‘দিদিকে বলো’

মুখ্যমন্ত্রী মমতা চালু করেছেন ‘দিদিকে বলো’ জনসংযোগ কর্মসূচী।

তৃণমূলের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে যদিও ভোট শতাংশ যথাস্থিতিতে রয়েছে থেকেছে, কিন্তু আসন খোয়াতে হয়েছে বড় সংখ্যায়। উত্তরবঙ্গে কোথাও কোনও আসন মেলেনি। হতাশ করেছে দক্ষিণবঙ্গ। গঙ্গার দু’পাড়ে হুগলী ও উত্তর চব্বিশ পরগণার দুই শিল্পাঞ্চলের দুটি লোকসভা আসন, তাও চলে গেছে। শতাধিক বিধানসভা ক্ষেত্রে তৃণমূল পিছিয়ে, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা ক্ষেত্রে ও পৌরসভা ওয়ার্ডে পিছিয়ে। মাশুল গুণতে হয়েছে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতা’য় চৌত্রিশ শতাংশ আসন সহ ভোটলুঠ করে পঞ্চায়েতরাজের দখল নেওয়ার। তৃণমূলের গ্রামীণ লোকসভা নির্বাচনী ফল মার খেয়েছে অনেক কারণে, সমস্ত কারণ ছাপিয়ে যায় পঞ্চায়েতী নির্বাচনী সন্ত্রাস। তার প্রতিফল মিলেছে লোকসভা ভোটে। নির্বাচনের বহু সময় পেরিয়ে গেছে, তবু বহু পৌরসভা তৃণমূল চালাচ্ছে রীতি বর্হিভূতভাবে প্রশাসনিক অফিসার বসিয়ে, সাহস পাচ্ছে না নির্বাচন করার। ২০১৪-য় কেন্দ্রে মোদী ১ জমানা কায়েমের পর মুখ্যমন্ত্রী বিদ্রুপ করতেন সিপিএম ও কংগ্রেসকে। বিজেপিকে ঠেকানোর কথা তুলে। গত পাঁচ বছরে বিজেপির আগ্রাসী আবাহনে সিপিএম ও কংগ্রেসের সামাজিক ভিত্তিতে ধস নেমেছে পরের পর। সদ্য লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম কলঙ্কের সমস্ত অতীত ছাড়িয়ে যায়। তৃণমূলকে কূপোকাৎ করার নামে ‘আগে রাম’ ভোটদানের কৌশলগত অবস্থান নেয়। এটা যেমন নীতিগত স্খলনের, তেমনি অনৈতিকতার, লজ্জার। তবে তৃণমূলও বিজেপি হানায় যথেষ্ট সংকটে পড়েছে। একদিকে বিজেপির আছে নিজের সন্মোহন বাড়ানোর অভিযান, অন্যদিকে তৃণমূলের স্বৈরাচার বিজেপির অনুপ্রবেশে কাজ করেছে অনুঘটকের। পরন্তু প্রত্যক্ষ হচ্ছে তৃণমূলের ঘোড়েল নেতা ও মন্ত্রীদের আস্তাবল বদলের ঘটনা প্রবণতা। জোড়াফুলের বোড়েরাও অনেক ক্ষেত্রে ভীড় করছে পদ্মের পদাতিকে।

দলের দুর্দশা কাটাতে দলনেত্রী এক ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল বিশেষজ্ঞ’-কে এনে কোচের দায়িত্বে বসিয়েছেন। তিনি ভোট ময়দানে "এক নয়া ‘পি কে’"। তাঁরই কথায় চালু হয়েছে “দিদিকে বলো” সংযোগ স্থাপন লাইন। দলনেত্রী ইতিমধ্যে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে দলের স্থানীয় নেতা-মাথা-প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধি-মোড়ল-মাতব্বরদের তোলাবাজী চালানো, কাটমানি খাওয়া নিয়ে লোকশোনানো তোপ দেগেছেন। টাকা ফেরত দেওয়ার হুকুম দিয়েছেন। আর এসব ইস্যু যত তৃণমূলের বিরুদ্ধে লাগাতার জনবিক্ষোভে ফেটে পড়ছে, তাতেও দল সর্বস্তরে জেরবার হচ্ছে ঘরে-বাইরে।

তৃণমূলী নানা মাপের ক্ষমতার মালিক হয়ে ওঠা নেতারা সরকারি নানা প্রকল্পের কাটমানি খেয়ে আসছে, তোলাবাজী চালিয়ে আসছে, এ তো চালিয়ে আসতে দেওয়া হয়েছে, ওপরতলা এর দায় অস্বীকার করতে পারে না। তাছাড়া সারদা চিট ফান্ড প্রকল্পের কলঙ্ক যেখানে লেগেছে দলের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত, যার তদন্ত ও বিচার শেষপর্যন্ত সম্পূর্ণ হবে কিনা নিশ্চিত নয়, তবু নিষ্কৃতি পেতে কত নেতা কতরকমই চষে ফেলছেন, এমনকি বিজেপির দ্বারস্থ হওয়ার পেছনে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও গোষ্ঠী সংঘাতের অন্যান্য বহু কারণ থাকলেও সারদার চাপ একটা বড় কারণ। তৃণমূল নেতৃত্ব নয়া ফিকির খুঁজছে। সারদার যত সংস্রব কহানি তার দায় বিজেপিতে যাওয়া বা যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা দলত্যাগীদের দিকে পরোক্ষে চালান করে দিতে। কিন্তু এ চালাকিতে ভাবমূর্তি ফরসা হওয়ার নয়, কালি লেগেছে বিস্তর।

তৃণমূল আমলে শুধু কাটমানিতে কেন্দ্র-রাজ্যের প্রকল্পের টাকা মারা হয়েছে তা নয়, এই আমল মানুষের আরও অনেক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে অসমাপ্ত ভূমিসংস্কার সম্পন্ন করার ও চাষ-বাসের জমির অধিকার, কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনে কাজ পাওয়া, সরকারি কর্মক্ষেত্রে ও সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদে সুষ্ঠু নিয়োগ, সুলভে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সুষম প্রাপ্তি ইত্যাদি এবং সর্বোপরি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বিরোধিতার গণতান্ত্রিক অধিকার। এরাজ্যের সরকার রাজত্বটা চালাচ্ছে কেবল মর্জিমাফিক অনুগ্রহ করে দান খয়রাতি বিলোনোর অর্থশাস্ত্রানুসারে। এখানে কেন্দ্রের মোদী জমানার শ্রম ও শ্রম বিরোধ নিস্পত্তির নীতিই অনুসরণ করা হয়। ধর্মঘটের অধিকার স্বীকৃত নয়। এমনকি কেন্দ্রের শ্রমজীবী স্বার্থবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ধর্মঘট করতে গিয়ে শিকার হতে হয়েছে রাজ্যের সরকারি সন্ত্রাসের। একদিকে শিক্ষক দিবসের পালনের চমক প্রদর্শন চলে, অন্যদিকে শিক্ষকদের নিয়োগের দাবিতে দিনের পর দিন অবস্থানে-ধর্ণায় অবহেলায় রাস্তায় থাকতে হয়; অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতনের দাবিতে সোচ্চার হলে এ রাজ্য থেকে চলে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আন্দোলন করলেও নেমে আসে পুলিশী উৎপীড়ন, দলতন্ত্র-দমনতন্ত্রই প্রথম ও শেষ আচরণ। তাই কেন্দ্রের অত্যাচারী মোদী জমানার পাশাপাশি এরাজ্যের তৃণমূল রাজত্বও জনবিরোধী।

তাই শুধু তোলাবাজী, কাটমানি বা দাদাগিরি নিয়ে ‘দিদিকে বলো’ বলাচ্ছে বলেই তৃণমূল আমলকে রেহাই দেওয়া যায় না। যে সমস্ত অধিকার এই তৃণমূলী অপশাসন কেড়ে নিয়েছে তার প্রতিটি আদায়ের দাবিতে নতুন করে নামতে হবে নাছোড় লড়াইয়ে।

অসংখ্য তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সবসময় বুঝে নেওয়া দরকার বিজেপি ফ্যাসিবাদী বিষ কখনও প্রকৃত বিকল্প হতে পারে না। সাচ্চা লড়াইয়ের জন্য সংগঠিত নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত হতে হবে বামপন্থীদের, জনগণকেও ভরসা করতে হবে বামপন্থী নেতৃত্বের ওপর, হাতে হাত লাগিয়ে গড়ে তুলতে হবে বাম শক্তির এক সংগ্রামী পুনর্জাগরণ।

খণ্ড-26
সংখ্যা-25