আবেদন
প্রত্যাখ্যান ও প্রতিহত করুন অ-সাংবিধানিক, গরিব বিরোধী, সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ও সারা ভারত এনআরসি-কে
(ক্যাব ও এনআরসি এবং ছাত্র-শিক্ষক-বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর হামলার বিরুদ্ধে ১০ ডিসেম্বর, মানবাধিকার দিবসে প্রতিবাদ সংগঠিত করার প্রচারপত্র)

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল মন্ত্রীসভায় অনুমোদন পেয়েছে, সংসদে পেশ হতে চলেছে। চোরা পথে আরএসএসের “হিন্দু রাষ্ট্র”-র ধারণাকে পাশ করানো হচ্ছে।

১। সংশোধনী বিলটি আনার প্রেক্ষিত হিসেবে বলা হচ্ছে যে এর ফলে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে আসা সংখ্যালঘুরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। প্রশ্ন হল - প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে আসা নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি, যেমন রোহিঙ্গা মুসলমান, শ্রীলঙ্কার তামিল, তিব্বতী বৌদ্ধ, উইঘুর মুসলমান বা বাংলাদেশের নিপীড়িত নাস্তিক যুক্তিবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠি (যাদের অধিকাংশই মুসলমান উৎসের) এই তালিকা থেকে বাদ কেন? শরণার্থীর সংজ্ঞা নির্ধারণে ধর্মবিশ্বাস ও জাতীয়তার ওপর ভিত্তি করে নিপীড়িত সংখ্যালঘু ঠিক করা হচ্ছে কেন? কেন এই বিল কেবলমাত্র আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্ট, পারসিক, জৈন ও শিখদের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছে?

২। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের (ক্যাব) উদ্দেশ্য শরণার্থী ও নিপীড়িত সম্প্রদায়কে সুযোগ করে দেওয়া নয়। বরং, উদ্দেশ্য হল ভারতীয় নাগরিকের সংজ্ঞা থেকে মুসলমান সম্প্রদায়কে বাদ দেওয়া। ক্যাব থেকে মুসলমানদের বাদ দেওয়ার পেছনে এছাড়া আর তো কোনও যুক্তি নাই!

৩। বিজেপি জানে যে তার দেশজুড়ে এনআরসি-র পরিকল্পনা বুমেরাং হয়েছে এবং হিন্দুমুসলমান বিভাজনের যে উদ্দেশ্য তাদের ছিল তার বদলে দেশব্যাপী এনআরসি-র বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য। বিজেপি একথা মেনে নিয়েছে যে এনআরসি-কে এরকম ঐক্যবদ্ধভাবে প্রত্যাখ্যান করার ফলেই পশ্চিমবাংলার সাম্প্রতিক বিধানসভা উপ নির্বাচনে তাদের পরাজয় হয়েছে। এখন মোদি-শাহ জুটি আশা করছে যে সেই ঐক্য ভাঙতে ক্যাব-কে তারা হাতিয়ার করতে পারবে এবং হিন্দুদের তারা আশ্বস্ত করতে পারবে যে অল ইন্ডিয়া এনআরসি-তে নাম না থাকলেও ক্যাব তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু এটাও সাম্প্রদায়িক অসদুদ্দেশ্যে তাদের আরেক মিথ্যাচার মাত্র।

৪। অল ইন্ডিয়া এনআরসি ভারতের সব গরিবকেই বাদ পড়ার বিপদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। গরিবরা তো নিজেদের এমনকি গরিব বলেও প্রমাণ করতে পারেন না। তাই তাঁরা বিপিএল তালিকা থেকেও বাদ পড়েন। কীভাবে তাঁরা প্রমাণ করবেন যে তাঁদের পূর্বপুরুষ ১৯৫১ সালে নাগরিক ছিলেন? আসলে এনআরসি সমস্ত ভারতীয়কে রাষ্ট্রহীন হওয়ার বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে ক্যাব বলে দিচ্ছে যে, মুসলমানরা এনআরসি থেকে বাদ পড়লে রাষ্ট্রহীন হয়ে যাবে এবং “বিতাড়িত হবে”, আর অ-মুসলমানরা এনআরসি-ছুট হলে শরণার্থীর মর্যাদা পাবে আর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবে। অন্য কথায় বললে, অল ইন্ডিয়া এনআরসি-তে ভারতের অধিকাংশ নাগরিকের সামনে দুটো পথ খোলা—হয় রাষ্ট্রহীন হও, নয় শরণার্থী। সংবিধান যাদের একগুচ্ছ অবিচ্ছেদ্য অধিকারের গ্যারান্টি দিয়েছে সেই ভারতীয় নাগরিকদের প্রত্যেককে অল ইন্ডিয়া এনআরসি+ক্যাব পর্যবসিত করবে করজোড়ে নাগরিকত্ব ভিক্ষা করা একেক জন আবেদনকারীতে।

৫। এই এনআরসি+ক্যাব বিপর্যয়কে মোদির নোটবন্দী বিপর্যয়ের সাথে তুলনা করা চলে। নোটবন্দী দাবি করেছিল যে তা কালো টাকা থেকে দেশকে মুক্ত করবে। বাস্তবে তো কালো টাকা বিজেপির ফান্ডে ঢুকে পড়ছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে। নোটবন্দী কারেন্সি নোট লুপ্ত করে ভারতের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। একইভাবে দেশজুড়ে এনআরসি+ক্যাব জনতার নাগরিকত্ব লুপ্ত করে ভারতের সংবিধানকে ধ্বংস করবে।

৬। ভারতীয়রা এখন মোটেই “বেআইনি অনুপ্রবেশকারী” সমস্যায় ভুগছে না। এমন কোনও তথ্যই নাই যে ভারতে অনথীভুক্ত অভিবাসীর বিপুল সংখ্যায় আগমন ঘটেছে। ভারতবাসী ভুগছে কর্মহীনতা আর বঞ্চনায়, অভিবাসীদের কারণে নয়, মোদি-শাহ সরকারের আমলে অর্থনীতি, চাকুরি আর সমাজ বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে। ভারতীয়দের একজোট হতে হবে। প্রত্যাখ্যান করতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে দেশজুড়ে এনআরসি+ক্যাব-কে যা প্রকৃতপক্ষে ভারতের অ-সাম্প্রদায়িক সংবিধানের ওপর এক সর্বাত্মক হামলা।

সিপিআই(এমএল) আহ্বান রেখেছে ১০ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসকে, এবছর ভারতে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে সংগঠিত করার—ভারতের সংবিধান ও জনতার ওপর দেশজুড়ে এনআরসি ও ক্যাবরূপী আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে। সেই সাথে এই মানবাধিকার দিবস পালিত হোক জেএনইউ ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় সহ আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেসব সংগ্রামরত ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক শিক্ষিকা কেন্দ্রীয় সরকারের হামলার বিরুদ্ধে লড়ছেন তাঁদের প্রতি সংহতি দিবস হিসাবে।

কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন

খণ্ড-26
সংখ্যা-40