“এরপরে একটা বড় আন্দোলনে যোগ দিয়ে আমরা গোটা সমাজেরই এক নতুন চেহারার মুখোমুখি হলাম। হিন্দুকোড বিলের আগে ‘রাও বিল’ নামে একটা বিল পাশ হয়েছিল পার্লামেন্টে। নারীর অধিকারের ব্যাপারে সে বিল ছিল অসম্পূর্ণ। তাই পার্লামেন্টে নতুন করে এল হিন্দুকোড বিল। এই বিলের নিরিখে দেখার সুযোগ পেলাম নামি ও দামি লোকেরাও সমাজ চেতনায় কত সংকীর্ণমনা এবং কত রক্ষণশীল।
এই বিলে মেয়েদের বিয়ের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘শিশুবিবাহ’ ও ‘বহুবিবাহ’ বন্ধ করা হয়েছে, অসবর্ণ বিবাহকে হিন্দুবিবাহ-বিধিতে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং কতগুলো নির্দিষ্ট কারণ থাকলে মেয়েদের বিবাহ-বিচ্ছেদের অধিকারও স্বীকার করা হয়েছে। এছাড়া এই বিলে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের সমানাধিকারের ভিত্তিতে পৈতৃক সম্পত্তিতে সমান অংশীদারত্বও স্বীকৃত। অর্থাৎ, নারী সমাজকে পরিপূর্ণ আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছে এই আইনে। ...
কিন্তু আগে কি জানতাম এই বিলের বিরোধিতা করতে নামবেন বড়ো বড়ো সব নামজাদা লোকেরা? স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অনুরূপা দেবী প্রমুখ অনেক রথী মহারথীরাই আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। হিন্দু সমাজে গেল গেল রব উঠল। আমরাও নিশ্চেষ্ট ছিলাম না। কোনও ভালো আইনজ্ঞের সাহায্য ছাড়া বিলটায় কি আছে আর নেই তা বুঝতে পারা সহজ ছিলো না। মনুসংহিতায় কী আছে তাও একটু দেখে নেওয়া দরকার ছিল।
আমরা প্রখ্যাত আইনজ্ঞ অতুল গুপ্ত মহাশয়ের কাছে গেলাম। তাঁর কাছ থেকেই আমরা সংগ্রহ করতে পারলাম আমাদের প্রচারের মালমশলা। নানা জায়গায় তাঁর বক্তৃতার জন্য আমরা মহিলা ও ভদ্রলোকদের নিয়ে ঘরোয়া সভারও আয়োজন করেছিলাম। ...
আমরা সেই সময় প্রচারমূলক কর্মসূচীর সমাপ্তি উপলক্ষ্যে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে একটা জনসভা ডেকেছিলাম। প্রধান বক্তা শ্রীযুক্তা সরোজিনী নাইডু আর সভানেত্রী ছিলেন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী।
মিটিংএর ঘন্টাখানেক আগে আমরা হলের দুয়ারে গিয়ে তাজ্জব। হল তখন পরিপূর্ণ। রাস্তা বা গেট দিয়ে প্রধান বক্তা বা সভানেত্রীকে নিয়ে আমরা ঢুকতেই পারছি না ভিড়ের ঠেলায়। ভাবলাম হয়তো আমাদের মিটিং শুনতেই এত লোকের আগমন। ... তাদের চেহারা আর হাবভাব দেখেও কেমন সন্দেহ হচ্ছিল। অতিকষ্টে ভেতরে ঢুকে দেখি মঞ্চে উপবিষ্ট রয়েছেন স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ ও রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ... অনুরূপা দেবীও উপস্থিত।
আমার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো। কী করব এখন? শ্যামাপ্রসাদকে বললাম, এটা তো আমাদের ডাকা সভা, মিসেস নাইডু এসেছন বক্তৃতা করতে। উনি বললেন, ‘বেশ তো করুন না মিিটং’। মিসেস নাইডুকে যেন তিনি চেনেন না এমন ভাব দেখালেন। কোনও মতে মিসেস নাইডুকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আমরা তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। মিসেস নাইডুর কম্বুকন্ঠ ডুবে গেল সভাস্থ লোকের হল্লায়। খানিকক্ষণ বলার বৃথা চেষ্টা করে তিনি বসে পড়লেন। এই মিটিং আমরা করতে পারব না বুঝে বিশেষ অতিথিদের নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ...
শ্যামাপ্রসাদের স্বরূপ আমরা দেখেছিলাম পূর্ববর্ণিত সভায়। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, গাড়ি গাড়ি মেয়ে আনা হয়েছিল পাথরেঘাটা থেকে এবং তাদের বলা হয়েছিল সমস্ত হিন্দুকে মুসলমান করে দেবার আইন বন্ধ করার জন্য তোমাদের যেতে হবে। বেচারারা মুসলমান হওয়ার ভয়ে এসে হল্লা করে গেল। দুটো করে টাকাও নাকি প্রত্যেকে পেয়েছিল।” এই ছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। কিছু মানুষ এনাকে মহান বানানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা যতই চেষ্টা করুক এই কুৎসিত ইতিহাস বদলাতে পারবে না।