আগামী ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষে স্বাধীনতার ৭২ তম বার্ষিকী উদযাপিত হবে। দু বছরের মধ্যেই স্বাধীনতা উত্তর ভারতের প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী উৎসবের সূচনা হবে। কিন্তু ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাসে এই মুহুর্তে ভারত এমন এক শক্তি দ্বারা শাসিত হচ্ছে যারা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্পূর্ণবিরোধিতা করেছিল।
যখন কোটি কোটি ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক দখলকে শেষ করে এক স্বাধীন ও আধুনিক ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিল, বর্তমান বিজেপির মতাদর্শগত পূর্বসূরীরা তখন মুসোলিনি ও হিটলারের কাছে থেকে জাতীয়তাবাদ আমদানি করছিল। সে ছিল এমন এক সময় যখন নভেম্বর বিপ্লবের প্রবল অভিঘাতে সারা বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি এবং জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামগুলির দুর্বার বৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করছিল। বেশ কিছু দেশে, বিশেষভাবে চিনে, যেখানে কম্যুনিস্ট পার্টি চিনের বিপ্লবী পুনর্গঠনের লক্ষ্যে জাপান বিরোধী জাতীয় জাগরণের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, এই দুটি ধারার সংমিশ্রণ ঘটেছিল। ভারতবর্ষেও ভগত সিং ও তাঁর সাথীরা এবং কম্যুনিস্ট পার্টি এই দুটি ধারাকে গণজাগরণের শক্তিশালী ঢেউ-এ সংযুক্ত করার দিকে যথেষ্ট অগ্রগমন ঘটিয়েছিল। কিন্তু আরএসএস-এর জাতীয়তাবাদের অন্য ব্যাকরণ ছিল।
আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতারা জার্মান জাতির গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সংক্রান্ত হিটলারের ধারণা দ্বারা বিপুলভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এবং তারা তাদের হিন্দু ভারতের দৃষ্টিভঙ্গী প্রস্তুতিতে তাকে আত্মস্থ করেছিল। তাদের কাছে স্বাধীনতা বলতে বর্তমানের সমস্যার সঙ্গে লড়াই নয়, সময়কে পিছনে নিয়ে যাওয়া ও অতীতের ঘটনার শোধ নেওয়া। ব্রিটিশ শাসকেরা জাতীয়তাবাদের এই সাম্প্রদায়িক ধারণাকে দ্রুত গ্রহণ করে ও প্রণোদনা জোগায়। এবং আমরা জানি সেই ভাবনা কিভাবে অভুতপূর্ব সাম্প্রদায়িক রক্তপাত, কোটি কোটি মানুষের দেশত্যাগ এবং লাখো লাখো পরিবারের সম্পূর্ণ বিভক্তিকরণ ও বাস্তুচ্যুত হওযার মাধ্যমে দেশের বিভাজনে পর্যবসিত হয়।
সেই বিষাদময় পরিণতির সাত দশকের বেশি সময় পরে সঙ্ঘপরিবার ভারতীয় জনগণের উপরে সেই আতঙ্ককে পুনরায় আরোপ করতে চাইছে। অস্বচ্ছ ধারণাপ্রসূত এনআরসি অনুশীলন এবং নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের ভয়ানক উদ্দেশ্য আসামের সামাজিক বুনোটকে বিপর্যস্ত করেছে এবং বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ সমেত সারা দেশে সেই দুর্ভাগ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে বদ্ধ পরিকর।
আমরা আমাদের প্রাচীন সভ্যতা ও উন্নত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে যতই গর্ব অনুভব করি না কেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতকে যতটা জাগরিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছে তা আগে কখনো ঘটেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীন ভারতের গতিপথ ও প্রাতিষ্ঠানিক গঠনের ভবিষ্যত সম্পর্কে নিজেদের নিবেদন করেছিলেন। ভারতীয় সংবিধান বিশ্বের অন্যতম চরম বৈচিত্রময় ও বিভাজিত সমাজের জন্য সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের দিশা সমেত সমস্ত নাগরিকদের জন্য স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায় ও মৈত্রীর লক্ষ্যে একটি নুতন ঐক্যবদ্ধ কাঠামো প্রদান করেছিল। সামাজিক দাসত্বের প্রাচীন সনদকে একটি আধুনিক সমাজের আচরণশৈলীর দিকনির্দেশক হিসেবে তুলে ধরে সঙ্ঘ কেবলমাত্র স্বাধীনতার জন্য জনপ্রিয় লড়াই থেকেই সরে থাকেনি, আধুনিক গণতান্ত্রিক সংবিধানের অন্তর্বস্তুকেও বিরোধিতা করেছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সঙ্ঘ পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনকল্যাণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রিয় হস্তক্ষেপের ধারণার বিরোধিতা করে, এবং কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায়ে অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি কব্জাকে সমর্থন করে। তাই অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, ২১০৪ সালে ক্ষমতায় এসে মোদি সরকারের অন্যতম প্রাথমিক কাজ ছিল পরিকল্পনা কমিশনকে উঠিয়ে দেওয়া। এবং দ্বিতীয় দফায় ফিরে এসে অবাধ বেসরকারিকরণ ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে গভীর সংযুক্তিকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সঙ্ঘিবাহিনীর কাছে জাতীয়তাবাদ কেবল মতাদর্শগত নিগড়, রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণ এবং সাংস্কৃতিক সমরূপকরণের অস্ত্র, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র ও রাষ্ট্রীয়করণের তুমুল বিরোধী। বিজেপি জানে যে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের বিকৃতি ব্যতিরেকে তারা কিছুতেই তাদের শাসনকে সংহত করতে পারবে না, এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা প্রচারের যৌথ শক্তিকে ব্যবহার করে সেই লক্ষ্যে তারা এগোতে চাইছে। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ গৌরবগাথার নিদর্শন আন্দামান সেলুলার জেলকে অপমানজনকভাবে সাভারকারের নামাঙ্কিত করা হয়েছে, যিনি কিনা সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে আকড়ে ধরার জন্য ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরিত্যাগ করে ব্রিটিশ শাসকদের কাছে মার্জনা ভিক্ষা করেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী যখন নিকটে এসে পড়েছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জল ইতিহাসকে পুন:প্রতিষ্ঠিত করা ও ভারতীয় জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খাকে পূর্ণ করার লড়াইকে তীব্র করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও সাহসিকতা মোদি সরকারের ফ্যাসিবাদি অভিসন্ধিকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে শক্তি ও অনুপ্রেরণার বিপুল উৎস হিসেবে থেকে যাবে।
লিবারেশন আগস্ট ২০১৯ সম্পাদকীয়