রাজ্যের চাষিদের সামনে মমতা সরকার রেখেছে দুটি ঘোষিত প্রকল্প। একটি হল, ‘কৃষক বন্ধু’, অপরটি ‘বাংলা শস্য বিমা যোজনা’। প্রথমোক্তটিতে চাষির পাওয়ার কথা চাষে আর্থিক সাহায্য। একর প্রতি বছরে দুদফায় মোট ৫ হাজার টাকা। আর, শেষোক্তটিতে চাষির প্রাপ্য শস্য বিমার প্রিমিয়ামের টাকা, যার পুরোটাই বহন করার দায় সরকারের। রাজ্য সরকার অনেক দেরীতে হলেও ঘোষণা করেছে বহু উত্থাপিত দাবি দুটির একটা গতি করার। এই সিদ্ধান্ত গত ডিসেম্বরের। তবে তার ছয় মাসের সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, প্রাপ্তিযোগের ক্ষেত্রে অনেক গলদ, অনেক বাধা। ফলিত চিত্র মোটেই সন্তোষজনক নয়, কোনোটা আধাআধি, কোনোটা আরও কম।
মুখ্যমন্ত্রী দলের জনসংযোগ কর্মসূচীর পাশাপাশি শুরু করেছেন জেলাওয়ারী প্রশাসনিক সভা। কিন্তু এহেন কোনও উদ্যোগেই উপরোক্ত প্রকল্প দুটি বিশেষ খতিয়ে দেখা হয়েছে কি? কোনো খবর নেই। ধরা যাক পূর্বমেদিনীপুরের জেলা প্রশাসনিক সভায় চর্চার কথা। মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা গেল অন্য কিছুতে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়। দীঘার সমুদ্রতীরে কর্পোরেট মনোমত নয়নাভিরাম অডিটোরিয়াম ও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে সূর্যমন্দির নির্মাণের ইচ্ছাপ্রকাশ। প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে আসলে কাদের বন্ধু হতে, কীসের বন্ধুতা পাতাতে উদগ্রীব! অথচ চাষিদের এক বড় অংশই ছিল অপ্রাপ্তির, অনিশ্চয়তার যে তিমিরে ছিল, অবহেলিত থাকছে সেই তিমিরেই। একে তো কেন্দ্রের বিমুখতায় চলছে ঋণ-জর্জর অবস্থা ও কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দাম না পাওয়ার বঞ্চনা, তার উপর যদি অধরা থাকে রাজ্যের ঘোষিত প্রকল্পের সুবিধা, তাহলে দূর্দশা নিয়ে প্রহসনের বাকিটা আর থাকেটা কী?
তথ্য বলছে ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পে রাজ্যের মোট ৭৩ লক্ষ চাষীর মধ্যে আবেদন না করতে পারা সংখ্যাটা ৩৮ লক্ষ। আর, শস্য বিমা যোজনার আওতায় আসতে না পারা অংশটা ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ। কৃষক বন্ধু প্রকল্পে আবেদন করতে পেরেছেন ৩৫ লক্ষ, তার মধ্যে জুন-জুলাই’১৯ পর্যন্ত টাকার চেক পেয়েছেন ১৬ লক্ষ, বাকি ১৯ লক্ষ চেক কবে পাবেন সেই খবর নেই। সরকারী সূত্র কেবল জানিয়েছে যে চেক বিলি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য ৩১৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে প্রাথমিক হিসাবে অনুমান বরাদ্দ প্রয়োজন হবে ৪৫০০ কোটি টাকা। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, সমস্ত চাষি ঘোষিত সরকারি আর্থিক সাহায্যের আওতায় আসবে কী? এমনিতে বছর ও একর পিছু যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তাতে চাষের খরচ উসুল হওয়ার নয়, তার ওপর ‘কিছুটা করে বাকিটা মেরে’ প্রকল্পের দফারফা করা হবে না তো?
পাশাপাশি সমসংখ্যায় সমস্ত চাষিকে শস্য বিমার প্রিমিয়াম মেটানোর প্রকল্পে সরকার টাকা বরাদ্দ করেছে কত, সেই তথ্য অপ্রকাশিত। ফলে বোঝার উপায় নেই সরকার বলছে যত, করছে কত। এই ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত ব্যাঙ্ক ঋণের গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন মাত্র ৩৫-৪০ শতাংশ। বড় অংশটাই বঞ্চিত। এদেরকে শস্য বিমার নিশ্চয়তার আওতায় নিয়ে আসার প্রশাসনিক প্রয়াসে চলছে প্রায় অচলাবস্থা।
উভয়প্রশ্নেই আবেদন গ্রাহ্য না হওয়ার মূল কারণটি দর্শানো হচ্ছে জমির কাগজপত্র ঠিকঠাক না থাকার মধ্যে। বলা হচ্ছে মূলত তিন ধরনের সমস্যা রয়েছে। প্রথমত কোনোরকম কাগজপত্র না থাকা, দ্বিতীয়ত নথিপত্র পূর্ববর্তী প্রজন্মের নামে থেকে যাওয়া, তৃতীয়ত বর্গাচাষী-ভাগচাষীদের অংশ — যাদের সরকার না দিয়েছে পাট্টা, জমি মালিকরা না করেছে চুক্তিপত্র। রাজ্যে অনথিভুক্ত বর্গাচাষির সংখ্যা এখনও বিপুল। নানা টালবাহানায় এদের পাট্টা প্রদানের কাজ চলছে না বললেই চলে। যেটুকু ছিটেফোটা হচ্ছে সবই শাসকের প্রতি আনুগত্যের মুচলেকা আদায়ের বিনিময়ে, বর্গাদারদের মধ্যে বিভাজন জিইয়ে রাখতে। এছাড়া বাড়ছে লিজে জমি চাষের বৈশিষ্ট্য। এক অংশের জমি আছে কিন্তু অর্থাভাবে বা অন্য কারণে চাষের ঝুঁকি নিতে অপারগ। অন্য অংশ, যাদের চাষের ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই, আবার চাষের জমি নেই। এই দুই অংশের মধ্যেই লিজে জমি দেওয়া-নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। নগদ টাকায় ভাড়ায় অথবা বিঘা প্রতি তিন-চার মণ শস্যের বিনিময়ে। এই চাষিদেরও ভীষণ প্রয়োজন চাষাবাদ এবং শস্য বিমা বাবদ সরকারী আর্থিক সাহায্য। নিছক জমিসংক্রান্ত নথিপত্রের যথেষ্ট প্রমাণ না থাকার কারণে চাষ ও চাষি অবহেলিত থাকতে পারে না। এইসমস্ত সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব রাজ্যের ভূমি দপ্তরের। প্রশাসন ওসব মেটাক। কিন্তু কাজ চালানোর আশু ব্যবস্থাও নিতে হবে। ঘোষিত প্রকল্পকে মাঝমাঠে পরিত্যক্ত করে রাখা চলতে পারে না। তৃণমূল সরকার মিউটেশনের খরচ মকুব করে দেওয়া হয়েছে শুনিয়ে বাহবা কুড়োতে চায়। কিন্তু ভূমি দপ্তরের কাজে কেন গয়ংগচ্ছ ভাব সরকার তা উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী সাফাই দিচ্ছেন, ভূমি দপ্তরে নথিকরণে দীর্ঘসূত্রিতার জটজটিলতা থাকলে পঞ্চায়েতকে শংসাপত্র প্রদানের নির্দেশ দেওয়া আছে। কিন্তু অতি নির্মম বাস্তব সত্য হল, চাষিদের তরফে, কৃষক সংগঠনের পক্ষ থেকে বারেবারে চাপ দেওয়া সত্বেও পঞ্চায়েত-বিডিও কোথাও কোনও সুরাহা মিলছে না। জেলাশাসকরা এ বিষয়ে কোনো আমলই দিচ্ছেন না। সদিচ্ছা থাকলে পঞ্চায়েত-ব্লক অফিস-জেলা শাসক অফিসের সমন্বয়ে উপরোক্ত সমস্যাগুলির সমাধান করা যায়। কিন্তু তা যখন হচ্ছে না তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না সরকার তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ছিনিমিনির পুরানো খেলাই খেলছে। পঞ্চায়েতরাজে রয়েছে তৃণমূলের আধিপত্য আর মৌরসীপাট্টা। লোকসভা নির্বাচনী ফলাফলে তৃণমূলের গ্রামীণ কপাল যথেষ্ট ফেটেছে। এই রাজনৈতিক সংকট কাটাতে মুখ্যমন্ত্রী অনেক বুলি দিচ্ছেন। কিন্তু বড় অংশের চাষিদের চাষ-সংকটের হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় মিলছে না।
তবে রাজ্যের ভূমি প্রশাসনের ভূমি বিষয়ক জটিলতায় একেবারে কপালে ভাঁজ পড়ছে না তা নয়। তারা চিন্তিত ও তৎপর কেবল সেই অংশের জমিজট ছাড়ানো নিয়ে, যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ৪ হাজার কোটি টাকার স্বপ্নের নর্থ-সাউথ করিডোর রূপায়ণ প্রকল্প। তৃণমূল সিঙ্গুরের মেঘমুক্তির দৌলতে রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু রাজ্যভিত্তিক ভূমিসংস্কারের খাতা কখনও খোলেনি। তৃণমূল নেত্রী আর সিঙ্গুরকে রাজনীতিতে প্রতীক করে রাখার পক্ষপাতী নন। সেখানে জমি বণ্টনের কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। ন্যায়সঙ্গত দাবিদার না থাকার অজুহাত দেখিয়ে। দায় ঝেড়ে ফেলেছে চাষ পুনরুদ্ধারের কি হল সেই তত্ত্বাবধানের, ওখানে চাপ এখন তৃণমূলের স্বজনপোষণ, তোলাবাজি, কাটমানি, গোষ্ঠীসংঘাতের। অন্যদিকে ছোটাচ্ছে কর্পোরেট বিনিয়োগের আলেয়ার পেছনে। এই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোভাব প্রলুব্ধ করছে অগত্যা সরাসরি কৃষিজমি কিনে নিতে। সেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের দাবি মেটাতে হবে, তার জন্য জমি মালিকানার জট মুক্ত করতে হবে। রাজ্যের ভূমি দপ্তর অতি সক্রিয় কেবল এইসব ক্ষেত্রে। এমনকি বলতে শুরু করেছে জট ছাড়াতে সময় লাগে লাগুক। ক্ষতিপূরণের টাকা আদালতে জমা রেখে জমি নিয়ে নেওয়া হোক। যার টাকা পাওয়ার থাকবে তার দায় নথির প্রমাণ দেওয়ার। চলছে প্রবঞ্চনা ও আত্মসাতের ফিকির খোঁজা।