রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় মাঝেমধ্যেই সংবাদ মাধ্যমে বেশ খবর হচ্ছেন। তার উপলক্ষ হরেক, তবে মোদ্দা ইস্যু একটিই, ‘রাজ্যপাল-রাজ্য সরকার সংঘাত’। ইস্যুটা পাকিয়ে তুলেছেন রাজ্যপাল, স্বভাবতই কেন্দ্রীয় চরিত্র তিনিই। একথার অর্থ এই নয় যে, পরোক্ষে এ বঙ্গের রাজ্য সরকারের হয়ে ঢাল ধরা। বরং প্রয়োজন ন্যূনতম যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে নানা মারপ্যাঁচে নিয়ন্ত্রণ করার কেন্দ্রের মোদী মহড়াটি, পরন্তু পরোক্ষে রাজ্য বিজেপির বাজার তৈরির ধরনটি বোঝার চেষ্টা করা, বিরোধিতা করা।
রাজ্যপাল প্রায়শই মুখ খুলছেন তাঁর পদমর্যাদাকে এখানে সরকারিভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, উল্টে অবমাননা করা হচ্ছে। তাঁকে সরকারি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়না, ক্বচিৎ যদিও বা নিমন্ত্রণ করা হয়েছে তবু শোভনসুন্দর আপ্যায়ন করা, প্রচার করা হয়নি। তাঁর কথা হল, এভাবে তাঁকে থামানো যাবে না, তিনি যা করে চলেছেন তা রাজ্যপালের এক্তিয়ার বহির্ভূত নয়, বরং পদাধিকার অনুসারে রীতিনীতি সম্মত। এখানে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী সহ শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য লোকজন তাঁর কাছে আসেন নালিশ করতে । তাদের অভিযোগ রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে। অভিযোগের বক্তব্য হল, তাদের ব্যক্তি পরিসরের নিজস্বতার ওপর গোপন নজরদারি চালানো হচ্ছে, তাদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, তাদের বিভিন্ন ব্যাপারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে, মাতব্বরি ফলানো হচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানকে কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে দেওয়া উচিত, তিনি ‘বিগ বস্’-র মতো কাজ করছেন না, রাজ্য সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসেননি। এভাবে তিনি বাধিয়েছেন আরও অনেক হৈচৈ।
বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখা রাজ্যপালেরই পক্ষে কথা বলছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ধনখড়জীকে নিযুক্ত করেছে বিজেপির কেন্দ্রের তরফ, রাজ্যপাল নেমেছেন সেই অভিপ্রায় পূরণের ভূমিকায়, দলের রাজ্য তরফ সেই সুরেই কথা বলছে, এই কালচার-ভালচার প্রয়োগ করছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে শুধু নয়, যে রাজ্যে দলকে ক্ষমতায় আনতে মরীয়া হতে হয়েছে বা দলের ক্ষমতায় ফেরা অনিশ্চিত টলমল হয়েছে সেখানেই বিজেপি অঘোষিত হাতিয়ার করেছে রাজ্যপালকে। এর পূর্ব নজির লক্ষ করা গেছে বিগত বাম শাসনাধীন ত্রিপুরায়, এখন লক্ষণীয় মহারাষ্ট্র।
এরাজ্যে রাজ্যপাল হস্তক্ষেপের নামে বিজেপির হয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন এমন অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু একে এর বেশি কেউ কোনো ‘বিশেষ’ তকমা দেয়নি। তবু তিনি নিজেই নিজেকে সেটা সেঁটে দিলেন — বলে ফেললেন, ‘আমি বিগ বস্ হওয়ার লড়াইয়ে নেই’। অন্যায় করে চলা মতিগতি, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল বাস্তবে যা করে চলছেন সেটাই। তাঁর হয়ে আক্রমণাত্মক হলেন বিজেপির রাজ্য সম্পাদক সহ আগুনখোর নেতৃবৃন্দ। তাদের দাবি, রাজ্যপাল যেহেতু মন্ত্রীদের শপথ পাঠ করানোর অধিকারী, অতএব তিনি রাজ্যের ‘সাংবিধানিক প্রধান’! অবাক কথা! তা হবেন কেন? সংবিধান মতে, রাজ্যপাল পদটি হল মূলত আলংকারিক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার অঙ্গীভূত এই পদভারের বোঝাটি স্বাধীনতার সত্তর বছর ধরে চাপিয়ে রেখে চলছে এদেশের শাসকশ্রেণীগুলি। এই খাতে বহন করতে হয় জগদ্দল পাথরের মতো এক বিশাল পরিমাণ আর্থিক ব্যয় ভার। পদটি বহিরঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য ব্যবহারের, অন্তরঙ্গে ব্যবহৃত হয়ে আসছে কেন্দ্রে যে দল শাসন ক্ষমতায় থাকে তার স্বার্থে, তার অবসরপ্রাপ্ত নেতাদের পুরষ্কৃত করা ও রাজ্যে বিরোধী দল থাকলে তার বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়ার যন্ত্র হিসাবে। এ সংঘাত চরমে ওঠা এরাজ্যের অভিজ্ঞতায় নতুন নয়। গত শতকের ষাটের দশকে যুক্তফ্রন্ট আমলে রাজ্যপাল ধরমবীর ও পরবর্তীতে ধাওয়ানের ছড়ি ঘোড়ানোর ইতিহাস ভোলার নয়। তারপর দীর্ঘকাল বাদে ‘নিয়মের’ একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে নজর কেড়েছিল বামফ্রন্ট আমলে সিঙ্গুর আন্দোলন পর্বে রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর ভূমিকা। গোপালকৃষ্ণ কেন্দ্রের তাঁর নিয়োগ কর্তৃপক্ষের হয়ে কোন বিষয়ে নয়, সিঙ্গুর অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে রাজ্যের তদানীন্তন শাসক ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে এক সমঝোতা বৈঠকে বসতে সময়োপযোগী উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও রাজ্যপাল পদের কেন্দ্রাভিমুখী স্বার্থসর্বস্ব ব্যবহারিক রীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
রাজ্যপাল ধনখড় ঘটা করে ‘সংবিধান দিবস পালন’ করছেন! কিন্তু এই পদের যে সাংবিধানিক বিকৃত ব্যাখ্যা রাজ্যের তালেবর বিজেপি নেতারা করছেন তা নিয়ে রাজ্যপালের কোনও উষ্মা নেই! এই নীরবতা কি নিছকই! শুধু রাজ্যপাল নয়, সংঘ পরিবার থেকে আসার প্রেক্ষাপট থাকা রাষ্ট্রপতিও, যার নির্দেশে রাজ্যে রাজ্যে চালু হয়েছে ‘সংবিধান দিবস পালনে’র নয়া প্রথা, তিনিও রাজ্যপাল পদের অতিকায় হয়ে ওঠার অনাচার দেখেও না দেখার ভান করে চলছেন। রাজ্যপাল এখানে গতিবিধির সীমারেখা ছাড়াচ্ছেন, খেয়াল খুশী মতো ইস্যুতে ঢুকে পড়ছেন, প্রশাসনিক অফিসারদের তলব করছেন। কেন্দ্রের ‘আয়ুষ্মান প্রকল্প’ রূপায়ণের প্রচার-প্রসারে রাজ্যের অসহযোগিতা, রাজ্যের ‘স্বাস্থ্য সাথী’ প্রকল্পের নামে জটিলতা সৃষ্টি, অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধিকারে রাজ্য সরকার ও শাসকদল তৃণমূলের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ ইত্যাদি দূর করার নামে। এইসমস্ত জটজটিলতা বিজেপির ভাষ্য বা ছক অনুযায়ী ধরে নেওয়ার না হলেও অনেকাংশেই বাস্তব। আর এসব নিয়ে হস্তক্ষেপ করার গণতন্ত্র ও আইনসম্মত অধিকারী একমাত্র জনগণ, নাগরিক সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক-কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত ব্যবস্থা, কোনোমতেই এসব রাজ্যপালের এক্তিয়ারের বিষয় নয়। ‘পাঁচ হাজার অভিযোগ পাওয়ার’ অজুহাত দেখালেও নয়। রাজ্যপাল কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যেকার বিরোধ মেটাতে আগ্রহী হলে মেটান, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয়তার অবশেষ নিকেশ করা চলতে দেওয়া যায় না। প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্ততার ব্যাপারে দরদ দেখাচ্ছেন! যাদবপুরে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেটে পড়া ছাত্র-বিক্ষোভের পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো ‘আচার্য’ রাজ্যপালকে ডাকেননি। তা সত্বেও তিনি সেখানে জোরজবরদস্তি গিয়েছিলেন ক্ষমতা ফলাতে, বিজেপির মন্ত্রীকে পরিত্রাণ দিতে, তাঁর মুখে একবারও শোনা যায়নি ছাত্রী-ছাত্রদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রীর অশালীন উক্তি সম্পর্কে এতটুকু নিন্দা-মন্দ। যত সব ভন্ডামী দেখাচ্ছেন ‘নৈতিকতা’র! আর সেই আবরণে সাফাই দিচ্ছেন লক্ষণরেখা লংঘনের।
রাজ্যপাল এবং রাজ্য সরকারের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করার নামে শুরু হয়েছে একধরনের অর্থহীন নির্লজ্জ সুবিধাবাদী ‘বাম-কংগ্রেস’ কৌশল। এদের দাবিসনদে থাকে যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে ভাঙার মোদী-শাহ মার্কা ফ্যাসিবাদী শলার কথা, কিন্তু বাংলায় ঘনায়মান ফ্যাসিবাদী বিপদের মুখে ব্যবহারিক রাজনীতিতে এদের কি দেউলেপনা! কংগ্রেস সদর দপ্তর বিধান ভবন আক্রান্ত হল বিজেপির আক্রমণে, অথচ কংগ্রেস বিচলিত ভাব প্রকাশ করে বসল রাজ্যপালের প্রতি অসৌজন্য প্রদর্শন হচ্ছে অভিযোগ তুলে! একবারও ভেবে দেখছে না বিজেপির নির্দিষ্ট ভাষ্যের সাথে কোনো ফারাক থাকছে কি থাকছে না। ফলাফলটা যাচ্ছে কার অনুকূলে! এই হচ্ছে কংগ্রেস কালচার। অযোধ্যা রায়ের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের বেলায়ও তো দেখা গেল কংগ্রেসের গৃহীত অবস্থানটি কত বেশরমের। আর পশ্চিমবঙ্গের প্রথাগত বামেরা বিজেপি-তৃণমূল যে কোনো সংঘাতের মধ্যে তো কেবল দূর্বোধ্য ‘গট-আপ’ বোঝাতে চায়! রাজ্যপালের সঙ্গে বিরোধ উপলক্ষেও একই ভূত দেখাচ্ছে। ভাবের ঘরে কি দূর্দশা!
রাজ্যপাল পদটি সাংবিধানিক প্রথা হিসেবে যখন রয়েছে, তখন সাধারণ মানুষ অভাব-অভিযোগ জানালে রাজ্যপাল শুনবেন বৈকী, শুধুমাত্র রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রতি গুরুত্ব দিলে চলবে না, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকেও ততোধিক গুরুত্ব দিতে হবে। শুধুমাত্র রাজ্যের ‘স্বাস্থ্য সাথী’ প্রকল্পের ক্ষেত্রে অবহেলা ও দুর্নীতি জড়িত স্বাস্থ্যহানি নিয়ে নয়, কেন্দ্রের ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প রূপায়ণ নিয়েও মোদী সরকারের ব্যর্থতা, একতরফা বিজ্ঞাপনী আত্মপ্রচার ও দুর্নীতিকে নিয়ে আরও বেশি সরব হওয়া উচিত। সাধারণভাবে কেন্দ্র-রাজ্য যে স্তরের সরকারের উদ্দেশ্যে যা বক্তব্য তা যথাস্থানে পাঠিয়ে দেওয়ায় সংযত থাকাই বিধেয়, তা যথেষ্ট কার্যকরী মনে না হলে সরকারপক্ষকে ক্রমাগত তাগাদা দেওয়া যেতে পারে। এর বেশি বাড়াবাড়ি বা কেন্দ্রের হয়ে ‘দাদাগিরি’ আদপেই বরদাস্ত করার নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয়তার রীতিনীতিকে পদদলিত করে পরোক্ষে কেন্দ্রের ও রাজ্যের বিজেপির হয়ে রাজ্যপালের রাজনীতি, অথবা রাজ্যপালকে ব্যবহার করে কেন্দ্রের বা রাজ্যের বিজেপির রাজনীতি — কোনোটাই চলতে দেওয়া যায় না।