অমিত শা বাংলায় আবার আসছেন আগস্টে। তাঁর এখন দুই পরিচয়, বিজেপির জাতীয় সভাপতি ছিলেন, আছেন, মুকুটে গুজেছেন আরেকটা পালক, পোশাকী কেতায় মোদী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মানে মোদীর পরেই দুনম্বর ক্ষমতাবান। মসনদে বসার পর প্রথম সফরটি সেরেছেন কাশ্মীরে। তার বার্তাও দিয়েছেন দাপটের সাথে। এই প্রথমবার কোনো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাশ্মীর সফরের প্রতিবাদে উপত্যকায় নাকি বনধ্ হয়নি। তা যদি না হয়ে থাকে তবে ভক্তি দেখাতে যে হয়নি সেটা তিনিও বুঝেছেন। তাই তিনি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন উত্তরোত্তর ভয় দেখাতে। এই অর্থে বলেছেন, কাশ্মীরে সংবিধানের ৩৭০ ধারার ছাড় বরাবর থাকবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। ওটা স্থায়ী বিষয় হতে পারে না, অস্থায়ী। এ নিয়ে ফয়সালা স্থায়ী করতে হবে। অমিত শা বুঝিয়ে দিচ্ছেন এটাই তাদের অপরিবর্তিত ‘কাশ্মীর মডেল’। সারা দেশের প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের জন্যও তাঁদের নীতি হল, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নীতি। ইতিমধ্যে কোথাও তা কুখ্যাত হয়েছে ‘গুজরাট মডেল’, ‘উত্তরপ্রদেশ মডেল’ হিসেবে; আগামীতে কোথাও তা ‘বিখ্যাত’ হতে চাইবে অন্য রূপে।
এভাবেই বাংলা দখলের ‘বেঙ্গল মডেল’ ছকে আগ্রাসী অভিযান চালাচ্ছে বিজেপি। তাদের এই পরিকল্পনায় সবচেয়ে বড় দুটো হাতিয়ার, একদিকে আরএসএস অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার। আরএসএস-এর নেপথ্য পরিচালনায় বিজেপি ঝান্ডা উড়িয়ে এখানে সাজ সাজ রব তুলছে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’। কোথাও লাঠি-আগ্নেয়াস্ত্রের জোরে, কোথাও ধর্ণা-অবস্থান-সভা-সমাবেশ করে। নিজেদের তুলে ধরছে একমাত্র পরিত্রাতা হিসেবে। আর সেইসঙ্গে চালাচ্ছে বিদ্বেষ-বিভাজন-সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি ও বিপজ্জনক নানা ঘটনা-প্রবণতা। অন্যদিকে কেন্দ্রে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই মোদী সরকার সংবিধান-বিকৃত নানা কর্তৃত্ববাদী আচরণ করে চলেছে বাংলাকে নিশানা বানিয়ে। বিজেপি ভাটপাড়ায় সন্ত্রস্ত করার পর হাওয়া গরম করতে শয়তানি ঘটালো গুড়াপে। তৃণমূল সরকারের পুলিশ-প্রশাসন বেমক্কা গুলি চালিয়ে বিজেপির বাড়তি সুবিধা করে দিল। বিজেপি এখন ছুতো করছে তৃণমূলনেত্রীর কাটমানি ফেরতের কূটকৌশলকে। যা ‘বলে’ মমতাদেবী ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ভেসে উঠতে চেয়েছিলেন, সেই ইস্যুতে এখন তৃণমূলের মোকাবিলায় খেলছে বিজেপি। কাটমানির সাথে অন্যান্য দুর্নীতিকেও ইস্যু করছে। তৃণমূলের দলতন্ত্র ও সন্ত্রাসের ইস্যু তো রয়েছেই। এর মোকাবিলার নামে বিজেপির নেতারা এমনকি ‘এনকাউন্টার ডেথ’ মডেল অনুসরণের কথাও খোলাখুলি বলছেন। ‘মব লিঞ্চিং’ বা একদল লোকের ভীড় ঘটিয়ে ‘কি করেছে, কি পরেছে, কি খেয়েছে, কি বলেছে’ জিগির তুলে পিটিয়ে দেওয়া, মেরে ফেলা এখানেও শুরু করে দিল। নতুন করে নিশানা বানাচ্ছে মাদ্রাসা স্কুলগুলিকে। বাহানাটা অতি চেনা। মাদ্রাসায় স্কুল শিক্ষা চলে নাকি লোকদেখাতে। আসলে গোপনে চালানো হয় নাকি সন্ত্রাসবাদের আখড়া, বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের প্রশিক্ষণে। আর এস এস সম্পর্কেযে অভিযোগ আছে ভুরি ভুরি তা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে মাদ্রাসাকে চাঁদমারি বানানো হচ্ছে। উপর্যুপরি উদ্দেশ্য হল, পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের লক্ষ্যে মুসলিম ভোটকে নতুন করে সন্ত্রস্ত করে চলা। কারণ এ রাজ্যের নির্বাচনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট একটা বড় ফ্যাক্টর। ওদের সন্ত্রস্ত করতে উপলক্ষ তৈরী করা হল হঠাৎ ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চার মুসলিম যুবকের গ্রেপ্তারি দাবি করে। তথ্যের প্রকৃত সত্য-মিথ্যা জানার উপায় নেই। যা প্রচারিত হল সেটা একতরফা পুলিশী ভাষ্য। যাদের ধরা হল তাদের মুখ-মাথা ঢেকে হেফাজতে নিয়ে নেওয়া হল। তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হল না। তারা এদেশী, না ওদেশী ধন্দ থেকেই গেল। এরপর হেফাজতের গণতন্ত্র মানে বড়জোর পুলিশী ভাষ্যে কথা বলার সুযোগ মিলতে পারে। এই ধরণের গ্রেপ্তারী যে কত ভূয়ো হয় তা বোঝা যায় ভূয়ো সংঘর্ষের নামে হত্যা, অথবা কালাকানুনে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ করে রাখার ঘটনা-প্রবণতায়। সারা দেশে সব রঙের শাসকদের রাজত্বে এই নির্মম প্রহসন চলে।এখানেও বিনাবিচারে আটকে রাখা বহু রাজনৈতিক বন্দী আছে, বন্দী অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, বার-চৌদ্দ বছর জেল খেটে ইদানিং কোনো কোনো রাজনৈতিক বন্দীর বেকসুর খালাস পাওয়ার খবরও মিলছে। সুতরাং পুলিশী ভাষ্যকে বিশ্বাস করা মানে ঠকে যাওয়া। আর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে মোদী সরকার তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন’টি আরও কড়া করার কথাই বলছে। তাহলে আসলে সন্ত্রাসবাদী কারা?
তাই কেন্দ্রের গোয়েন্দা বাহিনী এরাজ্যে যে ‘অনুপ্রবেশকারী’ দাবি করে মুসলিম যুবকদের গ্রেপ্তারি চালালো তা প্রশ্নাতীতভাবে মানার নয়, আর বিজেপি যে রাজনীতির বাজার মাত করতে চাইছে বাংলার মাদ্রাসাগুলি ‘সন্ত্রাসবাদের গোপন আখড়া’ দাগিয়ে দিয়ে, এসবে কান না দেওয়াই ভালো। এই ছুতোয় বিজেপি নেতৃত্ব উপরন্তু তাতাচ্ছে তাদের ‘এনআরসি’ স্কীম এই রাজ্যেও চালু করা দরকার। ঝোলা থেকে উদ্দেশ্যটা কি বেরিয়ে পড়ছে না?