এইভাবেই ঘটনাটা এগিয়েছিল: উর্দি পরিহিত কিছু লোক একজনকে ধরে তাদের হেফাজতে নিল। পরে তারা তাকে হত্যা করল এবং দাবি করল যে, ঐ ব্যক্তি যেহেতু পালিয়ে যাচ্ছিল তার পলায়নকে আটকাতে তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল। এর পর আন্দোলনের কর্মীরা ‘সংঘর্ষে হত্যা’র এই ঘটনাটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করলে রাষ্ট্র এবং তার কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার জন্য তাদের ‘দেশদ্রোহী’ বলে ছাপ মারা হতে লাগল।
আপনারা হয়ত ভাবছেন যে, আমি বুঝি ৬ ডিসেম্বরের ঘটনার কথা বলছি যে ঘটনায় হায়দারাবাদে পশু চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং হত্যায় অভিযুক্ত চার ব্যক্তিকে তেলেঙ্গানা পুলিশ হত্যা করে। ‘সংঘর্ষে হত্যা’র এই যে ঘটনাটায় নারীদের ‘ন্যায়বিচার’ দেওয়ার জন্য রাজনীতিকগণ এবং জনসাধারণ পুলিশকে সাবাশ জানাচ্ছে তা এক ঘৃণ্য কাজ।
আমি কিন্তু এই ঘটনাটার কথা বলছি না, বলছি অন্য একটা ঘটনার কথা যেটা এই প্রসঙ্গে আমার মাথায় এল। মনিপুরী তরুণী থাংজাম মনোরমার সেনা হেফাজতে হত্যার ঘটনা ঘটেছিল ২০০৪ সালে। একদিন রাতে ১৭তম আসাম রাইফেলস-এর কিছু সদস্য জোর করে তার বাড়িতে ঢুকে সে একজন জঙ্গি বলে দাবি করে তাকে তাদের হেফাজতে নেয়। পরদিন সকালে ওরা দাবি করে যে, ওরা ওকে গুলি করে মেরে ফেলতে বাধ্য হয়েছে, কেননা, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার নাম করে ও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। এক বিচারবিভাগীয় তদন্তে পরে প্রমাণিত হয় যে, আসাম রাইফেলস-এর কিছু সদস্য মনোরমাকে গণধর্ষণ করে এবং তাদের কুকীর্তিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তার যৌনাঙ্গে গুলি চালায়। রাজ্য সরকারের গঠন করা বিচারপতি সি উপেন্দ্র সিং-এর নেতৃত্বাধীন কমিশনের তদন্তে প্রকাশ পায়, মনোরমাকে ‘শায়িত’ এবং ‘অসহায়’ অবস্থায় গুলি করা হয়। তবে লজ্জাজনক ব্যাপার হল, এর পরও খুব কিছু হল না। মনোরমার ধর্ষণ ও হত্যায় এবং তার হত্যাকে ‘সংঘর্ষ বলে চালানোয়’ যারা অভিযুক্ত তাদের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে আনাই হল না, কেননা, তারা সেনা বাহিনীর (বিশেষ ক্ষমতা) আইনের অধীনে সুরক্ষা পায়।
এই দুটো ঘটনাই আমাদের মধ্যে আলোড়ন তুলে মনে পড়িয়ে দেয় যে, রাষ্ট্র যখন পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণকে হত্যা করে ঐ হত্যাকাণ্ডগুলোকে সংঘর্ষ বলে চালানোর অধিকার দেয়, তা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয় না, তাতে নারীর সুরক্ষা একটুও বাড়ে না। বস্তুত, ঐ ক্ষমতা প্রায়শই নারীর নিরাপত্তাকে বিপর্যস্ত করতেই ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের ক্ষমতা একদল মানুষকে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করার আত্মবিশ্বাস জোগায়, তারা এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ রূপে অবহিত হয়েই ঐ অপরাধের পথে চালিত হয় যে তারা শাস্তি থেকে অব্যাহতি পেয়ে যাবে — যতক্ষণ তারা অপরাধের সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করতে অপরাধের শিকার মানুষজনকে হত্যা করতে পারবে। আর অপরাধীর দল যদি পুলিশ বা সেনা বাহিনী/আধা সেনাবাহিনী হয় তবে তারা হত্যাকাণ্ডকে সংঘর্ষ হত্যা বলে চালাতেও সক্ষম হয়। তখন ঐ হত্যাকাণ্ডকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং যারা অপরাধের শিকার তাদের জন্য ন্যায়বিচার চাওয়ার আমাদের সামর্থ্যও দুর্বল হয়ে পড়ে।
‘‘পুরুষরা আমার কাছে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে’’ নামক তাঁর বই থেকে নেওয়া “দীর্ঘতম যুদ্ধ” নামে ২০১৩ সালের এক প্রবন্ধে মার্কিন লেখিকা রেবেকা সলনিস্ট বলেছেন, “নারীদের বিরুদ্ধে হিংসার একটা ধরন আছে যা বহু বিস্তৃত ও গভীর এবং ভয়াবহ এবং লাগাতারভাবে তাকে উপেক্ষা করে চলা হয়। কখনও-কখনও নির্দিষ্ট কোনো ঘটনায় খ্যাতনামা কোনো ব্যক্তিত্বকে জড়িয়ে বীভৎসতার সবিস্তার বর্ণনা সংবাদ মাধ্যমে বড় আকারে ঠাঁই পায়। তবে, এগুলোকে ব্যতিক্রম রূপেই গণ্য করা হয়, আর নারী-বিরোধী হিংসার অজস্র আনুষঙ্গিক ঘটনা এই দেশে, অন্যান্য দেশে, আন্টার্কটিকা সহ সমস্ত মহাদেশেই সংবাদের এক অলংকরণ হিসাবে কাজ করে। ... আমরা এমন সমস্ত বিন্দু পাই যা এত কাছাকাছি থাকে যে সেগুলো ছোপের মত হয়ে কলঙ্কের রূপ নেয়। কিন্তু বলতে গেলে কেউই সেগুলোকে যোগ করে না বা সেই কলঙ্কটার উল্লেখ করে না। ভারতে ওরা এটা করতে পেরেছিল। ওরা বলেছিল যে এটা একটা নাগরিক অধিকারের ইস্যু, এটা সবার সমস্যা, এটা বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়, এবং এটাকে আর কখনই মেনে নেওয়া হবে না। এটাকে বদলাতেই হবে। পাল্টানোটা তোমার কাজ, আর আমার কাজ, এবং আমাদের কাজ।”
দিল্লীতে ২০১২ সালের গণধর্ষণকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদের পরবর্তী পর্যায়ে ভারতে নারীবাদীরা আলোচনাধারার গতিমুখের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্ৰগতি ঘটাতে সক্ষম হয় — প্রতিশোধ নেওয়ার বিবেচনাহীন অন্ধ জিগির থেকে আলোচনাধারাকে ঘোরানো হয় নারী এবং লিঙ্গ ও যৌন সংখ্যালঘুর জন্য “শঙ্কাহীন স্বাধীনতা” সৃষ্টির অবিচল দাবির দিকে। ধর্ষণ সংস্কৃতি, ধর্ষণের শিকার মহিলাদের দোষারোপ এবং “নিরাপত্তার” জন্য স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেওয়ার কথা সমাজে অবলীলায় নারীদের বলতে পারা — এই যে রেওয়াজ এখানে রয়েছে তাকে অতিক্রম করে “সমস্ত ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দাও”-এর হট্টরোলকে ছাপিয়ে নারীবাদীরা তাদের বক্তব্যকে তুলে ধরতে এবং তার অনুরণন ঘটাতে পেরেছিল।
নারীবাদীদের আজ যখন আরো একবার সাংসদদের, অভিনয় জগতের কুশিলবদের, খেলার জগতের নায়কদের, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের — সামাজিক মাধ্যমের “লিঞ্চ বাহিনীর” কথা না হয় বাদ দেওয়াই হল — মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে, তখন এই সমস্ত কিছুই প্রশ্নের মুখে পড়ছে। হায়দারাবাদের পুলিশ যেভাবে অভিযুক্তদের হত্যা করেছে — তারা সত্যিই অপরাধী ছিল কিনা তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই — এরা সবাই তাতে বাহবা দিচ্ছে।
সারা ভারতে প্রকাশ্য স্থানগুলোতে নারীদের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করা যাবে কিভাবে সে প্রশ্ন কি আমরা তুলব না? পুলিশের প্রজ্ঞা অনুসারে চললে নারীদের রাস্তায় বেরোনো চলবে না, বিশেষভাবে রাত ৮টার পর। কিন্তু অল্প সংখ্যক নয়, অনেক বেশি সংখ্যায় নারী রাস্তায় থাকলেই রাস্তা নারীদের কাছে নিরাপদ হয়ে ওঠে। রাস্তাঘাট নারীদের চলাফেরায় গমগম করলে তা তখনই নারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে এবং তারা কম ভয় পায়। যে দুটো একেবারেই সরল ব্যবস্থায় এটা সম্ভব হতে পারে তা হল রাস্তায় আরো ভালো আলোর ব্যবস্থা এবং প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা সরকারি পরিবহন সচল থাকা যা নিরাপদ, সস্তা এবং দিবারাত্র কাজ করে। হায়দারাবাদের ‘দিশা’ অথবা দিল্লীর জ্যোতি সিংকে যদি নিরাপদ সরকারি পরিবহনের নিশ্চয়তা দেওয়া যেত তবে খুব সম্ভবত আজ তারা বেঁচে থাকত। দূরতম স্থানের সঙ্গে সংযোগ সম্পন্ন সরকারি পরিবহনের পরিকাঠামো থাকলে তা ‘শঙ্কাহীন স্বাধীনতার’ সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করে।
আজ আমাদের আরো যা প্রয়োজন তা হল ধর্ষণের মামলাগুলোতে ন্যায়বিচার দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা। এই কথা বলে আমি আরো ফাস্ট ট্র্যাক আদালত স্থাপন বা আরো বেশি সংখ্যায় বন্দুকবাজ পুলিশ নিয়োগের কথা বোঝাচ্ছি না। এর পরিবর্তে আমরা চাই সরকার যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করে আরো বেশি সংখ্যায় আদালত স্থাপন ও বিচারপতি নিয়োগ করুক। আইন মন্ত্রকের দেওয়া পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০১৪ সালে দেশে যেখানে ১০ লক্ষ জনগণ পিছু ১৭ জন বিচারপতি ছিল, আজ সেখানে ১০ লক্ষ জনগণ পিছু রয়েছে ২০ জন বিচারপতি। এই অনুপাত চূড়ান্ত রূপেই নিকৃষ্ট এবং ধর্ষণের মামলাগুলো দীর্ঘদিন ধরে নিষ্পত্তি না হওয়ার পিছনে এই বিষয়টার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। আইন কমিশন ১৯৮৭ সালে সুপারিশ করেছিল যে, ভারতে ১০ লক্ষ জনগণ পিছু কম করে ৫০ জন বিচারপতি থাকতে হবে। আমরা যেটাকে ন্যায়বিচার বলে জানি, হায়দারাবাদে বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনায় দেখতে পাওয়া সমর্থন ও উল্লাস প্রকাশের আতিশয্য তাতে এক বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি করছে। এছাড়াও, নারীদের নিরাপত্তাহীনতাকে কিভাবে লাঘব করা যায় সে ব্যাপারে দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে পাচার করতেও এটা সরকারকে সক্ষম করে।