ত নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে অধিকারহীন অবস্থায় ঠেলে দিতে চায় তারা পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে আরও বড় বিপর্যয় ছাড়া অন্য কী উপহার দিতে পারে?
কর্পোরেট দালাল ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও বিদ্বেষের পাণ্ডারা বাংলার বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের গণতন্ত্র ও উন্নয়নের আকাঙ্খাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা করায়ত্ত করতে চাইছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের পীঠস্থান, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, যুক্তি-তর্ক ও মুক্ত চিন্তার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র বাংলার মাটিতে আজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আরএসএস-বিজেপি-বজরং দলের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী। তৃণমূলের অপশাসন এবং মমতা ব্যানার্জীর স্বৈরাচারী মডেল অবশ্যই বিজেপিকে ক্রমাগত সুযোগ করে দিয়েছে। বামপন্থীদের দায়িত্ব এই ক্রমবর্ধমান বিপদের বিরুদ্ধে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলা। বাংলার মাটিতে আবার বামপন্থী বিকল্পকে জনগণের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করা। আসুন আমরা এই লক্ষ্যে নিজেদের নিয়োজিত করি। গোটা দেশের মানুষ দেখুক বাংলার মাটি আজও দুর্জয় ঘাঁটি।
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
সাধারণ সম্পাদক
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন