সম্পাদকীয়
প্রজ্ঞা পুনর্বাসিত প্রতিরক্ষা প্যানেলে!

মোদী জমানায় সবই সম্ভব। প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা প্যানেলের সদস্য করা হল। ২১ সদস্যের প্রতিরক্ষা প্যানেলে প্রহসনই লাগছে। রাখা হয়েছে এমনকি কাশ্মীরে গৃহবন্দী করে রাখা ফারুখ আবদুল্লাকে! ‘প্রজ্ঞা’ এযাবৎ যা ‘কীর্তি’ স্থাপন করেছেন তাতে প্রতিভাত হয় তার ঐ নামকরণ যেন বিদ্রূপাত্মক।

কে এই প্রজ্ঞা? দল থেকে তাকে বোধহয় ‘শুদ্ধ চেতনা’য় চেনাতেই চালু করা হয় ‘সাধ্বী প্রজ্ঞা’ সম্বোধন। কি তার বেড়ে ওঠার পরিচয়? তিনি কুখ্যাতি কুড়িয়েছেন ২০০৮ সালে মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় জড়িত ও গ্রেপ্তার হয়ে। তার আগে ২০০৭ সালে তিনি অভিযুক্ত হন আরএসএস সদস্য সুনীল যোশী হত্যাকান্ড মামলায়। যে মামলা লাগু হয় ‘মকোকা’ আইনানুসারে, বলবৎ হয় তার বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারাও।

প্রজ্ঞার জন্ম এক কট্টর আরএসএস অনুগামী পরিবারে। তার বাবা ছিলেন আরএসএস সদস্য এক আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। বাবার কাছে সংঘ মতাদর্শ ও রাজনীতির হাতে খড়ি হওয়ার পরে প্রথমে ছাত্রাবস্থায় হন এবিভিপি সদস্য, পাশাপাশি ভিএইচপি-র মহিলা শাখার নেত্রী। ২০০২ সাল নাগাদ সংঘ পরিবারভুক্ত অগ্রজ স্বামী অবধেশানন্দের প্রভাবিত হয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ। হলেন কেমন সন্ন্যাসিনী? পাঁচ বছর বাদে প্রথমবার দেশবাসী তাকে চেনে সংঘ কর্মী সুনীল যোশী খুনে অভিযুক্ত হওয়ার খবরে। তার পরের বছরেই কুখ্যাতি ছড়ায় কুখ্যাত মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায়। ঐ মামলায় মোট আটজন আসামী হওয়ার মধ্যে ছিলেন শ্রীকান্ত পুরোহিত নামে এক লেফটেনান্ট কর্ণেলও। মামলার দায়িত্ব বর্তায় মুম্বাই অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াডের ভারপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার ও মুম্বাইয়ে পাক সন্ত্রাসবাদী হামলার মোকাবিলা করাকালীন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া হেমন্ত কারকারে। মালেগাঁও মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার একমাসের মধ্যেই প্রজ্ঞা স্কোয়াডকে কারকারে কারাগারে ঢুকিয়ে দেন। প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড়ায় তিনিই ছিলেন বিস্ফোরণ ঘটানোর পেছনে মূল মাথা।

দীর্ঘ কারাবাসের পর প্রজ্ঞা জামিনে বেরিয়ে আসেন ২০১৭-তে। আর ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তাকে প্রার্থী করে মধ্যপ্রদেশের ভোপাল কেন্দ্রে। নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তিনি হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, জিতবেন এবং বদলা যা নেওয়ার নেবেন। নির্বাচনী প্রচারে প্রকাশ্যে বলেছিলেন ‘কর্মফলের কারণেই মৃত্যু হয়েছে হেমন্ত কারকারের। কারকারে পরিবার শেষ হয়ে যাবে।’ নির্বাচন কমিশন, সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চ ছিল ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে। পরে প্রজ্ঞার মন্তব্যের সূত্র ধরে সুপ্রীম কোর্টে পিটিশন দায়ের হয় নতুন করে আদেশ দেওয়া হোক হেমন্ত হত্যার কারণ অনুসন্ধানে। কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট একবাক্যে ঐ পিটিশন খারিজ করে দেয়। অজুহাত দেখায় যেহেতু পাকিস্তানী আসামী কাসভের ফাঁসি হয়ে গেছে তাই হেমন্ত কারকারে হত্যা মামলা নতুন করে আর শুরু করা হবে না। অথচ শ্রীমতী কারকারেরও জোরালো সন্দেহ ছিল হেমন্ত কারকারের মৃত্যু হয়েছে অজ্ঞাত অন্তর্ঘাতে। সেই আবেদনের কোনো মানবিক প্রত্যুত্তর সুপ্রীম কোর্ট দিল না। আর বিজেপিরও মওকা মিলে গেল প্রজ্ঞাকে ‘সাফসুতরো’ দেখানোর। মাথার ওপর হাত পেয়ে সন্ন্যাসিনী হতে থাকেন আরও দুঃসাহসিনী। নির্বাচনী প্রচারে বলেন, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর হত্যাকারী আরএসএস-এর নাথুরাম গডসে ছিলেন ‘দেশপ্রেমিক’! মোদী তখন গান্ধীর প্রভাবকে ব্যবহার করার ধূর্তামি শুরু করে দেন, গান্ধীর আদলে নিজের চোখে চশমা চড়িয়ে। এমন সময়ে প্রজ্ঞার গডসে প্রশংসা মোদীকে অপ্রস্তুত করে দেয়। তবু যেহেতু সংঘ পরিবারের লক্ষ্য হল সমস্ত পরিচালন কাঠামোর সর্বস্তরে সংঘীকরণ, তাই যত কুখ্যাতই হোক, লোকদেখানো কিঞ্চিৎ আক্ষেপ প্রকাশ করে মোদীভাই-মোটাভাইরা প্রজ্ঞাকে তুলে আনলেন একেবারে প্রতিরক্ষা বিভাগের প্যানেলে! এভাবে পুনর্বাসন দিয়ে বস্তুত পুরষ্কৃতই করা হল। এরপর মালেগাঁও বিচারের পরিণতি কি হবে তাতে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যাবে। ঠিক যেভাবে আজও বাবরি মসজিদ ধ‌বংসকারী বিজেপি-ভিএইচপি-বজরং দলের অপরাধীদের শাস্তি হয়নি। সাজা হয়নি গুজরাট সংখ্যালঘু হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের। তাই নয় কি?

খণ্ড-26
সংখ্যা-38