নাগরিকত্ব আইন : প্রতিবেশি দেশে সংখ্যালঘু চিত্র নিয়ে ভারতের দাবি কতটুকু সত্যি

ভারত সরকার তার পার্শ্ববর্তী তিনটি দেশ থেকে আসা অমুসলিম, যারা অবৈধভাবে ভারতে এসেছে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য একটি আইন পাশ করেছে যা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে।

হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যারা অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী তারা নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন।

তবে তাদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশ, পাকিস্তান কিংবা আফগান বংশোদ্ভূত।

ভারত সরকারের যুক্তি যে এসব দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমছে, কারণ তারা তাদের ধর্ম বিশ্বাসের কারণে আক্রান্ত হচ্ছেন।

কিন্তু এই আইনটিকে বৈষম্যমূলক বলে সমালোচনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এতে সব সংখ্যালঘুকে নাগরিকত্বের সুযোগের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

ভারতের প্রতিবেশি দেশগুলোতে সংখ্যালঘুদের অবস্থা আসলে কেমন?

অমুসলিমদের সংখ্যা কত?

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, পাকিস্তানের অমুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৯৫১ সাল থেকে নাটকীয়ভাবে কমে গেছে।

কারণ ১৯৪৭ এর পর থেকেই পাকিস্তান থেকে অমুসলিমদের ব্যাপক অভিবাসন হয়েছে ভারতে।

মিস্টার শাহ বলেন, ১৯৫১ সালে পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছিলো জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ, যা তার মতে নির্যাতন নিপীড়নের কারণে আরও কমেছে।

কিন্তু মিস্টার শাহের দেওয়া সংখ্যা চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত কারণ এটি সঠিক নয়। যে পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে, তা ছিল তখনকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে।

বরং আদম শুমারি বলছে পশ্চিম পাকিস্তানের হিন্দু জনগোষ্ঠী সংখ্যা খুব বেশি পরিবর্তিত হয়নি।

তবে আদম শুমারি অনুযায়ী ১৯৫১ সালের তুলনায় বাংলাদেশের অমুসলিম জনসংখ্যা অনেকটাই কমেছে।

১৯৫১ সালে ২২ বা ২৩ শতাংশের জায়গায় ২০১১ সালে সেটি এখন মোট জনসংখ্যার আট শতাংশের মতো।

সুতরাং বাংলাদেশে অমুসলিম জনগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও পাকিস্তানে এই হ্রাসের হার কম ও কিছুটা স্থিতিশীল।

পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে আরও অমুসলিম সংখ্যালঘু আছে - যেমন খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, পার্সি।

পাকিস্তানে আহমদিয়ারাও আছেন যাদেরকে ১৯৭০-এর দশকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়েছে এবং দেশটিতে তাদের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। ফলে আহমদিয়ারাই পাকিস্তানে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

আফগানিস্তানে হিন্দু, শিখ, বাহাই এবং খ্রিস্টান সহ সংখ্যালঘুদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর শূন্য দশমিক তিন শতাংশ মাত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিসেব মতে, ২০১৮ সালে মাত্র সাতশো’ শিখ ও হিন্দু আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে সংঘাতের কারণে।

অমুসলিমদের সরকারি মর্যাদা কেমন?

ভারত সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধন বিলে বলা হয়েছে, “পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের সংবিধানে একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রধর্ম আছে। ফলে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অনেকে ধর্ম বিশ্বাসের কারণে নিপীড়নের শিকার হন”।

এটা সত্যি যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং আফগানিস্তানও একটি ইসলামিক রাষ্ট্র।

তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কিছুটা জটিল।

দেশটি ১৯৭১ সালে আবির্ভূত হয়েছিলো ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধান নিয়ে। কিন্তু ১৯৮৮ সালে ইসলামকে করা হয় রাষ্ট্রধর্ম।

একটি দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০১৬ সালে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখার কথা বলেছে।

যদিও তিনটি দেশের সংবিধানেই অমুসলিমদের সব অধিকার ও বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মচর্চার অধিকারের কথা বলা হয়েছে।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ পদও পেয়েছেন, যার মধ্যে প্রধান বিচারপতির পদও রয়েছে।

সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে?

বাস্তবে অমুসলিম সংখ্যালঘুরা বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ব্লাসফেমি আইনের কথা উল্লেখ করে বলছে যে আইনটি সুনির্দিষ্ট নয় এবং পুলিশ ও বিচারবিভাগ প্রায়ই এটি প্রয়োগ করে, যার ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হন।

ভারতে গিয়েছেন এমন পাকিস্তানী হিন্দুদের কয়েকজন সাম্প্রতিক কালে বিবিসিকে বলছেন যে তারা সামাজিক ও ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হন, বিশেষ করে সিন্ধু প্রদেশে হিন্দু মেয়েদের টার্গেট করে হয়রানি করা হয়।

কিন্তু এটাও সত্যি যে ভারতের নাগরিকত্ব বিলে আহমদিয়াদের রাখা হয়নি। যদিও এরা মুসলিমদের দ্বারা বৈষম্যের শিকার হন বলে অভিযোগ আছে।

২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্লাসফেমি আইনে বেশি মামলা হয়েছে মুসলিম ও আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে - হিন্দু বা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে নয়।

বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী কমে যাওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে তাদের বাড়িঘর বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। কখনো আবার তাদের সম্পদ দখলের জন্য তাদের জোর করে বাড়িঘর ত্যাগ করতে বাধ্য করার চেষ্টা হয়েছে।

হিন্দুরা অনেক সময় ধর্মীয় জঙ্গিদেরও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

তবে বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের বিষয়ে ভারতের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বিবিসিকে বলেছেন, “সংখ্যালঘু নির্যাতনের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে নেই”।

জাতিসংঘের ডেটা বলছে, ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে ২০১৬-১৯ সালে ১৭ শতাংশ হয়েছে। চলতি বছর অগাস্টে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থায় তালিকাবদ্ধ শরণার্থীদের বড় অংশ এসেছে তিব্বত ও শ্রীলংকা থেকে।

(বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন)

খণ্ড-26
সংখ্যা-41