স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদির বক্তৃতা দ্বিতীয় দফার বিজেপি সরকারের জন্য সঙ্ঘের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী কর্মসূচীর ইঙ্গিত প্রদান করল। এর মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের অভিযানে ছোট পরিবারকে ‘দেশপ্রেমী’ হিসেবে চিহ্নিত করা। প্রধানমন্ত্রী একইসাথে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রে সম্পদের বেসরকারীকরণকে সরকারের হস্তক্ষেপ থেকে জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে পদক্ষেপ, এবং শ্রম ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনগুলিকে অচল বলে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাঁর সরকারের কর্পোরেট-তোষণকারী নীতিগুলিকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য বৃহৎ কোম্পানিগুলিকে ‘‘সম্পদ সৃষ্টিকর্তা” বলে একটি নতুন শিরোপা প্রদান করেছেন।
সারা ভারত জুড়ে স্বাধীনতা দিবসের উৎসব উদযাপিত হচ্ছে বলে মোদি উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ভয়ানক রসিকতা হল যে, তার সরকার সমস্ত কাশ্মীরকে বন্দী করে রেখেছে।
“স্বচ্ছ ভারত” অভিযানের মতো মোদি “অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি”র বিরুদ্ধে এক অভিযানের ডাক দিয়েছেন। এই অভিযান ছোট পরিবারের মাতা-পিতাকে দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক হিসেবে গণ্য করবে। তিনি বলেন, “আমাদের পরিবারে একটি সন্তান আসার আগে আমাদের ভাবতে হবে — আমি কি সন্তানের চাহিদা পরিপূরণে প্রস্তুত? নাকি সেই দায়িত্ব সমাজের উপরে চাপিয়ে দেব?” প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য একগুচ্ছ চিন্তার বিষয় নিয়ে এসেছে।
প্রথমত, দরিদ্র পরিবার বা দেশগুলির কম সন্তান উৎপাদন করা উচিত এই দাবি দরিদ্র এবং শোষিতের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট। সাম্রাজ্যবাদী নীতি নির্ধারকরা সব সময়ই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অপারগতার জন্য দরিদ্র দেশগুলিকে দায়ী করে। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলি ঔপনিবেশিকাতাবাদের জন্যই দরিদ্র হয়েছে — ঔপনিবেশিক দেশগুলিই এখন সম্পদশালী। সুতরাং, অতি জনসংখ্যা নয়, দারিদ্রের কারণ ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন এবং শোষণ। অনুরূপে, ভারতে, দারিদ্র জনসংখ্যা স্ফীতির কারণে নয়, ঘটেছে সম্পদের অসম বন্টনের ফলে। ভারতের সমস্যা জন বিষ্ফোরণ নয়, সমস্যা সম্পদের অসম বন্টন, যেখানে ভারতের উচ্চ সম্পদশালী ১০% মোট জাতীয় সম্পদের ৭৭.৪% এর আর সর্বোচ্চ ধনী ১% মোট জাতীয় সম্পদের ৫১.৫৩% এর মালিক।
ভারতের প্রতিটি শিশুর জন্য খাদ্য, বাসস্থান ও শিক্ষা নিশ্চিত করা অবশ্যই সরকার ও সমাজের দায়। যদি গরিবের সন্তান খাদ্যের অভাবে মারা যায়, যদি তারা বিদ্যালয়ে না গিয়ে শ্রমিকের কাজ করে, যদি চিকিৎসার অভাবে মহামারিতে মারা যায়- এটি তাদের পিতামাতার দোষ নয়, দোষ সরকারের। শ্রীযুক্ত মোদি নিজে ৬ সন্তানের একজন। তাঁর পিতামাতা কি দায়িত্ব জ্ঞানহীন ছিলেন? যদি তা না হয় তাহলে কেন একজন দরিদ্র ভারতীয় পরিবারকে সদস্য সংখ্যাকে সীমাবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে দেশপ্রেমহীন বা দায়িত্ব জ্ঞানহীন বলা হবে?
বহুকাল ধরেই আন্তর্জাতিক তহবিল প্রদানকারী সংস্থাগুলির উপর নির্ভরশীল ভারত সরকারের “জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ” নীতি দরিদ্র নারীদের উপর চরম অত্যাচারী হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ২০১৪ সালে দরিদ্র ও শোষিত জনগোষ্ঠীর একটি বন্ধ্যাকরণ শিবিরে ১৫ জন মহিলা মারা গিয়েছিলেন। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত প্রতি মাসে ১৫ জন মহিলা অনুরূপ বন্ধ্যাকরণ শিবিরে দায়সারা অপারেশনের জন্য মারা গিয়েছেন। মোদির “স্বচ্ছ ভারত” অভিযানের ফলে খোলা মাঠে মলত্যাগের জন্য দরিদ্র ও শোষিত বর্ণ/ জনগোষ্ঠীর মহিলারা গণ টিটকিরি ও হিংসার শিকার হয়েছেন। এখন, “জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ” অভিযান অধিক সংখ্যক সন্তানের জন্মদাত্রী হিসেবে মহিলাদের উপরে হিংসা ও টিটকিরিকে উৎসাহিত করবে।
মোদির দল বিজেপি, এবং আরএসএস-এর জন্য “অতি জনসংখ্যা” হল “বহুসংখ্যক মুসলমান”এর অন্য একটি নাম। ২০০২ সালে গুজরাটে গণহত্যায় আক্রান্ত মুসলমানদের শরণার্থী শিবিরগুলিকে মোদি নিজেই সন্তান উৎপাদনের কারখানা বলেছিলেন। গত মাসে, ১১ জুলাই, ২০১৯, মোদির ক্যাবিনেট মন্ত্রী গিরিরাজ সিং বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে দিল্লিতে একটি সমাবেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের দাবী করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ওই সমাবেশে সভামঞ্চ থেকে হিন্দিতে একটি গান শোনানো হচ্ছিল, যার বাংলা হল, “জন বিষ্ফোরণের জন্য আমাদের স্বাধীনতা সংকটে/ আমরা বিপন্ন “বিশ্বাসঘাতকদের” ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য।” মোদির মন্ত্রী হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাসের বিরুদ্ধে ও মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি রদের দাবিতে আইন প্রণয়নের জন্য খোলা আহ্বান করেছিলেন। মুচি হিসেবে বা সাইকেল সারানোর দোকানে কাজ করলেও বহু শিশুর জন্ম দেওয়ার জন্য গরিব মুসলমানদের সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা দেশপ্রেমহীন ও দায়িত্ব জ্ঞানহীন হিসেবে ঘোষিত করেছিল। মুসলমানদের মানবিক অধিকারকে খর্বিত করার জন্য, এমনকি মুসলমানদের গণহত্যার জন্যও তারা আহ্বান রাখছিল। মোদির “জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ” অভিযান সঙ্ঘী ভিড়কে মুসলমানদের দেশপ্রেমহীন বলে চিহ্নিত করার জন্য উৎসাহিত করার দিকে আরেকটি পদক্ষেপ।
প্রকৃতপক্ষে উচ্চ জনসংখ্যাবৃদ্ধি হার নিরক্ষরতা, বঞ্চনা ও দারিদ্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কেরালার (যেখানে সাক্ষরতা বিশেষত নারী সাক্ষরতার হার বেশি) মতো একটি রাজ্যে মুসলমানদের প্রজনন হার উত্তরপ্রদেশের (যেখানে সাক্ষরতা ও নারী সাক্ষরতার হার কম) মতো রাজ্যের হিন্দুদের প্রজনন হারের থেকে কম। মুসলমান নারীদের সাক্ষরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দুদের থেকে দ্রুত লয়ে কমছে। মুসলমান প্রজনন হার ২.৬, তফশিলী জাতির ২.৫, তফশিলী উপজাতির ২.৩, ওবিসির ২.২ কিন্তু উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও মধ্যপ্রদেশের ৩। এই সমস্ত জনগোষ্ঠী বা রাজ্য সমূহকে সরকার দায়িত্ব জ্ঞানহীন, দেশপ্রেমহীন বা নৈতিকভাবে নিকৃষ্ট হিসেবে ছাপ মেরে দিতে পারে না। বরং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দুর্বল ব্যবস্থার জন্য সরকারকেই দায়ী করতে হবে। দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অনৈতিক ও দেশপ্রেমহীন বলে দেগে দিয়ে দরিদ্রদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করার দায় সরকার ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।
জনজীবনে সরকারি হস্তক্ষেপ কমানোর লক্ষ্যের কথাও মোদি বলেছেন। তিনি গর্ব করে বলেছেন যে গত ৫ বছরে সাধারণ মানুষের অজ্ঞাতসারেই প্রতিদিন তিনি “একটি করে অচল আইনকে বাতিল করে দিয়েছেন” — সবটাই করেছেন “ব্যবসাকে সহজ করার” জন্য। তিনি বলেছেন যে, তার দ্বিতীয় দফার প্রথম ১০ সপ্তাহে “জীবনযাত্রা সহজ করার” লক্ষ্যে ৬০টি আইনকে বাতিল করা হয়েছে।
কী সেই আইন যেগুলি মোদি সরকার প্রত্যহ নিশব্দে বাতিল করছে? এগুলি আসলে শ্রম আইন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন। মোদি যখন বলেন যে জনজীবনে সরকারি হস্তক্ষেপ কমাবেন, তখন তার মানে হল বুনিয়াদি পরিষেবাগুলির বেসরকারিকরণ করা হবে। আধার ব্যবহার করে জনজীবনের প্রত্যেকটি বিষয়ে নজরদারি সমেত কে কী খাবে, কে কাকে ভালবাসবে, কাকে বিয়ে করবে-র মতো সর্ব স্তরে মোদির সরকার এবং দল হস্তক্ষেপ করছে। নাগরিকের গোপনীয়তা এবং স্বাধীনতায় সেই হস্তক্ষেপ ও জবরদখল খর্ব করার কোনো ভাবনাই মোদির নেই।
তাছাড়া মোদি তাঁর বক্তৃতায় অতি ধনী পুঁজিপতিরা দেশপ্রেমহীন এমন একটি তার মতে “ভুল বিশ্বাস”কে শুধরানোর আবেগময় চেষ্টা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন যে, আমরা আমাদের “সম্পদ সৃষ্টিকর্তা”দের সন্দেহ করতে পারি না, বরং তাদের সম্মানিত ও উৎসাহিত করা উচিত। এই তথাকথিত “সম্পদ সৃষ্টিকর্তা”রা ভারতের জঙ্গল ও জমিকে লুণ্ঠন করেছে। তারা রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলিকে লুঠ করার পরে মোদি সরকারের সক্রিয় উৎসাহে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। মোদি সরকার তাদের লক্ষ কোটি টাকার কর ও ঋণকে মাফ করে দিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ব উদ্যোগের কোম্পানিকে বঞ্চিত করে মোদি সরকার বেসরকারি স্যাঙাতদের প্রতিরক্ষার বরাত পাইয়ে দিয়েছে। মোদি সরকারের এই নির্লজ্জ গরিব-বিরোধী ও কর্পোরেট তোষণকারী ও দুর্নীতি-সহায়ক নীতিকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই কারণ এই কর্পোরেটরা প্রকৃতই বিজেপির জন্য “সম্পদ সৃষ্টিকর্তা”, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে গোপনে বিশাল পরিমাণে তহবিল প্রদানকারী।
ভারতের জনগণকে গণতন্ত্র ও কাশ্মীরী জনগণের অধিকার রক্ষায়, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে দরিদ্রবিরোধী নীতি প্রতিরোধে, বেসরকারিকরণ প্রতিরোধে, এবং শ্রম ও পরিবেশ আইনগুলি সমেত ভারতীয় সংবিধানের উপর আক্রমণের প্রতিরোধে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২০ আগস্ট ২০১৯)