টনি মরিসন (ক্লো আর্ডেলিয়া ওয়ফোর্ড; ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১ – ৫ অগস্ট, ২০১৯) ছিলেন একজন মার্কিন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক। তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’, যা ১৯৭০-এ প্রকাশিত হয়। ‘সং অব সলোমন’ (১৯৭৭)-এর জন্য তিনি বিরাট স্বীকৃতি পান, পান ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কল পুরস্কার। ‘বিলাভেড’ উপন্যাসের জন্য ১৯৮৮ সালে পান পুলিৎজার পুরস্কার। তার আগে ১৯৮৭ সালে পেয়েছেন আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড। সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে। ২০১৬ পর্যন্ত তাঁর পাওয়া পুরস্কার ও স্বীকৃতির ধারা ছিল অব্যাহত।
ছোট্ট বেলার একটি ঘটনা থেকে জানা যায়, টনির ব্যক্তিত্ব, লেখক জীবন, সর্বোপরি একজন মানুষ হিসাবে তাঁর অবস্থান। যখন তাঁর বয়স মাত্র দু বছর, তখন তাঁদের বাড়িতে বাড়িওয়ালা আগুন লাগিয়ে দেয়। সে সময় বাড়িতে সকলেই ছিলেন। ভাড়া দিতে পারেননি টনির মা-বাবা, তাই বাড়িওয়ালা এমন কাজ করেছিলেন। এমন উপদ্রুত অবস্থাতেও কিন্তু টনির মা-বাবা ভেঙ্গে পড়েননি, বরং অদ্ভুত এক হাসি হেসেছিলেন গৃহমালিকের দিকে তাকিয়ে।এই ঘটনা থেকে সেদিন শিক্ষা নিয়েছিলেন টনি। এমন চরম পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজেকে সংযত রাখতে হয়, নিজস্বতা আঁকড়ে বাঁচতে হয় তা তিনি বুঝেছিলেন। অভাবনীয় বর্বরতা ও অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েও কীভাবে ব্যক্তিসত্তা অক্ষুণ্ণ রেখে, জীবনের অধিকার ও স্বত্ব বুঝে নিতে হয় তা উপলব্ধি করেছিলেন তিনি।
২০১৫ সালের ২৩ মার্চে লেখা তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘নো প্লেস ফর সেল্ফ-পিটি, নো রুম ফর ফিয়ার’ থেকে আমরা জেনেছি কীভাবে ২০০৪-এ জর্জ বুশ পুনর্বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মরিসন অসহায়তার অবসাদে ভুগেছিলেন। তিনি যেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর লেখনী হয়ে পড়েছিল রুদ্ধ। একটি উপন্যাস শুরু করেও আর লিখতে পারছিলেন না। একজন বন্ধুতখন তাঁকে বলেন, “না! না না না! এই হচ্ছে সেই সময় যখন শিল্পীকে কাজে যেতে হয়, তাকে হাসপাতালের খাটে বসেও লিখতে হয়। ক্রমাগত তাড়া খেয়েও, নির্বাসিত হয়েও, অমানুষিক অপমান আর অত্যাচারের শিকার হয়েও, অপবাদ আর বিদ্রুপের মুখোমুখি হয়েও তাঁকে লিখে যেতে হয়।”
টনি উপলব্ধি করলেন, এই লেখক-শিল্পীদের তালিকা তো শুধু স্তালিনের আমলের নয়, গত শতকেরও নয়, বরং সভ্যতার মতোই প্রাচীন। সেদিন মরিসন গিয়ে দাঁড়ালেন সেই সোপানে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন পল রোবসন, প্রাইমো লেভি, আই ওয়েয়ি, অস্কার ওয়াইল্ড, পাবলো পিকাসো, ড্যাসিয়েল হ্যামেট, ওল সোয়েঙ্কা, ফিয়োদর দস্তভস্কি, আলেক্সান্দার সলঝেন্সতাইন, লিলিয়ান নেলমান, সালমান, রুশদি, হার্তা মুলার, ওয়াল্টার এবং, বস্তুত আরও হাজারো শিল্পী যাঁরা সত্যবাদী, নিষ্ঠাবান, নির্ভীক, যাঁরা আপোষকামী নন।
টনি মরিসন আমাদের বলেন, একনায়কতন্ত্রের অত্যাচার চিরস্থায়ী হতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। মরিসন বলেন, আমাদের ভাষা, আমাদের কথা বলা, আমাদের লেখনীই সভ্যতাকে মুক্ত করবে। করবে রোগমুক্ত।
তিনি বলেন, আমি জানি, পৃথিবী ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। এতে বিমর্ষনা হওয়া ও নিজেকে অবজ্ঞা না করা জরুরি, এবং আরও জরুরি হল এই গভীর কষ্টের মূলে যে অমঙ্গলের শক্তি রয়েছে, তার কাছে নতি স্বীকার না করা। এবং শিল্প সেই পথ দেখায়। বিদায় টনি মরিসন।