প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিল্লী নির্বাচন ও গণহত্যার পর থেকে কোনো বড় মঞ্চ এড়িয়েই চলছিলেন। জ্বলন্ত সব প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হতে না চাওয়ার কারণে। কিন্তু কতদিন আর পাশ কাটিয়ে চলবেন। বার্তা চলে যাচ্ছিল মুখোমুখি হওয়ার তবে কি সাহস কুলোচ্ছে না! তাই নীরবতা ভেঙে দিনকয়েক আগে উপস্থিত হয়েছিলেন ‘ইকনমিক টাইমস গ্লোবাল সামিট’ মঞ্চে। সুযোগ পেয়ে বলে বসলেন, ‘আমরা স্থিতাবস্থা ভাঙতে চাইছি, কিন্তু আমাদের সমালোচকরা তা চায় না।’ কথাপ্রসঙ্গে কিছু ইস্যুর উল্লেখ করলেন। যেমন, সিএএ, তিন তালাক, কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার ইত্যাদি। এইসব ব্যবস্থা নেওয়াকে দাবি করলেন স্থিতাবস্থা ভাঙার পদক্ষেপ। যাই হোক, এই প্রসঙ্গগুলোর আগে ইতিপূর্বে জমানার প্রথম পর্বে মোদী যে প্রতিশ্রুতি ও ব্যবস্থা গ্রহণকে স্থিতাবস্থা ভাঙতে পা ফেলা বলে দাবি করেছিলেন তার কি পরিণতি ঘটেছে!
প্রথমেই ধরা যাক মোদী যে প্রসঙ্গ আর ভুলেও উত্থাপন করেন না সেই বিষয়টিকে। সেটা হল বিদেশে পাচার হয়ে কালো টাকা ফিরিয়ে নিয়ে এসে প্রত্যেক নির্ধন নাগরিকের ব্যাঙ্ক একাউন্টে ১৫ লাখ করে ভরে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। সেই প্রতিশ্রুতি সময় পার হওয়ার সাথে সাথে হাওয়াই মিলিয়ে গেছে। উল্টে দেশের ব্যাঙ্ক থেকে আরও কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। আমজনতার গচ্ছিত আমানতের টাকা ব্যাঙ্ক পরিচালকদের সাথে যোগসাজশ করে ‘ঋণ’ নেওয়ার নামে হাতিয়ে নেয় স্যাঙাত পুঁজির কারবারীরা, যাদের কেউ সংসদে বিজেপির প্রতিনিধি, কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন বানিজ্যিক বিদেশ সফরে সঙ্গী হয়েছিলেন। এদের গ্রেপ্তারির চাপের মুখে সরকারি হৈচৈ শুরু হলেও, ‘লুক আউট নোটিশ জারি’ হয় লুটেরারা এদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরে।
তারপরে জাল টাকা ও কালো টাকা ধরার নামে নোটবন্দীর জরুরি অবস্থা জারির পরিণতিতে তেমন কোনো জাল টাকার স্তূপ বা কোনো কালো টাকার গুপ্তধন ধরা পড়েনি, বরং সমস্ত কালো টাকা সাদা হয়ে ফিরে এসেছে ব্যাঙ্কের ঘরে। মাঝখান থেকে অহেতুক নতুন নোট ছাপতে উজাড় হয়েছে কোষাগার, আর দেশজুড়ে বাজার থেকে হঠাৎ করে রাশি রাশি টাকা উধাও হয়ে, পুঁজি শুকিয়ে কৃষিক্ষেত্র সহ ব্যাপক অসংগঠিত ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে, যে ধাক্কা থেকে এখনাবধি ব্যাপকতম কর্মসংস্থানের এই ক্ষেত্রটি পুনরুজ্জীবনের উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। বদমায়েশী রয়েছে আরও। মোদি সরকার আজও কৃষি-কৃষক বাঁচাতে ঋণমুক্তির ও ফসলের উৎপাদন ব্যয়ের দেড়গুণ দাম দেওয়ার প্যাকেজ ঘোষণা করল না। কৃষিমজুরদের ‘মনরেগা’ আইনগত কাজের অধিকারকে ব্যাপক সংকোচনে পিষ্ট করা হচ্ছে। মোদী জমানার পরবর্তী ধারায় তো বৃদ্ধিতে শোচনীয় অবনমন, অর্থনীতিতে ঝিমুনি, বেকারি সাড়ে চার দশকের দুরবস্থার রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়া, ফি বছরকার বাজেটে জনমুখী বরাদ্দে ক্রমাগত কাটছাঁট, আর রাষ্ট্রায়ত্ত ইউনিটের বিলগ্নীকরণ-বিরাষ্ট্রীয়করণ – এসবই ঘনিয়ে তোলা হচ্ছে। এই হচ্ছে ‘স্থিতাবস্থা ভাঙা’র নমুুুনা।
এই ধ্বংসাত্মক পৃষ্ঠভূমিতে প্রধানমন্ত্রী আবার ‘স্থিতাবস্থা ভাঙা’র নতুন নতুন গপ্পোগাছা বলতে শুরু করেছেন। বিরোধিতার তোড়ে মোদী সরকার এনআরসি টার্গেট আপাতত ঠান্ডা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তবে দুমুখোপনার চাতুরি চালানোয় বিরাম নেই। এনপিআর-সিএএ নিয়ে হুমকি সবথেকে বেশি। প্রধানমন্ত্রী উপরোক্ত গ্লোবাল সামিটের রঙ্গমঞ্চেও বলে বসলেন, সিএএ-র বিরোধিতা করে বিরোধীরা তিন পার্শ্বদেশ থেকে ধর্মীয় উৎপীড়ন সইতে না পেরে চলে আসা অ- মুসলিম উদ্বাস্তুদের, বিশেষত হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের অধিকার স্বীকার করতে চাইছে না। বেশ বজ্র আঁটুনি সাজানো অভিযোগ। কিন্তু ফস্কা গেরোর মতোই। দেখা যাক, এ প্রসঙ্গে বিজেপি নিজের প্রচারপত্রে কি যুক্তিজাল বিছিয়েছে। বক্তব্যের উপশিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে : “পূর্বেও বিভিন্ন সময় নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে”। তার তলায় বলা হয়েছে, “ইদি আমিনের শাসনকালে ১৯৭২ সালে উগান্ডায় উদ্ভূত সংকটে সেখানকার ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষদের ইন্দিরা গান্ধী নাগরিকত্ব দেন। শ্রীলঙ্কাতেও সংকটকালীন পরিস্থিতিতে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভারতীয় বংশোদ্ভূত ৪.৬১ লক্ষ তামিলদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। বিগত ছয় বছরে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত প্রায় ৪০০০ মানুষদের, যাদের মধ্যে প্রায় একশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন, নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। যখন ৫০টি বাংলাদেশী ছিটমহল ভারতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তখন এই ৪০০০ ছাড়াও ১৪,৮৪৬ জন বাংলাদেশী নাগরিকদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৯৬৫ এবং ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় উদ্বাস্তু নাগরিকদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার গুজরাত ও রাজস্থানের ছয়টি জেলার ম্যাজিস্ট্রেটদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করেছিল, যা মনমোহন সিংহের সরকার ২০০৫ এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত বলবৎ রেখেছিল।” (ভারতীয় জনতা পার্টি, পশ্চিমবঙ্গ কর্তৃক ...... প্রকাশিত)
তর্কের খাতিরে এই তথ্যকথাকে সত্য ধরলে এই প্রশ্ন ও বিরোধিতা ওঠাই খুব স্বাভাবিক যে, প্রচলিত আইনগত সংস্থানে ধর্মীয় পরিচিতি নির্বিশেষে যদি নাগরিকত্ব প্রদান করাই যায় তাহলে আবার সিএএ-র (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন) প্রয়োজন কেন? যে সংশোধনীতে মুসলিমদের নাগরিকত্ব প্রদানের সংস্থানের বিষয়টিকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে! সিএএ-র অবতারণা করা হয়েছে কোনো সদাশয় ভাবনা থেকে নয়, ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্ব প্রদানের দুরভিসন্ধি অনুসারেই এই ভোল বদলের অপচেষ্টা। যা মূলত মুসলিম বিরোধী মনোভাব থেকেই তৈরি করা এবং এনপিআর মারফৎ ‘ডাউটফুল’ তালিকায় ফেলে অবশেষে এনআরসি তালিকা থেকে ছেঁটে দিয়ে বে-নাগরিক বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার কলকাঠি। মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ‘একের মধ্যে তিন’ সূত্র হল সিএএ-এনপিআর-এনআরসি।
তিন তালাক প্রথা দূর করার আইন লাগু করতে চাওয়ার পেছনে মোদী সরকারের দরদ দেখানোটা স্রেফ দেখনদারির ছল, আসল উদ্দেশ্য হল, মুসলিম সমাজের ভেতর থেকে মহিলা ভোটের বিজেপি মুখী মেরুকরণ করা। সেইসঙ্গে প্রণীত ‘অভিন্ন দেওয়ানী আইন’ অমান্য করলে শাস্তিস্বরূপ বন্দোবস্ত রয়েছে মুসলিম পুরুষকে ফাটকে পুরে দেওয়ার। অর্থাৎ এক বৈষম্য-বিদ্বেষপূর্ণ বিধান হল বিজেপির বানানো ‘ইউসিসি’ (ইউনিফর্ম সিভিল কোড)। সিএএ-এনপিআর-এনআরসি ত্রিফলার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার বিপদ বুঝে মুসলিম নারীসমাজও ক্ষোভে ফুঁসছে, ওসব হটানোর লড়াইয়ে তারা এখন তিন প্রজন্ম একসাথে। নাছোড় প্রতিবাদী শাহীনবাগ মডেল দেশজুড়ে ছেয়ে গিয়ে সংখ্যায় ৩০০-র দিকে এগোচ্ছে। মুসলিম পুরুষেরাও দিচ্ছে সাহারা। দিনরাত এক করা এই লড়াইয়ে থাকা অবস্থায় মুসলিম মহিলারা চিনে ফেললেন বিজেপি নেতৃত্বের আসল চেহারা, শুনতে হয়েছে কতই না কুৎসিত ইতর প্রকৃতির পিতৃতান্ত্রিক মন্তব্য! স্থিতাবস্থা ভাঙতে চাওয়ার কি কদর্য পদক্ষেপ। মোদী কাশ্মীরে সত্তর বছরের স্থিতাবস্থা ভাঙতে চাওয়ার আর তাতে বিরোধীদের শাপক্ষোভের সম্মুখীন হওয়ার কহানি শোনাচ্ছেন। সংবিধানের নিগড়ে বাঁধা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণের ইতিহাস সমস্ত রাজ্য বা অঞ্চলে অভিন্ন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তি থেকে শুরু হয়নি, তাই কাশ্মীর সহ কোনও কোনও রাজ্য বা পুনর্গঠিত রাজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ স্বাধিকারের সাংবিধানিক মর্যাদা দিয়ে আসার পরম্পরা অস্বীকার করা যায় না। ‘এক দেশ এক আইন’ প্রবর্তনের নামে কেন্দ্রের ক্ষমতার জোরে কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার বিশেষ মর্যাদার বিলোপ ঘটানো হল। অন্যদিকে অথচ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুরের মতো রাজ্যগুলোর জনজাতি/উপজাতি/আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে স্বতন্ত্র ‘ইনার লাইন পারমিট’ ব্যবস্থার স্বাধিকার বজায় রাখা আছে। তাহলে কাশ্মীরের বিশেষাধিকারের ওপর কোপ পড়ল কেন? রয়েছে একটাই উদ্দেশ্য, আর সেটা হল তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ। মোদী সরকার কাশ্মীরের স্বায়ত্ততা কেড়ে নিয়েছে, বিনিময়ে দিয়েছে বন্দীত্ব, কাশ্মীর সেই থেকে অবরুদ্ধ। এই হচ্ছে তাদের স্থিতাবস্থা ভাঙার বিষফল।
মোদী জমানা প্রমাণিত হয়ে চলেছে স্থিতাবস্থা ভাঙার নামে জুলুমরাজের একের পর এক জোয়াল চাপিয়ে দিতে চায়। বিপরীতে দেশের নিপীড়িত শ্রেণী-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ-ভাষা-সম্প্রদায়-ধর্ম নির্বিশেষে আম গণতান্ত্রিক জনতাকে জোট বাঁধতে হবে বিরাজমান মোদীতন্ত্রকে উপড়ে ফেলার লড়াইয়ে। আর এটাই হল দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, বহুত্বের স্বার্থে স্থিতাবস্থা ভেঙে ফেলার প্রকৃত লড়াই।