অ্যাপোয়া মনে করে ভারতীয় সমাজে সাধারণ নারী দু’ধরনের শোষণ ও বৈষম্যের শিকার—একজন মহিলা হিসেবে এবং একজন নাগরিক হিসেবে। তাই নারীসম্পর্কিত বিশেষ সমস্যাগুলির মোকাবিলার জন্য একটি স্বশাসিত মহিলা আন্দোলনের প্রয়োজন আছে। ‘‘সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি” এই আন্দোলনের নাম। এই সংগঠন সারা দেশে ২৫টিরও বেশি রাজ্যে ৪ লক্ষ সদস্য নিয়ে সক্রিয়। এটি নারী সমাজের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খাগুলির প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার—এই আন্দোলন পুরুষ-বিরোধী নয়, বরং পিতৃতান্ত্রিক সামন্তী চিন্তাধারা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার লড়াই। প্রগতিশীল চিন্তার পুরুষরা এই লড়াইয়ের সাথী।
আমরা লক্ষ্য করছি, পুঁজিবাদী দলগুলো নারীর দেহ ও শ্রমের উপর শোষণ জারি রাখার উদ্দেশ্যে, পিতৃতন্ত্রকে সযত্নে লালন করে যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ শুধু যে তাকে উৎসাহ যোগাচ্ছে তাই নয়,নারীকে মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য অবৈজ্ঞানিক সমস্ত ক্রিয়াকর্ম আচার অনুষ্ঠান-ধর্মীয় আচার, কুসংস্কারের অনুশীলন, জাদু, ডাইনিবিদ্যা—এসব কিছুকেও মদত দিয়ে চলেছে।
আজ বিজ্ঞানের যুগে, এ সবকিছুর মধ্যেই নিহিত রয়েছে কুসংস্কারের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জালের উপকেন্দ্রটি যার আগ্রাসন ও ব্যাপকতা শক্তি বাড়াচ্ছে সংস্কৃতি ও ‘সংস্কারের’ নামে। এই আখ্যানে দুঃখের বিষয়টি হল, বেশ কিছু মহিলাও এর মধ্যে সামিল রয়েছেন যারা পুঁজিবাদী ধ্যানধারণা, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের প্রভাবে নারী সমাজের সচেতনতা ও বিচারবোধকে গুলিয়ে দিতে বি-রাজনীতিকরণ করছেন। এসব সত্ত্বেও, আমরা দেখছি সারা দেশ জুড়ে মহিলারা সমস্ত ধরনের শোষণ ও দমন থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করে চলেছেন। এই দশকের শুরুতে নির্ভয়া আন্দোলন নারীর জন্য কয়েকটি আইনী অধিকারই শুধু ছিনিয়ে আনেনি, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নারী আন্দোলনকে এক নতুন শক্তিও যুগিয়েছে। তবে রাষ্ট্র মহিলাদের বিরুদ্ধে যৌন হিংসার মামলায় অভিযুক্তদের আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কাঠুয়ার আসিফা, উন্নাও, বিহারের মজফ্ফরপুরের কন্যাশ্রম, উত্তর প্রদেশের সাংসদ স্বামী চিন্ময়ানন্দের ঘটনাগুলো আমাদের সামনে আছে। কিন্তু নারী সংগঠনগুলির জোরালো বিরোধিতার মুখে রাষ্ট্র পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছ।
আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, রন্ধনকর্মী, সাফাইকর্মী, অ্যাপসকর্মী প্রভৃতি শ্রমজীবী মহিলাদের আন্দোলন কেরালার মুন্নার ও কর্ণাটকের ব্যাঙ্গালোর সহ সারা দেশে এক তীব্র লড়াই গড়ে তুলেছিল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা হোস্টেলের সময় বেঁধে দেওয়ার বিরুদ্ধে “খাঁচা ভাঙো” আন্দোলন করে এবং বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও নিজেদের দাবি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে। অ্যাপোয়া এই সমস্ত আন্দোলনে সক্রিয় ছিল এবং দেশের সমস্ত প্রতিবাদী আন্দোলনে বলিষ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে, পাশে থেকেছে।
অ্যাপোয়ার লক্ষ্য নারী সমাজকে পিতৃতন্ত্রের দাসত্ব থেকে মুক্ত করা এবং তাদের একটি বৈজ্ঞানিক বিপ্লবী গণতন্ত্রের আদর্শে সংগঠিত করা। এটা আমাদের বিশ্বাস যে,বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, নারী এবং সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ন্যায় বিচার ও সাম্যের অধিকার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা একটি বিকল্প ন্যায়সঙ্গত, গণতান্ত্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়বো। অ্যাপোয়া এমন একটি সমাজ জীবন গড়ার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছে যেখানে নারী লিঙ্গ ও জাতভিত্তিক সমস্ত বৈষম্য এবং সামন্তী অবশেষ থেকে মুক্ত হবে এবং ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচিত হবে।
অ্যাপোয়ার অষ্টম জাতীয় সম্মেলন এমন একটা কঠিন সময়ে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে যখন মহিলারা মজুরি-মর্যাদার লড়াই লড়ে চলেছেন। পুঁজি, ধর্মীয় কর্তৃত্ব এবং সামন্তী ভাবনার ধারকবাহকদের অশুভ আঁতাত নারীর প্রকৃত দাবি ও অধিকারগুলিকে নির্মমভাবে পিষে চলেছে। নারীর উপর শোষণ-অত্যাচারের জন্য তাদেরই দায়ী করা হচ্ছে আর অন্যদিকে অপরাধীদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের নামে ব্যাপক হৈচৈ জুড়ে তাদের অনুকূলে তৈরি হওয়া আইনগুলিকে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে ধর্ষণ, ডাইনি অপবাদ, কন্যা-শিশু হত্যা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, পণ এবং ‘সম্মানরক্ষার্থে’ হত্যার মতো নারীর প্রতি ক্রমাগত বেড়ে চলা অপরাধই আজ প্রকৃত বাস্তবতা প্রতিনিয়ত যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের। স্কুল কলেজ কর্মস্থলে নারীর যৌন হেনস্থা ও তাদের প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদকে সমর্থনের নামে আমদানি করা হচ্ছে শয়তানি যুক্তির এবং বিকৃত পদ্ধতির। মহিলাদের পছন্দের অধিকার এবং একটি স্বাধীন রাজনৈতিক জীবনের দাবিকে সমস্তরকম চক্রান্তের মাধ্যমে ধ্বস্ত করা হচ্ছে, বাধা দেওয়া হচ্ছে।
বর্তমানে সরকার কর্পোরেটদের স্বার্থে শ্রম আইন পরিবর্তন করে শ্রমিকদের উপর শোষণকে অনুমোদন করছে। মহিলাদের অসংগঠিত ক্ষেত্রে ঠেলে দিয়ে সম্মানদক্ষিণার নামে নির্মম শোষণ করা হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন করার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো প্রাথমিক পরিষেবাগুলোর ব্যয়বরাদ্দ ছেঁটে ফেলে সেগুলো বেসরকারি হাতে বেচে দেওয়া হচ্ছে। নারীর সাম্য ও স্বাধীনতার প্রশ্নগুলিকে নেপথ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, পুঁজিপতিদের আরও ধনী করে তোলা হচ্ছে। তার পরিণতিতে উদ্ভূত অর্থনৈতিক মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির বোঝায় সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে, মহিলাদের অবস্থা আরও করুণ। আর তাই মহিলাদের অ্যাপোয়া-র মতো বিপ্লবী সংগঠনের পতাকাতলে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে যে সংগঠনটি বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং কর্পোরেট-লুঠের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইকে ক্রমশ শক্তিশালী করে তুলছে।
রাজস্থান যেখানে সামন্ততান্ত্রিক দলগুলো এবং তাদের মূল্যবোধের শিকড় এখনও সমাজের গভীরে প্রোথিত, সেখানে মহিলারা বিশেষ করে দলিত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মহিলারা রাষ্ট্র, পুলিশ এবং প্রশাসনের শোষণের শিকার; কর্মসংস্থান ও ত্রাণ কাজের ক্ষেত্রেও সমানাধিকারের প্রশ্নে তাদের প্রতি বৈষম্য ঘটেই চলেছে। রাজ্যে মহিলাদের প্রতি বেড়ে চলা অপরাধ দেখিয়ে দেয় যে সামন্ততান্ত্রিক ভাবনার ধারক বাহকেরা নারীর ক্রমবর্ধমান সচেতনতাকে দমন করতে, চেপে রাখতে চায়। সুতরাং মহিলাদের ক্ষেত্রে সমাজের নারীবিদ্বেষী মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো এবং তাদের সমানাধিকার, জীবিকা, নিরাপত্তা এবং মর্যাদার প্রশ্নগুলি জোরালোভাবে তুলে ধরা বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। আসুন, আমরা সমস্ত শক্তিকে সংহত করে ঐক্যবদ্ধ হই আর তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য এক দৃঢ়পণ সংগ্রাম গড়ে তুলি। আসুন, সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে অষ্টম জাতীয় সম্মেলনকে চূড়ান্ত সফল করে তুলি!
মহিলা ঐক্য দীর্ঘজীবী হোক!
পিতৃতন্ত্র নিপাত যাক!
সর্বভারতীয় সভানেত্রী : রতি রাও (কর্ণাটক)
সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদিকা : মীনা তেওয়ারি (পাটনা)
সর্বভারতীয় সম্পাদিকা : কবিতা কৃষ্ণাণ (নয়া দিল্লি)