বিবৃতি
পাঁচ বাম দলের ‘এনআরসি-সিএবি’ বিরোধী বিবৃতি
(১২ ডিসেম্বর পাঁচটি বাম দল—সিপিআই(এম), সিপিআই, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, ফরোয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি ‘সিএবি-এনআরসি’র বিরুদ্ধে এই বিবৃতিটি দেয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন সিপিআই(এম)-এর পক্ষে সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই-এর পক্ষে ডি রাজা, সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, ফরোয়ার্ড ব্লকের পক্ষে দেবব্রত বিশ্বাস এবং আরএসপি-র পক্ষে মনোজ ভট্টাচার্য।)

সংসদের উভয় কক্ষই নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল (সিএবি) পাশ করেছে। বাম দলগুলো মনে করে, এই বিল ভারতীয় সংবিধানকে পুরোপুরি লঙ্ঘন করে এবং এর লক্ষ্য হল ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে ধ্বংস করা।

এই বিল নাগরিকত্বকে ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সংযুক্ত করে যা হল ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ বিপরীত, আর তাই বাম দলগুলো এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করছে।

এই বিলের আরো লক্ষ্য হল দেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং সামাজিক মেরুকরণকে তীব্রতর করা যা দেশের ঐক্য ও সংহতির পক্ষে চূড়ান্ত ক্ষতিকারক।

বিলটির পাশ হওয়া এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকে সারা দেশে সম্প্রসারিত করার মোদী-শাহর বিজেপি সরকারের ঘোষণা—এই দুটি একযোগে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের চরিত্রকে পাল্টে দেবে, ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র থেকে পরিণত করবে “হিন্দু রাষ্ট্রে” যা হল আরএসএস-এর রাজনৈতিক প্রকল্প।

সিএবি(ক্যাব)-এনআরসি-র বিরুদ্ধে ২০১৯-এর ১৯ ডিসেম্বর জনগণের প্রতিবাদ সংগঠিত করার জন্য বাম দলগুলো সারা দেশে তাদের সমস্ত শাখার কাছে আহ্বান জানাচ্ছে।

এই দিনে, ১৯২৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাম প্রসাদ বিসমিলকে—যিনি দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা সঞ্চারি আহ্বান, ‘সরফিয়াওসি কি তামান্না’কে মূর্ত করে তুলে ভারতীয় জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন—গোরখপুর জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়। সহ-অভিযুক্ত আসফাকুল্লা খানকে ফৈজাবাদ জেলে এবং রোশন সিংকে নৈনি জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়। ধর্মীয় বিচারকে উপেক্ষা করে গড়ে তোলা এই ঐক্য ব্রিটিশদের থেকে ভারতকে স্বাধীনতা এনে দেয়। আরএসএস-বিজেপি আজ এই ঐক্যকেই ধ্বংস করতেই উঠে পড়ে লেগেছে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদ

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব) লোকসভায় পেশ হওয়া এবং দায়সারাভাবে বিতর্ক চালিয়ে তা পাশ হওয়ার পরপরই জনগণ ভারতের সংবিধানের উপর মোদী সরকারের দেওয়া সর্বনাশা আঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। অনেক সংগঠনই এই বিলের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই চালানো এবং এর সঙ্গে সহযোগিতা না করার কথা ঘোষণা করেছে, আর তাই আগামী দিনগুলোতে এর বিরুদ্ধে লড়াই জারি থাকবে বলেই মনে হয়। এনআরসি এবং জাতীয় জনপঞ্জি (এনআরপি) প্রক্রিয়াকে বয়কট করার কথা অনেক সংগঠনই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে।

এনআরসি/সিএবি-র নামে একটা চক্রান্ত চলছে; আক্রমণ চলছে সংবিধান এবং নাগরিকদের অধিকারের উপর; আক্রমণের মুখে পড়ছে ছাত্র, শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষভাবে জেএনইউ। এ সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সিপিআই(এমএল) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসকে প্রতিবাদ দিবস হিসাবে উদযাপনের ডাক দেয়। সিপিআই(এমএল) এবং তার অনুমোদিত সংগঠনগুলো সব রাজ্যেই সেদিন প্রতিবাদ সংগঠিত করে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পিছনের দরজা দিয়ে আরএসএস-এর হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণাকে ঢোকানোর একটা প্রয়াস ছাড়া অন্য কিছু নয়। পাটনায় সংগঠিত প্রতিবাদে বক্তারা প্রশ্ন তোলেন—এই বিল কেন প্রতিবেশি দেশগুলোর নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের তার আওতা থেকে বাদ দিয়েছে—যেমন, মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান, শ্রীলঙ্কার তামিল এবং তিব্বতের বৌদ্ধ অথবা উইঘুর মুসলিম? বাংলাদেশের নাস্তিক যুক্তিবাদীদের মতো রাজনৈতিক গোষ্ঠীও ঐ বিলে ঠাঁই পায়নি কেন যাঁদের অনেকেই মুসলিম? শরণার্থীদের সংজ্ঞা নির্ধারণে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং জাতীয়তার ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের বেছে নিয়ে দেশের সংবিধানের লঙ্ঘন করা হল কেন? বিলকে কেবলমাত্র আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টানদের মধ্যেই সীমিত রাখা হল কেন?

শরণার্থীদের এবং নির্যাতিত সম্প্রদায়গুলিকে সুবিধা দেওয়াটা ক্যাব-এর লক্ষ্য নয়। ভারতীয় নাগরিকত্বের আওতা থেকে মুসলিমদের বাদ দেওয়াটাই এর আসল লক্ষ্য। ক্যাব-এর আওতা থেকে মুসলিমদের বাদ দেওয়ার পিছনে এছাড়া অন্য কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। মোদী-শাহ জুটি মনে করে যে ক্যাবকে কাজে লাগিয়ে তারা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে ভাঙ্গতে পারবে, এবং তারা হিন্দুদের এই আশ্বাস দিচ্ছে যে, তারা এনআরসি থেকে বাদ পড়লেও ক্যাব তাদের সুরক্ষা দেবে। এটাও কিন্তু সাম্প্রদায়িক অভিপ্রায় প্রসূত মিথ্যা।

এনআরসি থেকে দরিদ্ররা বাদ পড়বে এমন সম্ভাবনা প্রবল। তারা যে দরিদ্র সে কথা প্রমাণ করার সামর্থ্যও দরিদ্রদের থাকে না আর তাই বিপিএল তালিকা থেকে তারা বাদ পড়ে যায়। তাদের পূর্বপুরুষরা ১৯৫১ সালে এ দেশের নাগরিক ছিল সেটা প্রমাণ করার মতো নথিও তারা জোগাড় করতে পারে না। ভারতীয়দের রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার বিপদ এনআরসি-র মধ্যে রয়েছে। এনআরসি/ক্যাব যে বিপর্যয়ের সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসছে তার সঙ্গে মোদী সৃষ্ট নোটবন্দি বিপর্যয়ের তুলনা করা যায়। নোটবন্দি কালো টাকাকে নির্মূল করবে বলে দাবি করা হয়েছিল। আসল সত্যিটা হল, নির্বাচনী বণ্ডের মাধ্যমে কালো টাকা বিজেপির তহবিল ভরাচ্ছে! নোটবন্দি বড় অঙ্কের নোট বাতিল করে ভারতীয় অর্থনীতির সর্বনাশ ঘটিয়েছিল। একই ভাবে এনআরসি/ক্যাব ভারতীয়দের নাগরিকত্বকে বাতিল করে ভারতের সংবিধানের বিপর্যয় ঘটাবে। “অবৈধ অভিবাসীদের” জন্য ভারতবাসীরা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এমন কোনো প্রমাণ কিন্তু নেই। নথি ছাড়াই ভালো সংখ্যক অভিবাসীর ভারতে ঢোকার ঘটনা ঘটেছে না। ভারতীয়রা আজ যে কর্মহীনতা ও বঞ্চনা ভোগ করছেন তা অভিবাসীদের কারণে নয়, তার পিছনে মূল কারণ হল অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং সমাজ ক্ষেত্রে মোদী-শাহ সরকার সৃষ্ট বিপর্যয়।

বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত প্রতিবাদে বক্তারা এনআরসি এবং ক্যাব-এর মাধ্যমে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের উপর সার্বিক আক্রমণকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধের আহ্বান জানান।

খণ্ড-26
সংখ্যা-41