নভেম্বর মাসে হায়দারাবাদে এক পশু চিকিৎসকের গণধর্ষণ ও হত্যা সারা ভারতেই ব্যাপকতর স্তরে প্রবল ঘৃণা ও ক্রোধের জন্ম দেয়। এই ঘৃণ্য অপরাধের পর দেশব্যাপী যে ক্রোধ ফেটে পড়ে অনেকেই তাকে তুলনা করেছেন ২০১২-র ডিসেম্বরে দিল্লীর এক বাসে জনৈক তরুণীর গণধর্ষণের কুখ্যাত ঘটনার পর — যে তরুণী পরে তাঁর আঘাতের জন্য মারা যান —বিস্ফোরিত ক্রোধের সঙ্গে। তবে এই দুই ক্ষণের মধ্যে মিলের চেয়ে বৈসাদৃশ্যই বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, এবং তা গত কয়েক বছরে ভারতীয় সমাজ এবং রাজনীতিতে আসা বিপজ্জনক পরিবর্তনের উপরও যথেষ্ট আলোকপাত করে।
২০১২ সালে আমি এবং অন্যান্য নারিবাদী স্বর দিল্লিতে হাজার-হাজার ক্রুদ্ধ প্রতিবাদকারীর মাঝে দাঁড়িয়ে তাদের বুঝিয়ে এই ব্যাপারটায় রাজি করাতে পেরেছিলাম যে, “ধর্ষককে ফাঁসি দাও”, “ধর্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেল” শ্লোগান না দিয়ে তার পরিবর্তে “নারী স্বাধীনতা চায়” এই শ্লোগানকে তুলে ধরতে এবং কোনো ধরনের হিংসা বা অসদ্ব্যবহারের মধ্যে না যেতে। “মৃত্যুদণ্ডর” অট্টরোলকে ছাপিয়ে আমরা জবাবদিহি করার বাধ্যবাধকতার আমাদের দাবিকে প্রচার করতে পেরেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী এবং শাসক দলের সমালোচনা করলেও ধর্ষণ এবং হত্যার হুমকির তোড় আমাদের দিকে ধেয়ে আসেনি।
এর ফলে আমরা যৌন হিংসা নিয়ে আলোচনাকে নতুন ধারায় চালিত করার সূচনা ঘটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। আমরা জানাতে সফল হয়েছিলাম যে, ভারতে প্রশাসনিক কতৃপক্ষ যৌন হিংসাকে সম্মতির লঙ্ঘনের চেয়ে সম্মানহানি রূপে বুঝতেই পছন্দ করে। এটা সম্মতির ভিত্তিতে আন্তঃজাত বা আন্তঃধর্মের মানুষের মধ্যে সম্পর্ককে ধর্ষণের সঙ্গে একাকার করে তোলে, যা আবার সাদা চোখের দৃষ্টিতে “সম্মান” অপরাধ এবং পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকে আড়াল করতে পারে। আমাদের প্রতিবাদ বাস্তব পরিস্থিতিকে তার যথাযথ রূপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল, এবং সেই প্রথমবারের মতো নারীদের শর্তহীন স্বায়ত্ততার আত্মঘোষণা যথেষ্ট লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল ও সমর্থন পেয়েছিল এবং ধর্ষিতার উপরই দোষারোপের রীতিকে পিছনে ঠেলে দেওয়া গিয়েছিল।
এবার কিন্তু ধর্ষণে অভিযুক্তদের ফাঁসি দেওয়া, গণ পিটুনিতে মেরে ফেলা অথবা আনুষ্ঠানিক বিচার ছাড়াই প্রাণদণ্ড দেওয়ার আওয়াজকে টপকে নিজেদের স্বরকে তুলেধরাটা নারীবাদীদের পক্ষে যথেষ্ট কঠিন হচ্ছে। হায়দারাবাদের ঘটনায় এক সাংসদ অভিযুক্তদের সর্বসমক্ষে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার আহ্বান জানান। এর কয়েকদিন পরই পুলিশ গভীররাতে চার নিরস্ত্র অভিযুক্তকে গুলি করে মেরে ফেলে আর দাবি করে যে নিজেদের আত্মরক্ষার্থেই তাদের গুলি চালাতে হয়। ব্যাপক সংখ্যক মানুষই এই হত্যাগুলোকে সজ্ঞানে প্রাণদণ্ড দেওয়া বলে মনে করেন এবং আশঙ্কাজনক ব্যাপার হল, এই হত্যাকাণ্ডকে সেরকমভাবেই অভিনন্দিত হচ্ছে এবং তা নিয়ে উল্লাস করা হচ্ছে। ২০১২র ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে যে সাজাপ্রাপ্তরা মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় রয়েছে, মোদী সরকারের কাছে তাদেরও প্রাণদণ্ড কার্যকরী করার দাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে।
হেফাজতে হত্যা ভারতে নতুন কোনো ব্যাপার নয়। এমনকি ২০১৩ সালেও হিংসার ডাক দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ও নিজেদের বক্তব্যকে তুলে ধরতে নারীদের যথেষ্ট লড়াই করতে হয়েছিল, এবং তা বিশেষভাবে করতে হয়েছিল ২০১২র ধর্ষণ-হত্যার ঘটনায় এক অভিযুক্তকে জেলের মধ্যে মৃত অবস্থায় দেখা যাওয়ার পর। এবার কিন্তু দক্ষিণপন্থী জননেতাদের ট্রোল বাহিনীর কাছ থেকে নারীবাদীদের লাগাতার গালমন্দের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। নারীবাদীরা এই হত্যাকাণ্ডগুলোর নিন্দা করে বলে প্রচারে নিযুক্ত ব্যক্তিরা তাদের বিরুদ্ধে নারী স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনে। অনেকে আবার এই ভুয়ো খবর ছড়ায় যে ধর্ষণে অভিযুক্তরা সবাই মুসলিম ছিল।
যৌন হিংসা কেন্দ্রীক আলোচনা ধারায় এই ক্লেদাক্ত মোড়ের পিছনে এক গ্লানিকর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ২০১৪-র সংসদীয় নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রচার চলার সময় ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ মুসলিম-বিরোধী হিংসার সমর্থনে বলেন, “কেউই দাঙ্গা করতে চায় না। কিন্তু কোনো সম্প্রদায় যখন আমাদের মেয়ে ও বোনদের সম্মান নষ্ট করে, এবং প্রশাসন চোখ বুজে থাকে, তখন জনগণ দাঙ্গা করতে বাধ্য হয়।” নারীদের রক্ষা করা ও তাদের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার অজুহাতে মুসলিম-বিরোধী হিংসার এই খোলাখুলি উদযাপন ২০১৪-র সংসদীয় নির্বাচনে মোদীকে বিপুল জনসমর্থন লাভে সহায়তা করে।
অতি-দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলো মুসলিম পুরুষদের চালানো “প্রেম জিহাদ” থেকে হিন্দু নারীদের উদ্ধার করার দাবি করে আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের উপর সহিংস আক্রমণ চালানোকেই তাদের একান্ত কর্তব্য করে তুলেছে। স্বায়ত্ততার অধিকারের আত্মপ্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়ে চলা নারীবাদী প্রচারগুলো ইসলামোফোবিয়ার এজেন্ডার চরিতার্থতায় পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শকে কাজে লাগানোর এই প্রচেষ্টাগুলোকে প্রতিকূল করে তোলে।
আর এই কারণেই নারীবাদীদের উপর অতি-দক্ষিণপন্থীদের আক্রমণ এমন কদর্য ও উগ্ৰ আকার নেয়। যে প্রচারকরা গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা এবং হেফাজতে হত্যাকে “ন্যায়বিচার” বলে উদযাপন করে এবং মুসলিমদের “ধর্ষক” ও “প্রেম জেহাদি” বলে চিত্রিত করে, তারাই আবার নারীবাদীদের অভিহিত করে “দেশদ্রোহী” এবং “অবাধ যৌনতার” প্রবক্তা বলে। নারীবাদী আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজ পুলিশ ও আধা সেনাদের হাতে হেফাজতে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় মধ্য ভারতের স্থানীয় মানুষদের আইনি লড়াই লড়তে সহায়তা করেছিলেন। সরকারপন্থী টিভি চ্যানেলগুলো ও পুলিশ তাঁকে “শহুরে নকশাল” বা বামপন্থী জঙ্গিদের এজেন্ট বলে প্রচার চালানোর পর তিনি বর্তমানে জেলে আটক রয়েছেন।
এই শক্তিগুলো একইসাথে দাবি করে থাকে যে, পুরুষরা ধর্ষণ এবং গার্হস্থ্য হিংসা আইনের অপব্যবহারের শিকার হচ্ছেন। মুসলিম সম্প্রদায়কে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলতে জম্মুর কাঠুয়ায় একটি ছোট মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করার ঘটনায় যে পুরুষরা অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছে, তাদের নিরপরাধ ঘোষণা করে কেউ-কেউ এর পিছনে ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের প্রচারও চালিয়েছেন, শাসক বিজেপির আইন রচয়িতারা হ্যাশট্যাগ মি টু-তে যে অপবাদ এবং ধর্ষণের অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন, তার কথা না হয় ছেড়ে দেওয়াই হল।
ধর্ষণে অভিযুক্তদের হত্যায় আনন্দে মেতে উঠে জনতা মিষ্টি বিলোচ্ছে ও গোলাপের পাপড়ি ছড়াচ্ছে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে যখন এই ফুটেজ দেখাতে দেখি এবং শুনতে পাই যে, গণপিটুনিতে মেরে ফেলা ও হেফাজতে হত্যার প্রতিবাদের জন্য নারীবাদীদের অভিজাতপন্থী বলে ছাপ মেরে দেওয়া হচ্ছে, তখন আমার ২০১৭ সালের স্বাধীনতা দিবসে বিজেপি নেতা রাম মাধবের লেখা এক নিবন্ধের কথা মনে পড়ে যায়। ঐ নিবন্ধে তিনি এটাই বলেছেন যে, ভিড়ের যে প্রবণতায় আকর্ষণ তাতে উদারপন্থীদের অস্বস্তিটাই হল অভিজাতবাদী। তিনি বলেন, “ ভিড়ের মধ্যে থাকা দীনহীন মানুষেরা মোদীর সঙ্গে রয়েছে। তারা অবশেষে এমন একটা সরকার সম্পর্কে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে যে সরকারকে দেখেশুনে তাদের অত্যন্ত কাছের মনে হচ্ছে। ওরা এটাকে উপভোগ করছে।” আমাদের সরকার যখন ভারতীয় সমাজের নিকৃষ্টতম প্রবৃত্তিগুলোকে উদযাপন করছে, নারীবাদীরা তখন নির্ভীকভাবেই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রবণতাগুলোকে বরণ করার জন্য আবেদন জানাচ্ছে।