কিষাণ মহাসভার সদস্য সংগ্রহ অভিযান

ভাগ-চুক্তি চাষিদের ন্যায্য অধিকার ও ফসলের লাভজনক দাম গ্যারান্টি করা অন্যতম দাবি হিসাবে উঠে আসছে

এখন হুগলীর গ্রামাঞ্চলে চলছে আলু তোলার ধুম। কৃষক-খেতমজুরদের দম ফেলার অবকাশ নেই। তারই মধ্যে সময় করে নিয়ে কর্মীরা পরপর চারদিন (মাঝে একদিন বাদ) হালদার দীঘির বাড়ি বাড়ি ঘুরলেন। এআইকেএম-এর সদস্য ও অর্থ সংগ্রহ হল।টাকার অঙ্কে মোট ৮৩২ টাকা। মূল সংগঠককে বললাম, “এ পাড়াটা তো মোটামুটি হল। চল, কাল অন্য পাড়ায় যাই।” সে বলল, “মোটামুটি নয়। কাল এই জায়গাটা কমপ্লিট করে তারপর অন্যত্র যাওয়া হবে।” নিবিড় গণসংযোগের প্রতি কর্মীটির এই আগ্রহ থেকে আমরা সবাই আরও চাঙ্গা হতে পারি নিশ্চয়ই। চারদিন বাড়ি বাড়ি যাওয়ার পর অবশেষে আজ মূল হালদারদঘি গ্রামে সদস্য ও অর্থ সংগ্রহ সম্পূর্ণ হল। মোট ৮১ টি পরিবারের কাছে পৌঁছানো গেল। অর্থ সংগৃহীত হল ১২৫২ টাকা। টাকা-পয়সা গুণে বাড়ি ফেরার উদ্যোগ করছি, এমন সময় এক কমরেড বললেন, “আমার টাকাটা তো দেওয়া হল না।” বলেই দৌড়ে গিয়ে বাড়ি থেকে ১০০ টাকা এনে দিলেন। চিত্রগুপ্তের খাতা গুটিয়ে সাইকেলে ঠিক যখন চড়তে যাব তখন কমরেডটি আবার দৌড়ে এলেন, বিশটা টাকা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা একজনের বাকি ছিল। নিয়ে এলাম।” আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কমরেডটির নাম মেঘনাথ সর্দার।

সদস্য সংগ্রহ তথা গণ সংযোগে কর্মীদের যে উৎসাহ – সেই উপলব্ধির কথা জানালেন হুগলীর কিষাণ মহাসভার অন্যতম এক রাজ্য নেতা। বাঁকুড়ার সংগঠক জানালেন, ওন্দা ব্লকের উর্বর কৃষি অঞ্চলের লাগোয়া মোট চারটি গ্রামে প্রায় দুই শতাধিক বাড়িতে সদস্য সংগ্রহ করার পর তারা কয়েকজন চাষিকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় কিষাণ মান্ডিতে। সেখানে চলছে শাসক তৃণমূলের মদতপুষ্ট দালালদের রমরমা কারবার। চাষিদের থেকে কুইন্টাল পিছু গড়ে ১১০০-১২০০ টাকায় ধান কিনে দালালরা সেই ধান বিক্রি করছে সরকারী দর ১৮৩৫ টাকায়। তারা তীব্র প্রতিবাদ জানালেন। দাবি তুললেন কুইন্টাল পিছু ১২-১৩ কেজি ধান বাদ দেওয়া, টাকা দিতে অহেতুক বিলম্ব করা প্রভৃতি কূটকৌশল করে চাষিদের সরকারী ধান কেনার ব্যবস্থা থেকে হঠিয়ে দেওয়া চলবে না। সরকারী নির্দেশিকা হলো আর্দ্রতা বা ধুলো থাকার কারনে বড়ো জোর ৩ কেজি বাদ দেওয়া যায়। তারা আরও বলেন, এই এলাকায় একমাত্র কিষাণ মহাসভার আন্দোলনের ফলেই সরকার গ্রামে ক্যাম্প করে ধান কিনতে বাধ্য হয়েছিলো। আজ কিষাণ মান্ডি করে সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না। অবশেষে সরকারী কর্তারা সেই দাবি মেনে নিয়ে ধান কিনতে বাধ্য হয়। বাঁকুড়ার জঙ্গল মহল লাগোয়া এলাকার ছয়টি গ্রামে সদস্য সংগ্রহ হয়েছে। সেখানে উঠে আসে কাজের দাবি। বর্তমানে ১০০ দিনের কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সপরিবারে দুরবর্তী জেলায় নাবাল খাটতে যাওয়া যেন তাদের জীবনের ভাগ্যলিপি হয়ে উঠেছে। অথচ কলকাতায় বসে তৃণমূলের মন্ত্রীরা বলে চলেছেন ১০০ দিনের কাজে নাকি পঃ বাংলা রেকর্ড করেছে! কাগজে কলমে হয়তো বা তেমনটাই দেখানো হচ্ছে! কি অদ্ভূত স্ববিরোধীতা!! এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে দলে দলে আদিবাসী-তপশীলী সম্প্রদায়ের মানুষেরা কি বিজেপির দিকে যাবে? নাকি প্রকৃত বামপন্থা তথা নতুন বামপন্থার পতাকা তলে তারা সমাবেশিত হবেন? আদিবাসী-তপশীলী গরিব জনগণের জমি, ভাষা, ভাতার অধিকারকে সামনে রেখে কিষাণ মহাসভা বেশ কয়েকটি এলাকায় সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বর্ধমানের মন্তেশ্বর ব্লকের কুসুমগ্রামে তৃণমূলের সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করে দুই হাজার সদস্য সংগৃহীত হয়েছে। একটি পাড়ায় সদস্য সংগ্রহ অভিযান করতে গেলে তৃণমূলের মাতব্বররা বলে এখানে আমরা ওসব করতে দেবো না। কর্মীরা রুখে দাঁড়ায়, বচসা হাতাহাতি অবধি গড়ায়। অবশেষে সেই পাড়া থেকে সরে এসে গোটা গ্রামে সদস্য সংগ্রহ হয়। চাষিদের মধ্য থেকে কথা উঠে আসে যে, চাষে পর্যাপ্ত মজুর পাওয়া যাচ্ছে না। মজুরি দিতে গিয়ে লোকসান হয়ে যাচ্ছে। তখন কর্মীরা তাদের বুঝিয়ে বলে যে,কিভাবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতির ফলে সার, বীজ, বিদ্যুত, জল প্রভৃতি কৃষি উপকরনের দাম বাড়ছে। তখন চাষিরা সদস্য চাঁদা দেন। নদীয়া জেলায় জমির প্রশ্ন – ভাগ চাষিদের বর্গা রেকর্ডের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে জমির রেকর্ড না হওয়া, রেকর্ড জমির দখল না পাওয়া, ভূয়ো রেকর্ড তৈরি করা – এসব প্রশ্নে ব্লক ভূমিদপ্তরের চরম দুর্নীতি, টালবাহানা ও মানুষের ব্যপক হয়রানি – এর প্রতিবাদে সম্প্রতি নানাবিধ আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় কালীগঞ্জ ব্লকে দই হাজারের অধিক সদস্য সংগৃহীত হয়েছে। আবাস যোজনায় চরম দুর্নীতি দলবাজি নিয়েও প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে। নাকাশীপাড়ায় আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মানুষের স্বার্থে সরকারী খাস জমি দখল করে সেখানে ১০০ দিনের কাজ চালু করার দাবিতে পঞ্চায়েত বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। সেখানে ৫০০ ও ধুবুলিয়ার ৫০০ সদস্য হয়েছে। এছাড়া উঃ দিনাজপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, দঃ ২৪ পরগণা সহ কয়েকটি জেলায় সদস্য সংগ্রহ চলছে। এটাও দেখা গেছে যে, রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় আমাদের সংগঠনের উদ্যোগে এনআরসি-এনপিআর বিরোধী বিভিন্ন কর্মসুচী কৃষকদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সদস্য সংগ্রহে এটাও একটা ভালো  ভূমিকা নিয়েছে। এই ভাবে স্থানীয় আন্দোলন গড়ে তোলা বা আন্দোলনের প্রস্তুতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং বড় এলাকা জুড়ে কিষাণ মহাসভার পরিচিতি বা ভিত্তি গড়ে তোলার দিশায় এই সদস্য সংগ্রহ চলছে। আগামী দিনে রাজ্য-জেলা ও ব্লক স্তরের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সংগঠনের নীচু তলা পর্যন্ত এক কমিটি কাঠামো ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এটা ফলপ্রসু হয়ে উঠবে। পাশাপাশি সক্রিয় কর্মীদের দায়বদ্ধতাও গড়ে উঠবে।

কৃষিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া, নাগরিকত্বকে সাম্প্রদায়িক করে তুলে ধর্মীয় বিভাজন-মেরুকরণের কেন্দ্রীয় নীতির বিরুদ্ধে কৃষক ঐক্য গড়ে তোলার দিশায় আসন্ন রাজ্য সম্মেলনের প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে। পাশাপাশি এ রাজ্যে তৃণমুলের দুর্নীতি, দলবাজি, সন্ত্রাস এবং কৃষকদের প্রতি বঞ্চনা ও প্রতারণার প্রশ্নগুলিও সমভাবে গুরুত্ব বহন করছে। আজকের দিনে রাজ্যের বুকে কৃষি ও কৃষকের যে মূল এজেন্ডা সামনে আসছে তা হলো ব্যপক মাত্রায় চুক্তি চাষি-ভাগ চাষিদের অধিকারের প্রশ্ন। দেখা যাচ্ছে চাষাবাদের একটা বড়ো অংশে রয়েছেন এই ক্ষুদ্র চাষি ও ভূমিহীন কৃষকরা। নানা রকম চুক্তির মাধ্যমে প্রচন্ড মাত্রায় পারিবারিক শ্রমের বিনিময়ে যৎসামান্য পরিমাণ অর্থ বা খোরাক তারা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এরা কোনোরকম সরকারী সুযোগ সুবিধা পায় না। কারণ এদের কোনো কাগজ নেই। সম্প্রতি তৃণমূল সরকার “কিষাণ বন্ধু” প্রকল্পে একরে ৫ হাজার টাকা (এটাই সর্বাধিক) অনুদান দেওয়ার কর্মসূচী নিয়েছে। এই প্রকল্পের আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যাদের জমির কাগজ নেই পঞ্চায়েত প্রধানের শংসাপত্র এনে তারাও আবেদন করতে পারবেন। এটা গরিব মানুষকে দলবাজীর খপ্পরে ফেলার এক অপকৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রথমত মালিকরা চুক্তি বা ভাগ চাষিদের স্বীকৃতি দিতে চাইবে না, ফলে পঞ্চায়েতও তাদের স্বীকৃতি দেবে না – এটাই স্বাভাবিক। তাই এআইকেএম দাবি তুলেছে ব্লক কৃষি দপ্তরকে চুুুুক্তি-ভাগ চাষিদের নথীভূক্ত করতে হবে, তাদের সরকারী সবিধা দিতে হবে। নতুন করে সরকারী উদ্যোগে বর্গা স্বীকৃতি বা রেকর্ডের দাবি তোলা যায় কিনা এটাও আসন্ন সম্মেলনে আলোচ্য হয়ে উঠবে।

- জয়তু দেশমুখ

খণ্ড-27
সংখ্যা-8