অক্সফ্যাম ইন্ডিয়ার আয়-সম্পদ বৈষম্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ সালে ভারতের মোট জাতীয় সম্পদের ৭৭%-এর মালিক ছিল সর্বোচ্চ ধনী ১০% ব্যক্তি। ওই বছরে মোট বর্ধিত সম্পদের ৭৩%-এর অধিকারী ছিল ধনীতম ১% মানুষ। অন্যদিকে জনসাধারণের দরিদ্রতম ৫০%-এর সম্পদের বৃদ্ধি ঘটেছিল সামগ্রিকে ১%। মনে রাখা দরকার ওই দরিদ্র ৫০%-এর সংখ্যা ৬৭ কোটি। ফলে ১ কোটি ৩৪ লক্ষ ধনী ভারতীয়ের সম্পদের বৃদ্ধির পরিমাণ দরিদ্র ৬৭ কোটি মানুষের সম্পদের বৃদ্ধির পরিমাণের ৭৩ গুণ। কী অসীম এই বৈষম্য! কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, যিনি নিয়মিত নিজেকে দরিদ্র চাওয়ালা বলে অভিহিত করেন তিনি বললেন, দেশে কেবল দুটি শ্রেণী আছে। একটি দরিদ্র শ্রেণী, অপরটি দরিদ্রদের উপকার করার জন্য ধনী শ্রেণী। আমরা জানতাম, এখনো জানি, ধনীদের ধনলিপ্সার জন্যই দারিদ্র রয়েছে। সমহারে ভারতের আয় বণ্টিত হলে মাথা পিছু আয় হত ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা, বা ৫ জনের পরিবারের আয় হত ৫ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। সম বণ্টিত অর্থনীতিতে দরিদ্র ভারতবাসী বলে কিছুই থাকত না। স্বাধনীতার ৭২ বছর পরেও বিপুল দারিদ্র রয়ে গেছে। এই বিপুল অর্থনৈতিক বৈষম্য বজায় রেখে দেশের মানুষকে সমৃদ্ধির রাস্তায় নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেটাই চাইছেন, দেশে গরিব ও ‘গরিবদের উপকার’ করার দুটি শ্রেণীকে বজায় রেখে। বর্তমানে ভারতে বিপুল দারিদ্রের পাশাপাশি ১১৯ জন শতকোটিপতি আছে। ২০০০ সালে সংখ্যাটি ছিল ৯। ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে প্রতিদিন ৭০ জন নতুন করে কোটিপতি সৃষ্টি হবে। শতকোটিপতিদের সম্পদ গত এক দশকে ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের সামগ্রিক সম্পদের পরিমাণ ২০১৮-১৯ সালের কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটের থেকে বেশি, পরিমাণে ২৪ লক্ষ ৪২ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
ওই প্রতিবেদন এও বলছে যে, অন্যদিকে সাধারণ নাগরিকরা স্বাস্থ্য সুবিধেই পায় না। প্রতি বছরে ৬ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ (প্রতি সেকেন্ডে ২ জন) কেবল স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে দরিদ্র হয়ে পড়ছে। বৈষম্যের বিষয়টি আরও দগদগে হয়ে ওঠে যদি একজন গ্রামীণ শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি আর একজন উচ্চ বেতনের কোম্পানি কর্মকর্তার বেতনের তুলনা করা যায়। অনুরূপ গ্রামীণ শ্রমিকের ৯৪১ বছরের মজুরি একজন উচ্চ বেতনভোগী কর্মকর্তার ১ বছরের আয়ের সমান। ভারতে ধনী ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ কর তেমন কিছু নয়, সর্বোচ্চ স্তরেও তা ৩৫%-এর বেশি নয়, যেখানে ইউরোপীয় স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশগুলিতে তা ৬০% পর্যন্ত রয়েছে। ধনীদের উপর কর বসানো হয় না, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যে সরকারের ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্নগুলির অন্যতম। গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করার বদলে বেসরকারী বাণিজ্যিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ফলে উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা কেবল বিত্তবানদের নাগালেই থাকছে, দরিদ্র মানুষজন সেই পরিষেবা কিনতে অপরাগ। ফলে বিশ্বের প্রসূতি মৃত্যুর ১৭% এবং ৫ বছর পর্যন্ত শিশু মৃত্যুর ২১% ভারতেই ঘটছে।
চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের আরেক নিদর্শন হল কর্মহীনতা, যা এনএসএসও প্রতিবেদন এবং সিএমআইই-র তথ্য থেকে বেড়িয়ে এসেছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিবেদন অনুসারে ভারতীয় অর্থনীতির ৭% গড় বার্ষিক বৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নিম্নহারের মজুরি ও মজুরি বৃদ্ধির খুবই বড় সমস্যা হিসাবে সূচিত হয়েছে। নিয়মিত শ্রমিক কর্মচারিদের ৫৭%-এর মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার কম। মাসিক ৫০ হাজার টাকার বেশি আয় করে এরকম কর্মী মোট কর্মীদের মাত্র ১.৬%। গত ৩ দশকে বেতনের হার নিম্নস্তরেই রয়েছে ও তার বৃদ্ধিও খুব সামান্য ঘটছে। সপ্তম কেন্দ্রীয় পে কমিশনের বিধি অনুযায়ী ন্যূনতম বেতনের হার মাসে ১৮ হাজার টাকা নির্ধারিত হলেও নিয়মিতদের ৫৭% মাসে ১০ হাজার টাকার কম ও অনিয়মিতদের ৫৯% মাসে ৫ হাজার টাকার কম বেতন আয় করে। সামগ্রিকে নিয়মিত কর্মচারিদের গড় মাসিক বেতন ১৩,৫৬২ টাকা ও অনিয়মিতদের মাসিক ৫৮৫৩ টাকা। কৃষি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের মজুরি গড়ে বার্ষিক ৩% চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে। আশ্চর্যজনক হল যে, সংগঠিত ক্ষেত্রের বৃদ্ধির হার অসংগঠিত ক্ষেত্রের থেকে কম। সংগঠিত ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে তা ২% বার্ষিক, অসংগঠিত ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে ৪%, অসংগঠিত পরিষেবা ক্ষেত্রে বার্ষিক ৫%। ওই প্রতিবেদন অনুসারে উচ্চ হারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কর্মসংস্থানে তেমন কোনো বৃদ্ধি ঘটায়নি। বর্তমানে জিডিপির ১০% বৃদ্ধিও কর্মসংস্থানে ১% বৃদ্ধি ঘটায় না।
ভারতীয় অর্থনীতির এই হতাশাজনক অবস্থার প্রেক্ষিতে ভারতীয় জনতা পার্টি নেতৃত্বাধান জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা সরকারের সাম্প্রতিক নির্বাচনী সাফল্যকে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদ, পাকিস্তান বিদ্বেষ ও ধর্মীয় মেরুকরণের পটভূমিতে দ্বিতীয় দফার জয় এলেও, পাশাপাশি ইজ্জত ঘর, উজ্জ্বলা যোজনার গ্যাস, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি যোজনা বা আয়ুষ্মান ভারতের মতো সামাজিক প্রকল্পগুলিও কিছু মাত্রায় নির্বাচনী সাফল্যের রাস্তা প্রস্তুত করেছে। যদিও ওই সব প্রকল্পের সাফল্যের প্রচার যতটা করা হয়েছে তার কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তাতে সন্দেহের অবকাশ থেকে গিয়েছে। আয়ুষ্মান ভারত দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার যে কোনো পরিবর্তনই আনেনি তার অন্যতম দৃষ্টান্ত সম্প্রতি বিহারের মুজফ্ফরপুরে এনকেফেলাফাইটিসের প্রকোপে প্রায় দুশো শিশুর মৃত্যু ঘটে যাওয়া। প্রকারান্তরে ওই শিশু মৃত্যু পর্বে অক্সফ্যাম প্রতিবেদনে প্রদত্ত ভারতের স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল অবস্থাকেই তুলে ধরছে।
যাই হোক না কেন, নির্বাচনী সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে দেশকে ‘এগিয়ে’ নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদেরা সোৎসাহে ১০০ দিনের প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। নীতি আয়োগের কর্তা সেই মে মাসের শেষেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, অর্থনৈতিক সংস্কারে গতি আনাই অন্যতম উদ্দেশ্য হবে ও সেই লক্ষ্যে ৪ ডজন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে হয় বন্ধ করে দেওয়া হবে বা বিলগ্নিকরণ করা হবে। ইতিমধ্যে গত ২৪ জুন রাজ্যসভায় ভারী শিল্প ও রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ মন্ত্রী জানিয়েছেন যে, ২৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগের শেয়ারের ট্র্যাটেজিক বিক্রি করা হবে অর্থাৎ সেগুলির নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তি মালিকানার হাতে তুলে দেওয়া হবে। এর আগে ২০১৭-১৮ সালের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের উদ্যোগগুলির সমীক্ষায় জানানো হয়েছিল যে, ৩৩৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগের মধ্যে ২৫৭টি ৩১ মার্চ ২০১৮ তারিখ পর্যন্ত চালু ছিল, যার মধ্যে ৭১টি অলাভজনক ছিল। নীতি আয়োগের দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে অলাভজনক উদ্যোগগুলিকে হয় বন্ধ করে দেওয়া হবে বা বিক্রি করে দেওয়া হবে এবং লাভজনক উদ্যোগগুলির মধ্যে যেগুলি দেশের নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্বের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয় সেগুলিরও ট্র্যাটেজিক বিলগ্নিকরণ করা হবে। এই বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে সরকার বাণিজ্যিক উদ্যোগ থেকে সরে আসবে ও অপরদিকে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। ফলে, এমনটা চললে কোনো এক সময়ে দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বলে কিছুই থাকবে না।
নির্বাচনের পরে নীতি আয়োগের প্রথম গভর্নিং কাউন্সিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সেই বৈঠকের পৌরহিত্য করেন। ওই বৈঠকে কৃষিক্ষেত্রে বুনিয়াদী সংস্কারের কথা বলা হয়, ও সেই লক্ষ্যে কৃষিতে কাঠামোগত সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী উচ্চাশা পোষণ করে জানান যে, ২০২৪, অর্থাৎ আগামী ৫ বছরের মধ্যে ভারতকে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের (৫ ট্রিলিয়ন ডলার) অর্থনীতিতে পরিণত করা হবে, তা সম্ভবও। তবে বর্তমানের ২.৭ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতিকে ৫ বছরে ৫ লক্ষ কোটি ডলারে নিয়ে যেতে, আমেরিকান অর্থনীতির ২% মুদ্রাস্ফীতি ধরলেও, বার্ষিক ১১%-এর বেশি বৃদ্ধির হার লাগবে। যেভাবে ভারতীয় অর্থনীতির গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে তেমন কোনো বৃদ্ধি ঘটবে বলে মনে হয় না। ফলে মোদীজির বহু আকাঙ্খার মতো এটিও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবে বলে ধরা যায়।
আগেই বলা হয়েছে, আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে যে, বৃদ্ধির হার তেমনভাবে কর্মসংস্থান করতে পারছে না। অন্যদিকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে যে, ভারতের ৮২% পুরুষ ও ৯২% মহিলা কর্মী মাসে ১০ হাজার টাকার কম আয় করে। এই পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থানকে যখন সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার ঠিক তখনই কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশনামা জারি করেছে যে ৫৫ বৎসর বয়স বা ৩০ বছর কর্মজীবন অতিবাহিত করেছে এমন কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন করার ও তার মাধ্যমে তাদের মাধ্যতামূলক অবসরের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। এই নির্দেশনামা কার্যকর হলে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে কর্মরত ৪৭ লক্ষ কর্মীদের এক বিপুল অংশ এই কর্মী সংকোচনের আওতায় চলে আসবে। কেবল রেলওয়েতেই প্রায় সাড়ে বারো লাখ কর্মীর মধ্যে ৩ লক্ষ কর্মীকে অবসর নেওয়ানো যেতে পারে। রেলওয়ের ১০০ দিনের যে এ্যাকশন প্ল্যানের কথা বলা হয়েছে তাতেও রেলওয়ের বেসরকারিকরণের ঈঙ্গিত রয়েছে। মনে রাখা দরকার, ভারতীয় টেলিকম দফতরকে বেসরকারিকরণের দিকে নিয়ে যাওয়ার রাস্তাতেই ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড তৈরি করা হয়েছিল। বিএসএনএল-এর পরবর্তী রুগ্ন হওয়া এখন ইতিহাস। ভবিষ্যতে কোম্পানিটিকে বিক্রি করে দেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। বিএসএনএল-এর অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক কর্মচারিরা গত ৬ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। অপরদিকে বিএসএনএল-এর স্থায়ী কর্মীদের জন্য স্বেচ্ছা অবসরের প্রকল্প নিয়ে আসা হয়েছে। কর্মী সংখ্যা কমিয়ে বিএসএনএল-কে বেসরকারিকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। এয়ার ইন্ডিয়ার ক্ষেত্রেও কোম্পানিটিকে বিক্রি করে দেওয়া হবে বলে ঘোষণাই করা হয়েছে। এর আগে চেষ্টাও করা হয়েছিল। এবার আরও তেড়েফুঁড়ে লাগা হবে।
সামগ্রিকে ১০০ দিনের বৃহৎ পরিকল্পনার অন্যতম মূল বিষয়টি হল, অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচীকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে দেশের সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের মালিকানা বেসরকারী ব্যক্তি পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া। এই বেসরকারিকরণ অবশ্যই দেশের চলমান অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও তীব্র করে তুলবে। নিম্ন আয়ের বর্গটিকে স্বালম্বী করে তোলার বদলে অল্প কিছু খয়রাতির মাধ্যমে নিজের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করানো যাবে। বেসরকারী পূঁজির হাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদের বন্দোবস্ত করতে পারলে কাটমানিও পাওয়া যাবে, যার দ্বারা বিপুল নির্বাচনী ব্যয় করা সম্ভব হবে। এসব যদি ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে হয়, ‘জয় শ্রী রাম’ এবং ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ ধ্বনি তো আছেই।