৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বা ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির একটি কল্পকথা ভারতের জনগণের সামনে খাড়া করে দেওয়া হচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন করছেন না ৫ লক্ষ কোটি ডলার দেশের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপন্ন হলে কী ঘটবে? সবাই চাকরি পাবে? সবাই শিক্ষিত হবে? কৃষক আত্মহত্যা বন্ধ হবে? নারী নির্যাতন বন্ধ হবে? শহরের ফুটপাতে বসবাসকারী সকলে মাথার উপরে ছাউনি পাবে? দেড়শ একর জমি দখলের জন্য ১০ জন আদিবাসিকে গুলি করে হত্যা বন্ধ হবে? এসব প্রশ্ন ওই অর্থনীতির আয়তনের বৃদ্ধির গল্পের ধামাকায় চাপা দেওয়া থাকবে।
কিন্তু স্বদেশপ্রেমী ভারতীয় জনতা পার্টির এত ডলার প্রেম কেন? জিডিপিকে টাকার অঙ্কে প্রকাশ করে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে আপত্তি কোথায়। ২০১৮-১৯ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এই ৫ লক্ষ কোটি ডলারের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপন্নে পৌঁছানোর হিসেব করা হয়েছে কিছু ধারণার ভিত্তিতে। টাকার নিরিখে ডলারের দাম ৭৫ টাকা প্রতি ডলার ধরা হয়েছে ২০২৪-২৫ সালে। ফলে ৫ লক্ষ কোটি ডলার টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় (৫x৭৫) = ৩৭৫ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ বিত্ত বর্ষে টাকার অঙ্কে ভারতের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপন্ন ১৯০ লক্ষ কোটি টাকা। বার্ষিক ১২% চক্রবৃদ্ধি হারে ১৯০ লক্ষ কোটি টাকা ৬ বছরে, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৪-২৫ সালে, ৩৭৫ লক্ষ কোটি টাকায় রূপান্তরিত হবে। ফলে টাকার দাম একই থাকলে ২০২৪-২৫ সালে ভারতীয় অর্থনীতিকে ৫ লক্ষ কোটি ডলার বা ৩৭৫ লক্ষ কোটি টাকায় পরিণত করতে হলে বার্ষিক ১২% বৃদ্ধি দরকার। ওই অর্থনৈতিক সমীক্ষায় আরো ধারণা করা হয় যে, বার্ষিক ৪% হারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে। ফলে প্রকৃত বৃদ্ধি দরকার পড়বে (১২-৪)% = ৮%। অর্থনৈতিক সমীক্ষার ধারণা অনুসারে ২০১৮-১৯ সালের ৭০ টাকা প্রতি ডলার থেকে ৬ বছরে ২০২৪-২৫ সালে ডলারের দাম ৭৫ টাকা প্রতি ডলার হতে গেলে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটতে হবে বার্ষিক ১.১% মাত্র। বোঝা গেল না, দেশীয় মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে ৪% বার্ষিক, কিন্তু টাকার ডলারের নিরীখে অবমূল্যায়ন ঘটবে মাত্র ১.১% বার্ষিক?
এমন ধারণা করা হল কেন? এভাবে ধারণা করলে তো আরো কম সময়েই ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছে যাওয়া যায়। যদি ধারণা করি যে, আগামী ৪ বছরের মধ্যে ডলারের দাম কমে ডলার প্রতি ৬০ টাকা হবে, তাহলে বার্ষিক ১২% বৃদ্ধি ঘটলে ২০২২-২৩ সালে, অর্থাৎ ৪ বছরের মধ্যে চলতি মূল্যে টাকার অঙ্কে ভারতীয় অর্থনীতির জিডিপি ৩০০ লক্ষ কোটি টাকা বা (৩০০/৬০) = ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। পূর্বের ন্যায় ৪% মুদ্রাস্ফীতি ধরলে ওই ৪ বছরে স্থির মূল্যে জিডিপির বৃদ্ধির হারের প্রয়োজন পড়বে ৮%। কিন্তু তাতে ভারতীয় অর্থনীতির তেমন কোনো সুরাহা হবে না। কারণ ডলারের দাম আন্তর্জাতিক চাহিদা ও যোগানের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে। ফলে বিজেপির অর্থনৈতিক বিশারদদের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় হিসেব করা প্রয়োজনীয় জিডিপি বৃদ্ধির হার ডলারের দাম ও ভারতীয় অর্থনীতির মুদ্রাস্ফীতির হারের কাল্পনিক ভিত্তির উপর করা।
কিন্তু এত জটিল হিসেবের মধ্যে না গিয়ে অন্যভাবে হিসেব করা যায়। অর্থনৈতিক সমীক্ষা, অর্থমন্ত্রী, মোদিজী সকলে চাইছেন ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৪-২৫ বা আগামী ৬ বছরে স্থির মূল্যে ২.৭ লক্ষ ডলারের অর্থনীতি বেড়ে ৫ লক্ষ কোটি ডলার হবে; অর্থাৎ ৬ বছরে অর্থনীতির জিডিপি (৫/২) = ১.৮৫ গুণ হবে অর্থাৎ, স্থির মূল্যে ভারতীয় জিডিপিকে ১.৮৫২ গুণ হতে হবে। বা ৬ বছরে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ৮৫%। ফলে ২০১১-১২র মূল্যে (স্থির মূল্যে) ২০১৮-১৯ এর আভ্যন্তরীণ উৎপন্ন ১৪১ লক্ষ কোটি টাকাকে ২০২৪-২৫ সালে বেড়ে হতে হবে (১৪১x ১.৮৫) = ২৬১ লক্ষ কোটি টাকা। কারণ সমস্ত অর্থনীতিবিদই জিডিপির বৃদ্ধি বলতে স্থির মূল্যে জিডিপির বৃদ্ধিকে বোঝান ও বোঝেন। কিন্তু তেমনটা ঘটতে গেলে বার্ষিক ১০.৮% হারে প্রকৃত জিডিপির বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। এক্ষেত্রে হিসেব করার সময়ে ডলারের দাম ও ভারতীয় অর্থনীতির মুদ্রাস্ফীতির হারের বিষয়ে কোনো কল্পনা করতে হচ্ছে না।
২.৭ লক্ষ ডলারের অর্থনীতিকে ৬ বছরের মধ্যে ৫ লক্ষ ডলারে নিয়ে যাওয়ার প্রধানমন্ত্রীর বাসনাকে তৃপ্ত করার জন্য অর্থনীতিকে ৮৫% বৃদ্ধির নিরীখে জিডিপি বৃদ্ধির হার ঠিক করার পরিবর্তে ডলারের দাম ও মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে ধারণার ভিত্তিতে একটি যুক্তিসঙ্গত হার (৮%) ঘোষণার এই অনৈতিক প্রচেষ্টা মোদি সরকারের শাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রকট। কোনো প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতিবিদরাই এই সরকারের সান্নিধ্যে স্বচ্ছন্দ্য নয়। রঘুরাম রাজন, উর্জিত প্যাটেল, অরবিন্দ সুব্রমনিয়ান, ভিরাল আচার্য, অরবিন্দ পানাগরিয়ার মতো বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ এই সরকারের সঙ্গ ত্যাগ করেছেন। অতি সম্প্রতি রাজস্ব ঘাটতি ও সার্বভৌম (সভেরেন) বন্ড নিয়ে অন্যতম সদস্য রথীন রায়ও বিরোধিতা করছেন। এমনটাই হওয়ার কথা। প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রমনিয়ান মোদি সরকারের প্রথম ৩ বছরের জিডিপি বৃদ্ধির হারকে অতিরঞ্জিত বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন জিডিপির বৃদ্ধির হারকে ২.৫% বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে বর্তমান মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা প্রাক্তনের বক্তব্যকে জুন মাসে খণ্ডন করেন। কিন্তু অতি সম্প্রতি অরবিন্দ সুব্রমনিয়ান সরকারের বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ওই সময়ে বাস্তবিক শিল্প ঋণের বৃদ্ধির হার বার্ষিক ১৬% থেকে কমে ঋণাত্মক ১%-এ দাঁড়ায়, যার প্রতিফলন ঘটে প্রকৃত বিনিয়োগের বৃদ্ধির সরকারি তথ্যে যা ১৩% থেকে ৩%-এ নেমে আসে। বাস্তব রফতানি বৃদ্ধি ১৫% থেকে ৩% ও বাস্তব আমদানি বৃদ্ধির হার ১৭% থেকে ঋণাত্মক ১%-এ নেমে এসেছিল। ফলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি মোটেই তেমনটা ঘটেনি যা সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে ও বর্তমান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নিশ্চিত করতে চাইছেন।
অপরদিকে বাজেট, পূর্বতন অন্তর্বর্তী বাজেট ও অর্থনৈতিক সমীক্ষায় প্রদত্ত রাজস্ব আদায় ও ব্যয় নিয়েও ধন্ধ তৈরি হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে পেশ করা পীযূষ গোয়েলের অন্তর্বর্তী বাজেটে সংশোধিত আনুমানিক রাজস্ব আদায় ও সংশোধিত আনুমানিক ব্যয়ের তথ্যে বড় ধরনের গোঁজামিল ছিল। ওই বাজেটে যে পরিমাণ দেখানো হয়েছিল বাস্তবে ২০১৮-১৯ সালের রাজস্ব আদায় তার থেকে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে, যা ভারতের জিডিপির ০.৯% ও মোট ব্যয় ১ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকা কম হয় যা জিডিপির ০.৮%। মনে রাখা দরকার নির্বাচনের আগে পেশ করা বাজেটে এই অতিরিক্ত ব্যয় ও আয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। কেবল তাই নয়, অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রকাশিত হওয়ার পরে যখন সেই সমীক্ষায় বাস্তব পরিমাণ জানানো হচ্ছে তখনও অর্থমন্ত্রী তাঁর পেশ করা বাজেটে ওই অন্তর্বর্তী বাজেটের ভুল অনুমানগুলিও পেশ করছেন। প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন যে, বরাবরই সংশোধিত আনুমানিক রাজস্ব আদায় ও সংশোধিত আনুমানিক ব্যয়ের তথ্যই বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু তিনি এটা বলতে চাননি যে বাজেট প্রস্তুতের সময়ে বাস্তব রাজস্ব আদায় ও বাস্তব ব্যয়ের তথ্য জানা থাকে না, কারণ বাজেট প্রস্তুত হয় বর্ষশেষ হওয়ার আগে। তাছাড়া, সমস্ত অনুমানকেই যতটা সম্ভব বাস্তবের কাছাকাছি নিযে যাওয়া ও তার উপরে ভিত্তি করে বাজেট প্রস্তুতই শ্রেয়। তবে এই সরকারের অর্থমন্ত্রীর কাছে তেমনটা আশা করা বৃথা। তিনি ব্রিফকেসের বদলে শালুতে মোড়া খাতা ব্যবহারের চমক দেখাতে পারেন, কিন্তু তথ্যকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরোনো রীতি মেনে জানা তথ্যের বদলে ভুল তথ্যকেই ব্যবহার করেন।
মোদি ২ সরকারের ৫০ দিনে ভারতীয় শেয়ার বাজারের মূল্য ১২ লক্ষ কোটি টাকা বা ৭.৫% কমেছে, মাঝারি মাপের কোম্পানিগুলির শেয়ারের দর কমেছে ১২%। আইএইচএস মার্কিট নামক লন্ডন ভিত্তিক একটি ব্যবসায় গবেষণা সংস্থার সমীক্ষা অনুসারে ২০০৯ থেকে শুরু করা এই সমীক্ষায় ভারতের ব্যবসায় কাজকর্মের প্রত্যাশা সূচক এতাবৎকালের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, ব্যবসায়িক আস্থা ইউপিএ সরকারের সময়কালের থেকেও নিম্নস্তরে চলে গিয়েছে। যে সমস্ত অর্থনৈতিক সূচক পাওয়া যাচ্ছে তা অর্থনৈতির দুরবস্থার দিকে ইঙ্গিত করছে। গত মে মাসে শিল্প উৎপাদন মাত্র বার্ষিক ৩.১% হারে বেড়েছে, ২০১৯ সালের মে ও জুন মাসে গাড়ির বিক্রি গত বছরের ওই ২ মাসের বিক্রির তুলনায় ২১৫ হারে কমেছে। এ বছর জুন মাসে রফতানি গত ৪১ মাসে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। জুনে শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকে বিনিয়োগ গত ১৫ বছরের কোন ত্রৈমাসিকের বিনিয়োগের পরিমাণের তুলনায় সর্বনিম্ন। জুন, ২০১৯-এ ভারতীয় সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানিগুলির নুতন প্রকল্পের ঘোষণা টাকার অঙ্কে মাত্র ৪৭, ৪০০ কোটি টাকা যা গত বছরের জুন মাসের তুলনায় ৮৭% কম। আইএইচএস মার্কিটের সমীক্ষা করা বেসরকারি কোম্পানিগুলির মধ্যে মাত্র ১৫% কোম্পানি আগামী বছরে উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে। ফলে বাজার নির্ভর অর্থনীতিও ক্রমাগত সমস্যায় পড়ছে।
সামগ্রিক অর্থনীতি যখন মন্দার দিকে ইঙ্গিত করছে সেই সময়ে সরকারি উদ্যোগকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে মোদি-২ সরকার বেসরকারিকরণের রাস্তায় দেশকে সঙ্কটের মুখে নিয়ে যেতে চাইছে, ব্যক্তি পুঁজিপতিদের স্বার্থে। রেল, বিএসএনএল, এয়ার ইন্ডিয়া সমেত সমস্ত ক্ষেত্রকেই তারা বিলগ্নির মাধ্যমে ব্যক্তি পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিতে উৎসুক। তারা ভুলে গিয়েছে যে, শক্তিশালী সরকারি উদ্যোগ থাকার জন্যই গত ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দার সময়েও আমাদের দেশের অর্থনীতি তেমনভাবে আক্রান্ত হয়নি। গত ১৯ জুলাই ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্বকরণের ৫০ বছর পূর্ণ হল। অনেকেরই হয়তো খেয়াল নেই যে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সময়ে বর্তমান ভারতীয় জনতা পার্টির তৎকালিন সংস্করণ জনসঙ্ঘ ও তার নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি ব্যাঙ্ক জাতিয়করণের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। আজ সেই রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলির মাধ্যমেই মোদি সরকার মুদ্রা, জনধন, উজ্জলা, পিএমকেএসওয়াই ইত্যাদি প্রকল্পগুলিকে লাগু করে জনগণের ভোট চাইছে। কিন্তু ভোটে জিতে এসে সেই ব্যাঙ্কগুলিকেই বিভিন্নভাবে বেসরকারিকরণের কথা ভাবছে।
ফলে ভারতীয় অর্থনীতি যখন বেকারি, কৃষি সমস্যা, কৃষক আত্মহত্যার সুরাহা করতে অক্ষম, তখন সরকারি উদ্যোগকে শক্তিশালী করার বদলে মোদি-২ সরকার তথ্যের কারসাজি করে আর জনগণের করের টাকায় গড়ে ওঠা সরকারি উদ্যোগগুলিকে ব্যক্তি পুঁজির কাছে বেচে দিয়ে দেশীয় অর্থনীতিকে আরো দুর্বল করে দিতে চাইছে।